জননী সারদাদেবী ও সর্বকালীন আধুনিকতা

জননী সারদাদেবী ও সর্বকালীন আধুনিকতা

এক ছকভাঙা জীবনে, কুসংস্কারকে হেলায় উড়িয়ে দিয়ে মানুষের দোষ গুণ কে গুরুত্ব না দিয়ে তিনি সন্তান হিসাবে দিয়েছেন তাদের প্রথম পরিচয়। কিলবিল করা পোকার মত জীবনে নিয়ে এসেছেন আশার আলো। ভারতবর্ষের অন্যতমা আধুনিক নারী, যাঁর একমাত্র পরিচয়, ‘জগন্মাতা’। তাঁর জীবন ও বাণী আধুনিকতার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। জানব সেই প্রসঙ্গে কিছু কথা!

রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সম্পর্কে বলা হয়, তাঁর পৃথিবীতে আবির্ভাব ‘সত্য’যুগের সূচনা করেছিল। আর তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রীমা সারদাদেবী সম্পর্কে বলা যায়, তাঁর আগমন ধরায় আধুনিক যুগের সূচনা করেছিল। চিরকাল ঘোমটা পরিবৃতা মা কে লোকজনের সামনে কোনদিন দেখা যেত না। দক্ষিণেশ্বরে নহবতের ছোট্ট ঘরটিতে তিনি থাকতেন। সেখানে অন্যান্য যাঁরা থাকতেন তাঁরা বলতেন যে তাঁরা জানেন ওই ছোট ঘরটিতে রামকৃষ্ণদেবের সহধর্মিণী থাকেন, কিন্তু তাঁকে দেখা যায় না। তাঁর সারদামনি থেকে ‘জগন্মাতা’ হয়ে ওঠার কাহিনী তো আমরা কমবেশি সকলেই জানি, আজ জানব তাঁর আগমনকে কেন আধুনিক যুগের সূচনা বলা হয়ে থাকে, সেই আখ্যান।

মা ছিলেন সহ্য ও ক্ষমার প্রতিমূর্তি। অদ্ভূত ঐশী ক্ষমতার দ্বারা তিনি নিজের আসল স্বরূপকে লুকিয়ে রাখতেন। স্বয়ং ঠাকুর বলেছিলেন, মায়ের কোপ পড়লে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরেরও সাধ্য নেই সে ক্রোধ শান্ত করার। কিন্তু এই সংসারে সবার প্রতি তাঁর অপরিসীম করুণার কোনও অন্ত ছিল না। সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে এবং নিজের কাজ করে কিভাবে থাকতে হয় সে সম্পর্কে তাঁর নিজের জীবনই ছিল উদাহরণ। শুধু তাই নয়, পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন সর্বাধিক। বলতেন, সর্বদা কাজ করা উচিত, তাতে খারাপ চিন্তা মন থেকে দূরে থাকে। তাই তাঁকে দেখা যায় রাতে উঠে মাটির রোআক থেকে ইঁটের টুকরো খুন্তি দিয়ে তুলতে, যাতে কোনও সন্তানের পা কেটে রক্তপাত না হয়। সন্ন্যাসী ছেলেদের পেটের খবর রাখতেন। ঠাকুর তাঁর ছেলেদের কম করে খেতে দিতে বলতেন মাকে, যাতে জপধ্যানে তাঁদের মন ভাল বসে। মায়ের সটান উত্তর ছিল, ছেলেদের ইহকাল পরকাল তিনিই দেখবেন, সেজন্য তাদের আধপেটা খেতে দিতে পারবেন না। ঠাকুর মাথা পেতে মেনে নিয়েছিলেন সেই নিদান।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book



নিজে প্রথাগত লেখাপড়া শেখেন নি, কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁর সন্তান স্বামী বিবেকানন্দ এই দেশে শিক্ষা বিস্তারের কাজের জন্য নিয়ে এসেছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে। নিবেদিতা মেয়েদের শিক্ষিত করার জন্য অপরিসীম ক্লেশ সহ্য করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নিবেদিতা বালিকা বিদ্যালয়’। সেই বিদ্যালয় মায়ের হাতেই উদ্বোধিত হয়। মা জানতেন, এই দেশে মেয়েদের জন্য সর্বপরি চাই শিক্ষার আলো। তিনি যে উপদেশ দিয়ে গেছেন তা যদি আমরা গ্রহণ করতে পারি, দেখব আদ্যোপান্ত আধুনিক ও সর্বকালের সব দেশের জন্য যুগোপযোগী ও সময়োপযোগী সেইসব উপদেশ।

মা ছিলেন আদ্যোপান্ত সমাজসংস্কারক। কত কুসংস্কার যে তিনি ভেঙেছেন ঘরের মধ্যে থেকে! মুসলমান ভক্তের এঁটো তুলেছেন। কেউ আপত্তি করলে সটান বলেছেন, তাঁর শরত(স্বামী সারদানন্দ) যেমন তাঁর সন্তান, আমজাদও তাই। এরকম কথা তখনকার দিনে বলার মত সাহস খুব কম জনেরই ছিল। সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রচার করে গিয়েছিলেন ঠাকুর, আর মা ছিলেন সেই আদর্শের মূর্ত প্রতীক।



মা ছিলেন সশস্ত্র বিপ্লববাদের প্রবল সমর্থক। তাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছিলেন সেই যুগের বাঘা বাঘা বিপ্লবীরা। ঋষি অরবিন্দ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। মা ও মনে করতেন যে শুধু চরকা কেটে স্বাধীনতা আসবে না। সে জন্য চাই অত্যন্ত দ্রুত আমূল সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তন। কত বিপ্লবী তাঁর আশ্রয়তলে এসে সন্ন্যাসীতে রূপান্তরিত হয়েছেন সে যুগে তার ইয়ত্তা নেই৷ কারণ মা জানতেন ভাবজগতে বিপ্লব না এলে শুধু বন্দুক ধরে কিছুই হবে না।

আমরা আজকাল নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলি। ঠাকুরের খাবার সাধারণত মা বা ঠাকুরের কোনো সন্ন্যাসী সন্তান বহন করে নিয়ে যেতেন। একদিন এক মহিলা মায়ের কাছে আবদার করেন যে তিনি ঠাকুরের খাবার বহন করে নিয়ে যাবেন। অন্তর্যামী ঠাকুরের সেই মহিলার হাতে খেতে আপত্তি ছিল। তিনি সকলের হাতে খেতে পারতেন না। তাই তিনি মাকে অনুরোধ করেছিলেন যে তিনি যেন ওই মহিলার হাতে আর কোনদিন খাবার না পাঠান। সেই যুগে দাঁড়িয়ে মা ঠাকুরকে সটান বলেছেন, তাঁকে মা বলে ডেকে কেউ আবদার করলে তিনি তাকে ফেরাতে পারবেন না। তিনি সন্তানের জাত ধর্ম স্বভাব দেখেন না, তাঁর কাছে মানুষের একটাই পরিচয়, তারা সবাই তাঁর সন্তান। বলেছেন, সন্তান ধুলোকাদা মাখলে তিনিই কোলে তুলে তা পরিষ্কার করে দেবেন, এ তাঁরই দায়িত্ব!!



দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের কাছে মা আসছেন। পথে পড়লেন কুখ্যাত ডাকাত সর্দারের হাতে। সেই ডাকাতেরা মানুষ খুন করে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিত! কিন্তু মা কি করলেন?তিনি যা করলেন এই যুগে যাদের আমরা ভয়হীনা বলে থাকি তাঁরাও পারবেন না। তিনি ডাকাত সরদারকে ‘বাবা’ বলে ডেকে সাহায্য প্রার্থনা করলেন।জিজ্ঞাসা করলেন তাঁর ডাকাত বাবা তাঁকে দক্ষিণেশ্বর যাবার পথে সেই রাতটুকু  আশ্রয় দিতে পারবেন কিনা? ডাকাত সর্দারের হৃদয় তো সেই রাতে পরিবর্তিত হলোই, তাকে আর কোনদিন ডাকাতি করতে দেখে নি কেউ। শোনা যায় ডাকাত ও তার স্ত্রী মায়ের মধ্যে তাদের উপাস্য মা কালী কে সেই রাতে দর্শন করেছিলেন। সেই স্থানে আজও মা কালীর মন্দিরে মায়ের পুজো হয়। 

ঠাকুরের শরীর যাওয়ার পরের ঘটনা। মা সামাজিক প্রথা অনুযায়ী বৈধব্য বেশ ধরেন। কিন্তু ঠাকুর তাঁকে দেখা দিয়ে বলেন যে তিনি তো এ ঘর থেকে ও ঘরে গিয়েছেন মাত্র। এই কথায় নির্ভর করে মা তাঁর সিঁদুর তো মুছলেন, কিন্তু নরুন পাড়ের লাল পাড় শাড়ি ও হাতের বালা দুখানি পরে রইলেন, অর্থাত্ সধবার বেশ একেবারে ছাড়লেন না। এইজন্য সে যুগে তাঁকে কম কথা শুনতে হয় নি। কিন্তু ঠাকুরের নির্দেশ মাথায় নিয়ে তিনি হেলায় উড়িয়ে দিয়েছেন লোকের কথা। এই তেজ সেকালে কেন, একালেও কল্পনা করা যায় না।

এ তো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। এইরকম অজস্র ছক ভাঙতে ভাঙতে মা এগিয়েছেন। শিখিয়েছেন আমাদের সঠিক পথে নিজের মনের কথা শুনে এগিয়ে চলতে। সেই তেজস্বীনি সাহসীনি মায়ের ১৬৭ তম জন্মতিথি আজ। মায়ের রক্তিম চরণে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বাণী আমাদের জীবনে অক্ষয় হোক। তিনি বলেছেন যে তিনি সতের ও মা, অসতেরও মা। তাঁর এই মহাবাণীই আমাদের রক্ষক ও একমাত্র সম্বল।

স্নেহেন বধ্নাসি মনোহস্মদীয়ং 
দোষানশেষান্ সগুণী করোষি। 
অহেতুনা নো দয়সে সদোষান্ 
স্বাঙ্কে গৃহীত্বা যদিদং বিচিত্রম্॥ 

অর্থাৎ, “মা , তুমি আমাদের চিত্তবন্ধনে  বেঁধেছ, এবং নিজগুণে আমাদের সকল দোষ গুণে পরিণত করেছো, দোষীদের  তোমার অভয়ক্রোড়ে স্থান দিয়াছো। তোমার এই অহেতুকী কৃপা বস্তুত অতি বিচিত্র ; এর মর্মোদ্ঘাটনে কেউ সমর্থ নয়।”

মায়ের চরণে শতকোটি প্রণাম!!

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait