রবীন্দ্রনাথ কি পৌত্তলিক? রবীন্দ্রনাথ কি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি ও এবং শিলাইদহে দুই ভিন্ন চরিত্রে প্রতিষ্ঠিত? এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে চুপিচুপি প্রথমেই বলে রাখি, দেবেন্দ্রনাথের অজান্তে, ঠাকুরবাড়িতে সযত্নে আরাধনা করা হত বৈদিক পৌরাণিক দেবদেবীদের। যদিও দেবেন্দ্রনাথও এক সময় মনেপ্রাণে পৌত্তলিক ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথের পিতামহী অলকাসুন্দরী দেবী যখন ঠাকুরপরিবারের গৃহবধূ হয়ে এসেছিলেন, তখন পুজো পার্বণে, গৃহদেবতার সেবায় অন্দরমহলে পৌত্তলিক আবহাওয়া বেশ বজায় রেখেছিলেন তিনি। প্রতিদিন গঙ্গাস্নান, তীর্থ ভ্রমণ, হরিবাসর, কীর্তন— কিছুই বাদ ছিল না। পিতামহীকে তখন রীতিমতো সঙ্গ দিতেন দেবেন্দ্রনাথ। অলকাসুন্দরীর মৃত্যুই আধ্যাত্মিক বদল ঘটায় দেবেন্দ্রনাথের মনে। দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরী দেবী স্বভাবত ধার্মিক ছিলেন, তার উপর দ্বারকানাথের তথাকথিত অধার্মিক আচরণ তাঁকে আরও ধর্মপথগামী করে তোলে। লক্ষ হরিনামের মালা জপ, স্বপাক আহার, স্বামীর ছোঁয়া লাগলে স্নান করে শুদ্ধ হওয়া এবং ‘লক্ষ্মীর অবতার’ হিসেবে পরিচিত দিগম্বরীর ধর্মনিষ্ঠাকে এক লহমায় নস্যাৎ করা দেবেন্দ্রনাথেরও অসাধ্য ছিল। হয়তো তাই পিতৃশ্রাদ্ধের পূর্বরাত্রে স্বপ্নে মা দিগম্বরীর কাছে অপৌত্তলিক পদ্ধতিতে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করার অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ।
এরপরই দেবেন্দ্রনাথ, ব্রাহ্মধর্মের মহিমা প্রচার এবং প্রতিষ্ঠার জন্যেই মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। মূর্তিপূজা বা পৌত্তলিক অনুষ্ঠানকে পুরোপুরি বর্জন করার জন্য তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিভিন্ন পথ ও পদ্ধতি অবলম্বন করেন।
শুরু করা যাক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে। কিশোর রবির জন্য নতুন উপনয়ন-বিধি তৈরি করলেন দেবেন্দ্রনাথ। যদিও আপত্তি উঠেছিল ব্রাহ্মদের মধ্যে থেকেই। লৌকিক হিন্দু-আচার অনুসারে উপনয়ন প্রভৃতি অনুষ্ঠানের সময়ে শালগ্রাম-শিলার প্রয়োজন অনিবার্য। আবার উপনয়ন যেহেতু বৈদিক দীক্ষাবিধি, তাই নানা যাজ্ঞিক অনুষ্ঠানও এর সঙ্গে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। উপনয়নের সঙ্গে একান্তভাবে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পূজাপাঠ ও হোমযজ্ঞ প্রভৃতি ক্রিয়ার অনুষ্ঠান বর্জন করে দেবেন্দ্রনাথ বিশুদ্ধ ও অভিনব উপনয়নবিধি প্রণয়ন করলেন। মূল অনুষ্ঠানের আগে, বহুদিন ধরে সেইসব মন্ত্র বিশুদ্ধ রীতিতে বারংবার আবৃত্তি করিয়ে বালকদের শিখিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন দেবেন্দ্রনাথ। মাঘোৎসবের কয়েকদিন পরে বালক রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হল। তখন তার বয়স এগারো বছর নয় মাস। এই অনুষ্ঠানে বেদান্তবাগীশ মহাশয় পৌরোহিত্য করলেন, আচার্যের পদ নিলেন স্বয়ং দেবেন্দ্রনাথ। মহর্ষি বেদী থেকে যে উপদেশ দিলেন, তাতে উপনয়নের একটি আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা বেশ স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সংস্কৃত ও সংশোধিত উপনয়ন-বিধি প্রাচীন বা নবীন - কোনো দলেরই মনঃপূত হল না।
এ প্রসঙ্গে মহর্ষির একান্ত অনুগত বন্ধু রাজনারায়ণ বসু লিখছেন: “শ্ৰীমৎ প্রধান আচার্য প্রাচীন উপনয়ন-পদ্ধতি যতদূর ব্রাহ্মসমাজে প্রবর্তিত করা যায় তাহা করিলেন। পূর্বে যে-অনুষ্ঠান পদ্ধতি প্রকাশিত হয় তাহাতে উপনয়ন বলিয়া একটি ক্রিয়া আছে বটে, কিন্তু তাহা কেবল ব্রাহ্ম উপদেষ্টার নিকটে কোনো বালককে আনিয়া তাঁহার উপর তাহার ধর্ম ও শিক্ষার ভার অর্পণ করা। ...কিন্তু নূতন প্রবর্তিত উপনয়ন-পদ্ধতিতে গায়ত্রীমন্ত্রে দীক্ষাপূর্বক উপবীত গ্রহণ করার নিয়ম প্রবর্তিত হইল। পৌত্তলিকতা ছাড়া ব্রাহ্মণ্য সকল নিয়ম পালন করিয়া উপনয়ন ক্রিয়া সম্পাদিত হয়।
এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় লিখছেন: “হিন্দুসমাজে পৌত্তলিক অনুষ্ঠানাদির সহিত কোনপ্রকার সম্বন্ধ রক্ষা করা কঠিন হওয়ায় তিনি [মহর্ষি] তাঁদের গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনের সেবা রহিত করিয়া দিলেন। অবশেষে বিগ্রহকে স্থানান্তরিত করিতে উদ্যত হইলে গিরীন্দ্রনাথের বিধবা পত্নী [গণেন্দ্রনাথ ও গুনেন্দ্রনাথের জননী] উহার সেবার ভার গ্রহণ করিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার বাল্যকথা’ থেকে আমরা জানতে পারি যে, গিরীন্দ্রনাথের বিধবা পত্নী গৃহদেবতাকে নিয়ে ভদ্রাসন ত্যাগ করেন এবং দ্বারকানাথের বৈঠকখানার বাড়িতে দুই ছেলে, দুই বৌ, দুই মেয়ে ও জামাইসহ উঠে যান।
এখানেই শেষ নয়, প্রভাতবাবুর কথায় আমরা আরও জানতে পারি: গৃহদেবতার পূজা বন্ধ করিয়া দেবেন্দ্রনাথ বাটিতে সমবেত ব্রহ্মাপোসনা বিষয়ে মনোযোগী হইলেন।
চণ্ডীমণ্ডপে দৈনিক ব্রহ্মোপাসনা প্রবর্তিত হইল, প্রতিমার পীঠস্থানে উপাসনার বেদী নির্মিত হইল। … দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় কন্যা সুকুমারীর বিবাহ হইল। … সুকুমারীর বিবাহে দেবেন্দ্রনাথ প্রাচীন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করিলেন; পৌত্তলিকতা রহিত করিবার উদ্দেশ্যে তিনি তুলসীপত্র-বিল্বপত্র কুশ-শালগ্রামশীলা গঙ্গাজল ও হোমাগ্নি বর্জন করিয়া এক নতুন অনুষ্ঠান পদ্ধতি সংকলন করিলেন ও তদনুযায়ী কন্যার বিবাহ দিলেন। … নিজগৃহে পূজাপার্ব্বন বন্ধ হওয়ায় ও অন্যের গৃহে পূজা দিতে নিমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করায় সাধারণ হিন্দুসমাজের সহিত ঠাকুর পরিবারের বিচ্ছেদটা আরও স্পষ্ট হইয়া উঠিল।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এতই অপৌত্তলিক হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি ঠাকুরবাড়ি থেকে গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনকে বিদায় করতেও দ্বিধা করেননি। সেই সঙ্গে প্রতিমার পীঠস্থানে উপাসনার বেদীবানাতেও কুন্ঠিত হননি।
এই যখন একদিকে ব্রাহ্মনায়ক দেবেন্দ্রনাথের ছবি, অনদিকে তখন দেখি, এক বনেদি বাড়ির অন্দরমহল পার হয়ে চলেছেন রমানাথ ঠাকুরের বাড়ির পুরোহিত কেনারাম শিরোমণি। বাড়ির গিন্নিমা তার হাত দিয়ে কালীঘাটে এবং তারকেশ্বরে পুজো পাঠাবেন যে! পুরো কাজটাই গোপনে করে ফেলতে হবে। আপনারা ভাবছেন, গোপনে কেন? শুনলে হয়তো অবাক হবেন, বাড়িটি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি এবং যিনি গোপনে পুজো পাঠাচ্ছিলেন, তিনি রবীন্দ্রনাথের মা সারদাসুন্দরী দেবী।
দেবেন্দ্রনাথের কঠিন নির্দেশ সত্ত্বেও ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা পুতুলপুজো করেছেন। কখনও গোপনে আবার কখনও প্রকাশ্যেও। বিবাহসূত্রে দূরে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির অনেক মেয়ে নত হয়েছেন হিন্দু পৌত্তলিক ধর্মের কাছে। সারদাদেবীর মৃত্যুর পর সংসারের অধিকাংশ দায়িত্ব সামলাতেন সৌদামিনী দেবী। দেবেন্দ্রনাথের নির্দেশ জারির পর তিনি গোপনে কৃষ্ণের ছবিতে জল, ফুল দিয়ে পুজো করতেন। বলেন্দ্রনাথের মা প্রফুল্লময়ী জীবনের অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের পর আশ্রয় নিয়েছিলেন পৌত্তলিক ধর্মের কাছে। পরমহংস শিবনারায়ণ স্বামীর দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। পরে জ্ঞানদানন্দিনীর পুত্রবধূ সংজ্ঞা, শরৎকুমারী দেবীর কন্যা সুপ্রভা, সৌদামিনী দেবীর মেয়ে ইরাবতী— কেউ হিন্দু গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন, কেউ বা পুতুলপুজো করেছেন পরম ভক্তিতে।
অন্যদিকে মহর্ষির ভাবধারায় অনুপ্রাণিত এবং মহর্ষির নির্দেশেই ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক পুত্র রবীন্দ্রনাথ কত সহজে এবং কত আন্তরিক অনুরাগে শিলাইদহে গোপীনাথের সেবা করে চলেছেন। শুধু তাই নয়, রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ভক্তিভরে গোপীনাথের বিগ্রহকে প্রণাম করছেন – এ প্রমাণও আমরা পাই প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে। মহর্ষি নিজের কন্যার বিয়ে দেন ‘অপৌত্তলিক’ মতে, আর মহর্ষিরই পুত্র রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে বড়দাদা সত্যেন্দ্রনাথের পুত্র সুরেন্দ্রনাথের অভিষেক সম্পন্ন করেন গোপীনাথের আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে। লক্ষ্মী-জনার্দন আর গোপীনাথ এ তো একই দেবতার দুই নাম।
শচীন্দ্রনাথ অধিকারী (“শিলাইদহ ও রবীন্দ্রনাথ”) লিখছেন: ,,, হঠাৎ একদিন কুঠিবাড়িতে একটা উৎসবের আয়োজনের মত মনে হল। ব্যাপারটা ম্যানেজারবাবু ভিন্ন আর কেউ বুঝতে পারলেন না। ষোল বেহারার বড় পালকিটা বের হল, কুষ্ঠিয়া থেকে ব্যাগ-পাইপের দল আনা হল, সদর কাছারি সাজাবার হুকুম হল। খুব ভোরে সুরেনবাবু স্নান করে গরদের ধুতি পাঞ্জাবি পড়ে চাদর পরে ফুলের মালা গলায় দিয়ে সুসজ্জিত পালকিতে চেপে বসলেন। বিশ-ত্রিশ জন বরকন্দাজ ও বাদ্যভাণ্ডসহ সুরেনবাবুকে নিয়ে পালকি চলল গ্রামের অধিষ্ঠাতা দেববিগ্রহ গোপীনাথের মন্দিরে। তিনি গোপীনাথের আশীর্বাদ গ্রহণ করলেন। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে গোপীনাথ মন্দির, গ্রামময় হৈচৈ পড়ে গেল। ব্যাপার কি? শেষ পর্যন্ত বোঝা গেল সুরেনবাবুর অভিষেক।
সুরেন্দ্রনাথ পালকি চেপে শোভাযাত্রায় সারা গ্রাম সচকিত করে সদর কাছারিতে এলেন, রবীন্দ্রনাথ সেখানে আগে থেকেই তার প্রতীক্ষা করছিলেন। ম্যানেজারবাবু মাল্যদান ও প্রণাম করে অন্যান্য আমলাগণ সহ সুরেন্দ্রনাথকে অভিনন্দন জানালেন, রবীন্দ্রনাথ ভাইপোকে কপালে চন্দন ও ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি শিলাইদহ ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলির প্রতিষ্ঠাতা দেব-বিগ্রহ গোপীনাথজীর সেবাপূজা পরিচালনা করতেন ঠাকুর জমিদার সেবাইত সূত্রে। ঠাকুর পরিবার ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী হলেও গ্রামীন ওই প্রচলিত ঐতিহ্য সংস্কার বা প্রথা মান্য করতেন প্রজাদের মতই। রবীন্দ্রনাথ গোপীনাথ মন্দিরে প্রবেশ করতেন জুতো বাইরে রেখে, খালি পায়ে। এলমহার্ষ্ট সাহেব জুতো ছেড়ে গোপীনাথ মন্দিরের কাজ দেখতেন। কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ নববধূসহ আশীর্বাদ গ্রহণ করেছিলেন, এ ঘটনা সকলে দেখেছে। প্রণামী ছিল এক টাকা বা আট আনা, আশীর্বাদ ছিল চরণামৃত গ্রহণ ও ‘লালচি’ (হিন্দুদের পূজায় লাগে, শিবের জোড়) মাথায় বেঁধে বিগ্রহ প্রণাম করা।...
দেবেন্দ্রনাথ বেলপাতা আর কুশ বর্জন করেন, রবীন্দ্রনাথ ধানদূর্বা আর চন্দন গ্রহণ করেন। কবিপুত্র রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে এসেই গোপীনাথের আশীর্বাদ গ্রহণ করেছিলেন এবং এটা তিনি নিশ্চিতভাবেই পিতার অনুমোদনে করেছিলেন। সেই আশীর্বাদ ছিল ‘চরণামৃত’ গ্রহণ ও ‘লালচি’ মাথায় বেঁধে বিগ্রহ প্রণাম করা – যা রথীন্দ্রনাথ করেছিলেন।
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নিজের মেয়ের বিয়েতে গঙ্গাজল আর শালগ্রামশিলা বর্জন করেন, আর মহর্ষির পুত্র নববধূকে নিয়ে চরণামৃত গ্রহণ করেন। এটা কি স্ববিরোধীতা, অথবা বাইরের রূপ আর ভিতরের রূপের পরস্পর বিরোধীতা? কলকাতায় তাঁরা এক আচরণ করতেন, ভিন্ন আচরন করতেন দূরে, শিলাইদহে।
গোপীনাথের প্রসাদ গ্রহণ করাটাও যে শিলাইদহের ঠাকুরবাবুদের সংসারে প্রচলিত ছিল, সেটাও ঘটনা। শিল্পী নন্দলাল বসু শিলাইদহে গিয়ে এক মাসেরও বেশি ছিলেন। সে সময়কার কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন সন্ধ্যেবেলায় আমাদের জলখাবারের জন্য প্রায় প্রত্যহ গোপীনাথ মন্দির থেকে শীতলী প্রসাদ আসত। নন্দলাল ছিলেন রবীন্দ্রনাথের প্রিয়পাত্র ও আপনজন সেইসঙ্গে ঠাকুরের প্রসাদ পাওয়ার ব্যাবস্থাটা তিনিও লক্ষ্য করেছেন।
এই যে গোপীনাথ মন্দির সম্পর্কে আমরা শচীন্দ্রনাথ অধিকারীর বিবরণ অনায়াসেই অনুসরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন: শিলাইদহের ভদ্রপল্লী রবীন্দ্রনাথের আমলে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কুমার, কর্মকার, সূত্রধর, গোপ, জেলে, তঁতি প্রভৃতি জাতির দ্বারা পূর্ণ ছিল।... গ্রামের বিশিষ্ঠ প্রসিদ্ধি ও আকর্ষণ ছিল গোপীনাথের মন্দির ও খোরসেদ ফকিরের দরগা। ... গোপীনাথদেবের রথ ছিল প্রকাণ্ড কাঠের তৈরি। ... গোপীনাথবাড়ির সংস্কার করে ওই দেব-মন্দিরের [তিনি] অতিথিশালা, কাছারি ও সিংদরজা তৈরি করে গ্রামের সৌন্দর্য্যবৃদ্ধি করেন।... তাঁর সময়ে কাছারিতে পুণ্যাহ ও গোপীনাথদেবের পালাপার্বনে, জানিপুরের বিখ্যাত শিবু সাহার কীর্ত্তন, লালন ফকিরের বাউলগান ও যাত্রাথিয়েটারের অনুষ্ঠানে নিরানন্দ পল্লী সঞ্জীবিত হয়ে উঠত।
শিলাইদহের গোপীনাথদেবের সেবাপূজায়, যেখানে ঠাকুরবাবুরা বহু সহস্র মুদ্রা খরচ করতেন, সেই পল্লীবিগ্রহ আজ নৈবেদ্যের চালে তুষ্ট হয়ে মন্দিরে বসে কাঁদছেন। একসময় ছিল, যখন গোপীনাথদেবের মন্দির ও বিগ্রহের স্নানযাত্রার জন্য এই পল্লীটি ছিল সুবিখ্যাত।
রবীন্দ্রনাথ ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতায় বর্ণনা করেছেন:
“রাখি হাটখোলা নন্দীর গোলা, মন্দির করি পাছে
তৃষাতুর শেষে পঁহুছিনু এসে আমার বাড়ির কাছে”।
এই বর্ণনায় হাটখোলা, নন্দীর গোলা আর মন্দির সেই শিলাইদহেরই। শিলাইদহ গ্রামে প্রবেশ করতে হলে সকল পথিককেই এই তিনটি স্থান অতিক্রম করতে হবে।
প্রথমেই ছিল শিলাইদহের কুঠির হাট বা হাটখোলা – যা এখন পদ্মাগর্ভে বিলীন, চিহ্ন মাত্র অবশিষ্ট নেই। তারপরেই ছিল লালনচন্দ্র নন্দীর গোলা। গোলা ছাড়িয়ে আরেকটু গ্রামের দিকে এগুলেই মন্দির, গোপীনাথদেবের মন্দির। সেকালে অনেক দূর থেকেই গোপীনাথের মন্দির দুটি লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করত।
এই গোপীনাথদেবের মন্দির নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠার পেছনে কিছু ইতিহাস নির্বাক হয়ে আত্মপ্রকাশের জন্য অপেক্ষা করছে। এখানে সেই দূর অতীতের প্রসঙ্গ সঙ্গত কারণেই কিছুটা উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথমেই বলে রাখা ভালো যে, রাজা সীতারাম রায়ের আমলে নদীয়া জেলার উত্তর সীমানায় কীর্তিনাশা নদীর তীরে পাশাপাশি দুটি গ্রাম কল্যানপুর ও শিলাইদহের সন্ধান পাই, যদিও আদিতে শিলাইদহ নামে কোন গ্রাম ছিল না। ছিল খোরসেদপুর গ্রাম। খোরসেদ ছিলেন এক বিখ্যাত মুসলমান ফকির। পরে কীর্তিনাশা পদ্মার একটি অংশ বা দহের [নদীর খাদ] নাম অনুসারেই নাম হয় শিলাইদহ। শিলাইদহ কেন? সেখানে এক নীলকর সাহেব ছিলেন, ছিল তার কুঠি, নাম ছিল যাঁর শেলী। এই কুঠীর বর্ণনা আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’ গ্রন্থেও পাই। পরে শেলী সাহেবের নাম থেকে হয় শেলীদহ এবং অবশেষে শিলাইদহ।
এখন সম্পুর্ণভাবে অবলুপ্ত সেই কল্যানপুরের জমিদার ছিলেন কল্যাণ রায় – যিনি জাতিতে ছিলেন তাঁতি এবং বিপুল বিত্তের অধিকারী। তাঁর বিশাল প্রাসাদ এবং কীর্তি এখন কীর্তিনাশার গর্ভে। তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব। সস্ত্রীক তিনি দেবতার আরাধনা করলেন একটি পুত্র কামনায় – কিন্তু সব বিফলে গেল। শেষটায় শান্তির আশায় নদীপথে তিনি গেলেন কাশীধামে – তীর্থ করতে।
কাশীতে গিয়ে তাঁরা যার আতিথ্য গ্রহণ করলেন, তিনি ছিলেন একজন ভাস্কর, পাথরের মূর্তি গড়েন, প্রতিমা গড়েন। একদিন রাত্রে একই সঙ্গে কল্যাণ রায় ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্ন দেখলেন, দেখলেন তাঁদের সামনে সুন্দর এক কৃষ্ণমূর্তি। হাতে বাঁশি, মাথায় চূড়া, গলায় মালা পায়ে নূপুর। সেই বৃন্দাবনের গোপাল। পরদিন সকালে তাঁরা গৃহস্বামী সেই ভাস্করকে স্বপ্নে দেখা মূর্তির কথা বললেন, বললেন, “গোপবেশে বংশীধারী” কৃষ্ণ ও রাধার মূর্তি তৈরি করে দিতে। ভাস্কর রাজি হলেন। তাঁরা তীর্থ পরিক্রমায় কাশী থেকে চললেন পুরী – কল্যাণপুরে ফেরার পথে মূর্তি নিয়ে যাবেন।
এদিকে ভাস্কর যখন মূর্তি গড়ার কাজ শেষ করেছেন, গড়েছেন এক অপরূপ যুগল-মূর্তি, ঠিক তখনই কাশীর কোন একজন রাজা সেই মূর্তি দুটি দাবী করলেন। সেই রাজা কৃষ্ণমূর্তি প্রতিষ্ঠা করবেন – কিন্তু হাতে সময় নেই, তৈরি করার মত সময় দিতে রাজি নন। তাই এই যুগল মূর্তি তাঁর চাইই চাই, যত দাম লাগে, যত বল প্রয়োগ করতে হয়। ভাস্কর প্রথমে অস্বীকার করেন, কিন্তু পরে চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন। শেষ পর্যন্ত কল্যাণ রায়ের জন্য তৈরি করা সেই বিগ্রহ ওই রাজার মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হল।
পুরী দর্শন শেষ করে কথামত নির্দিষ্ট সময়ে কল্যাণ রায় এলেন কাশীতে। উপস্থিত হলেন সেই ভাস্করের বাড়িতে। ইতিমধ্যে ভাস্কর কল্যাণ রায়ের জন্য আরেকটি যুগলমূর্তি তৈরি করে ফেলেছেন। অবশ্য তাড়াতাড়ি কাজ করতে গিয়ে তিনি দ্বিতীয় মূর্তিটি আগের মূর্তির চেয়ে কিছুটা ছোট করে ফেলেন। কল্যাণ রায় ছোট মূর্তি দেখে একটু দুঃখ পেলেন ঠিকই, তবে এটা যে দ্বিতীয় মূর্তি, তা আদৌ বুঝতে পারেননি। তিনি রাধাকৃষ্ণের মূর্তি নিয়ে কল্যাণপুরে ফিরে এলেন। মূর্তি প্রতিষ্ঠা করলেন। মহাসমারোহে পূজা-অর্চনা চলতে থাকে।
তারপর একদিন কীর্তিনাশা পদ্মা ভয়ংকর মূর্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল কল্যাণ রায়ের প্রাসাদ, মন্দির এবং সম্পদের উপর। কল্যাণ রায় ও তাঁর স্ত্রী সবকিছু ছেড়ে, সবকিছু ফেলে শুধু প্রাণের ঠাকুরকে বুকে নিয়ে পালিয়ে এলেন প্রাসাদ থেকে। কিন্তু কোথায় তাঁরা আশ্রয় পাবেন, কে তাঁদের আশ্রয় দেবে? এসে আশ্রয় নিলেন খোরসেদপুর গ্রামে এক বিশাল বটের ছায়ায়। সেখানেই তাঁরা ঘর তুললেন, বানালেন গোপীনাথ আর রাধানাথের আশ্রয়। খড়ের ঘরে তাঁরা সংসার পাতলেন, মন্দির গড়লেন।
মহাকালের নিয়মে কল্যাণ রায় বৃদ্ধ হলেন। আর গোপীনাথের সম্পত্তি ও এই পরগণা নাটোরের রানী ভবানীর এক্তিয়ারে চলে গেল। রানী ভবানীই একটি সুন্দর মন্দির তৈরি করে এক মন্দিরে দুই জোড়া বিগ্রহকে এনে প্রতিষ্ঠা করেন। এখন সেই শ্রীমন্দির রূপময় হয়ে উঠল, আর রাজা সীতারামের গড়া মন্দির দুটি নিঃসঙ্গ ও শুন্য হয়েই পড়ে রইল। কল্যাণ রায়ের মৃত্যুর পর রানী ভবানীর পুত্র রাজা রামজীবন গোপীনাথের সেবা ও পূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এরপর রাজা রামজীবনের জমিদারী নীলামে উঠল। সেই জমিদারী, বিরাহীমপুর পরগণা এবং গোপীনাথের সম্পত্তি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কিনে নেন। কল্যাণ রায়ের ঠাকুর এবার থেকে ঠাকুর পরিবারের ঠাকুরে পরিণত হল এবং প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরই এই গোপীনাথ ও ও রাধানাথের সেবাপূজার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ‘নিরাকারবাদী’ রবীন্দ্রনাথই এই কিংবদন্তীখচিত এবং বিখ্যাত মন্দিরের সংস্কার ও সন্নিহিত ভবনগুলির মেরামত করান।
কল্যাণ রায়ের গোপীনাথ রবীন্দ্রনাথের সেবায় স্বমহিমায় বেঁচে রইলেন, হারিয়ে গেলেন কল্যাণ রায়। এটাই ইতিহাসের পরিহাস।
শিলাইদহে ভগিনী নিবেদিতা, জগদীশচন্দ্র বোস, প্রমূখ বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও গেছেন। গোপীনাথের মন্দিরে প্রণাম করেছেন। শচীন্দ্রনাথ অধিকারী (‘রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ’) লিখছেন: “...কাছারির জনৈক আমলা দক্ষিণারঞ্জন চৌধুরীর ডাক পড়ল রবীন্দ্রনাথের বোটে। দক্ষিণাবাবুকে রবীন্দ্রনাথ ডেকে বললেন, কাল থেকে এঁরা দুজন গ্রাম দেখতে আরম্ভ করবেন। ... জানো তো ইনি হলেন ভগিনী নিবেদিতা - রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দের শিষ্যা।
একদিন সকালে ভগিনী নিবেদিতা গেলেন শিলাইদহের সেই বিখ্যাত গোপীনাথ ঠাকুরের মন্দির ও দেব দর্শন করতে। আগে ভাগেই খবর দেওয়া ছিল বলে বিগ্রহের পূজকেরা মন্দিরের বারান্দায় বিগ্রহ দম্পতিকে একটা কাঠের সিংহাসনে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দুই বিদেশিনীই বাইরে জুতো খুলে বিগ্রহকে প্রণাম করলেন মাটিতে নুয়ে। দুই হাত পেতে বিগ্রহের চরণামৃত পান করলেন।
গোপীনাথের প্রাচীন মন্দির দুটি রাজা সীতারাম রায়ের তৈরি নূতন মন্দিরটি রানী ভবানীর তৈরি। মন্দির ক’টিই ভগিনী নিবেদিতা তন্ন তন্ন করে দেখলেন। সেকালের নানা শিল্পকলার নিদর্শন রয়েছে সেই মন্দিরের পাতলা ইটগুলিতে। স্বাভাবিক ভাবেই বোঝা যায় যে, নিবেদিতার মন্দিরে যাওয়ার এ ব্যাপারে রবীন্দ্রনাথের সম্মতি ছিল।
ঋণ: রবীন্দ্র জীবন কথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়; শচীন্দ্রনাথ অধিকারী - ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিলাইদহ’; দেবতা অনুরাগী রবীন্দ্রনাথ – প্রণবেশ চক্রবর্তী।
Enter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments