কষাঘাত

কষাঘাত

আমাদের রোজকার আটপৌরে জীবনে এতোটাও অভিনবত্ব ছিল? আমরা নিজেরাও জানতাম না তো?

এই কোয়ারেন্টিন জীবন আমাদের কাছ থেকে কেড়েছে অনেক, কিন্তু দিয়েছে বোধহয় তার থেকে কিছু বেশিই! আমরা আত্মমগ্ন ছিলাম। এমন একটা সপ্তাহ কাটেনি যে সপ্তাহে আমরা মল এ যাইনি, রেস্টুরেন্টে ভাল খাবার চেখে দেখিনি। এমন একটা মাস যায়নি যে মাসে আমরা ভাল ভাল পোশাক আশাক কিনিনি! এমন একটা দিন যায়নি যেদিন চব্বিশ টা ঘন্টাকে খুব কম মনে হয়েছে। এমন একটা ভোর হয়নি যেদিন বিরক্ত হইনি সারাদিনের কাজের কথা ভেবে। কেউ একদিনে একবারের বেশি দুবার ফোন করলে ভেবেছি ‘উফফ! আবার! আবার বেশ কিছুটা সময় অপচয় বকবক করে!’ রবিবার ঘুরতে বেরোবার সময় যদি কেউ বাড়ি আসবে বলে ফোন করেছে, আমরা কোয়ালিটি টাইমে আপদ আসছে ভেবে বিরক্তি প্রকাশ করেছি, গজগজ করেছি। কিন্তু মুখোশটাকে গুছিয়ে মেকআপ করে সুন্দর করে রেখেছি! তারপর রাতে মেকআপ তুলে নিজের আসল মুখটা দেখে কত বড় অভিনেতা অভিনেত্রী হয়ে উঠেছি এই ভেবে নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়েছি! কতদিন তো আবার সাদা মিথ্যে বলে দিয়েছি যে আমরা তো আজ নেমন্তন্ন বাড়িতে আছি, আজ নয় পরের সপ্তায় এসো! এভাবে প্রত্যেক সপ্তায় আমাদের কিছু না কিছু কাজ পড়ে যেত! আমরা দুজন আর আমাদের দুজন, ক্রমশ এই হয়ে উঠছিল আমাদের পৃথিবী! গাছ কাটছিলাম নিজেদের ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট বানানোর জন্য, টুজি থ্রীজি ফোরজি করে দুনিয়ার বারটা বাজিয়ে দিয়েছিলাম, নদীগুলোকে নোংরা করছিলাম! যত্রতত্র থুথু ফেলে প্রমাণ দিচ্ছিলাম আমাদের নাগরিকত্বের! ভগবানের এই সুন্দর সৃষ্টিকে প্রত্যহ মাড়িয়ে চলছিলাম কিন্তু নিজেদের ঘরটুকুকে পরিষ্কার করতে ব্যস্ত ছিলাম! এত ব্যস্ত আমরা হয়ে উঠেছিলাম যে নিজেরাই নিজেদের ভগবান ভাবতে শুরু করেছিলাম! এ কারো একার কথা নয়! মিল খুঁজে পাবেন কমবেশি সবাই!

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

অলক্ষে একজন হেসে উঠেছিলেন আমাদের দেখে! তাঁর অঙ্গুলিহেলনে তিনি অনেক অদ্ভূত কাণ্ডই অতীতে ঘটিয়েছেন, এখনও ঘটিয়ে চলেছেন! কিন্তু এতবড় ধাঁধাঁ যে আমাদের জন্য অপেক্ষায় আছে তা বোধহয় আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। দুনিয়াশুদ্ধ লোকজনকে একসাথে জেলবন্দী করার ক্ষমতা বোধহয় শুধু তাঁরই আছে! তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বের করে দিয়েছেন তাঁর উপসনালয় থেকে আমাদের! আরো অনেক পরিবর্তিত করেছেন!

কিরকম?

আমরা অনেকদিন হল রেস্টুরেন্টের খাবার খাইনি! ফলে শরীর খারাপটাও কম হচ্ছে আজকাল! কতদিন নিজেদের আভিজাত্য দেখাতে ঠাট দেখিয়ে ঘরের পাশের মলে গাড়ি চড়ে যাইনি! পুরনো অব্যবহৃত পোশাকগুলোকে কত আপন মনে হচ্ছে! সযত্নে ভাঁজ ঠিক করছি ওই পোশাকগুলোর এই ভেবে যে কতদিন আরো কিনতে পারব না নতুন কিছু! যে লোকগুলোর ফোন এলে, যারা বাড়ি এলে বিরক্ত হতাম তাদের মুখ দেখার জন্য ছটফট করছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না! নিজেরাই নিজেদের রোজ ফোন করছি, মন ভাল থাকছে! ছাদ বলে কোনো বস্তু আছে তা আমরা ভুলতে বসেছিলাম, আজ প্রতিটা বিকেলে ওই ছাদটাই যেন আমাদের অক্সিজেন!

 

শুধু কি তাই? আমরা যে এতো ভাল আঁকি, গান করি, নাচ করি, কবিতা গল্প লিখি, সাজতে পারি, উল বুনতে পারি, রান্না করতে পারি, এসব তো ভুলতেই বসেছিলাম! কোনও রান্না খেয়ে নিজের বাড়ির লোক যখন পাত চাটতে থাকে তখন নিজেদের প্রতি ভালবাসাটা বেড়ে যায় খানিক!

পৃথিবীটাকে আবার বাসযোগ্য মনে হচ্ছে অনেকদিন পর!

আপাতদৃষ্টিতে আমরা যে কোনো পরিস্থিতির জন্য ঈশ্বরকে দায়ী করি, কিন্তু তিনি যে আদতে আমাদের ভালর জন্যই সবকিছু করেন, তা বুঝতে বেলা বয়ে যায়! জীবনের রঙ্গমঞ্চে যে অভিনয় চলে না!

এই হল আত্মদর্শন, যা তিনি দায়িত্ব নিয়ে আমাদের চেনাতে বসেছেন! কোয়ারেন্টিন কেটে গেলে আমরা যেন এ শিক্ষা ভুলে না যাই!

“যখন থাকে অচেতনে এ চিত্ত আমার, আঘাত সে যে পরশ তব, সেই তো পুরস্কার!”

 
 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait