‘আইসোলেশন’! বর্তমান পৃথিবীর ভয়ংকরতম বিভীষিকা! ছোট বড়, আবালবৃদ্ধবনিতা আজ এই আইসোলেশনের কবলে পড়ে ছটফটিয়ে মরছে। আমরা সবাই যেন এক অদৃশ্য কয়েদখানায় বন্দী হয়ে আছি। একে আর যাই হোক স্বেচ্ছাবন্দী কখনই বলা যায় না। এ হল আরোপিত বন্দিত্ব! কিন্তু এ এমন এক বন্দিত্ব যার বিরোধিতারও কোনো জায়গা নেই৷ কারণ বিরোধিতা করলে প্রাণসংকট! কি জ্বালা, তাই না? কাউকে দোষ দেওয়ার উপায় নেই। জ্ঞান হবার দিন থেকে মৃত্যুর দিন অবধি যে মানুষ নামক প্রজাতি অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে নিশ্চিন্তে থাকে, আজ তার বড়ই অস্তিত্বসংকট। দোষ চাপানো যাচ্ছে না যে! বলা যাচ্ছে না যে ওই তো আমাকে জোর করে আটকে রাখা হচ্ছে। অভিযোগহীন বড়ই একঘেয়ে দিন! বয়ে যাচ্ছে সময় নিজের নিরিখে।
তো এই পরিস্থিতিতে মানুষ কি করবে? দেশে জাতিতে জাতিতে দাঙ্গা নেই, বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে তাণ্ডব নেই, বড়লোক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের আগমন নেই, চন্দ্রযানের ব্যর্থতায় নিজের দেশের ব্যর্থতা খোঁজার ব্যস্ততা নেই, আমাজনের অরণ্যে আগুন নেই, ট্রামে বাসে মহিলাদের জ্বালাতন করা নেই, ছিঁচকে চোরের উত্পাত নেই, শ্লীলতাহানি নেই, রাতের অন্ধকারে মেয়েদের ধরে গায়ে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়া নেই, পরনিন্দা পরচর্চা নেই, রাস্তাঘাটে লোক নেই, নিয়মিত রুটিনের ব্যস্ততা নেই, খেলার মাঠে, পার্কে, অলিতে গলিতে শিশুরা নেই, সাইকেল নিয়ে হেঁটে চলা প্রেমিক যুগল নেই, ভরা বসন্তের চোরা চাউনিরা নেই!
ADVERTISEMENT
ভয় নেই!
সাহস নেই!
আরো কত কিছু নেই৷ তাই না?
তবুও তো আছে কিছু। সমস্যা আছে। কি সমস্যা? এই বন্দিদশায়ও এক মানুষকে নিয়ে অপরের সমস্যা। সরাসরি দেখা না হোক, সামাজিক মাধ্যমে দেখা তো হচ্ছেই সবার সাথে। সেখানেও মানুষের হাঁড়ির খবরে অন্যের সমস্যা। কিছু মানুষ দিনরাত চ্যালেঞ্জ ছুড়ছেন একে অপরকে। তাঁরা নিজেদের ছোটবেলার ছবি দিচ্ছেন, শাড়ি ধুতি পরা ছবি দিচ্ছেন, বিবিধ রান্না করে ছবি দিচ্ছেন, গান নাচের ভিডিও তুলে পোস্ট করছেন, বাজার করে ফিরতে ফিরতে নাকে মাস্ক জড়িয়ে সেল্ফি তুলছেন, বাইকের ওপর বসে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন! কেউ কেউ ক্রিকেট এর শ্যাডো প্র্যাকটিস করতে করতে, কেউ কেউ এক মিনিটের প্ল্যাংক করতে করতে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন। কেউ কেউ মীম বানাচ্ছেন, মজা করেই। তো দিননা! ক্ষতি তো তাঁরা কিছু করছেন না।
আরও পড়ুন : জীবন নিয়ে লেখা প্রবন্ধ ‘মহামারী’
কোনো কোনো বোকা মানুষজন রামায়ণ মহাভারত দেখছেন। বই পড়ছেন। সেখানেও বলার উপায় নেই তিনি কি পড়ছেন। কারণ যে বইই তিনি পড়ুন না কেনো অন্যদের পছন্দ হচ্ছে না। ধর্মের বই পড়লে তিনি নাকি ‘ধর্মের আফিমে বুঁদ’, আর জ্ঞান বিজ্ঞানের বই পড়লে তিনি টিপ্পনী শুনছেন যে ‘মরণ সময়েও একটু চৈতন্য হল না!! একটু ভাল বই টই তো পড়লে পারে’। কে বোঝাবে যে বই মাত্রেই ঈশ্বর!
কিছু হতভাগ্য মানুষজন রাতের আকাশে তারা গুনছেন। সেটা বলে ফেলে সমাজে হাস্যাস্পদ হচ্ছেন। কিন্তু এই কলকারখানার শহরে সত্যই আকাশ ঢেকে থাকে ধোঁয়ায়। তারা দেখা যায় না। যা এই লকডাউনের শহরে, স্বচ্ছ আকাশে সত্যি সত্যিই বেশ স্পষ্ট হয়ে ফুটছে।
আপাতদৃষ্টিতে এ সব কিছুই তাঁদের সময় কাটানোর একটা প্রচেষ্টা মাত্র। কিন্তু সমস্যা আবারও ওখানেই। আমাদের এই মানুষ প্রজাতিটির নাকটা বড়ই যে লম্বা। তাই সেখানেও আমরা সমস্যা খুঁজে নিয়েছি। ‘কেনো নিত্যনতুন শাড়ি পরে ছবি তুলছে, জানে না দেশে কতবড় ক্রাইসিস চলছে’, ‘এই বাজারে চিলি চিকেনের রান্না করাছবি দিয়েছে, দেশের আদ্দেক লোক এদিকে খেতে পাচ্ছে না’, ‘শুধু সারাদিন মীম বানাচ্ছে, আসলে ওই তো করে, কলেজে গিয়ে আড্ডা মারে । করত পড়াশোনা, বুঝতাম’। ‘হ্যাঁ, রাতের আকাশে তারা গুনছে। আসলে গুণবেই তো, গৃহবধূ কিনা। কাজই বা কি আছে আর’।
এইটা আমরা কবে বুঝব যে কিছু কাজ করতে প্রতিভা লাগে। প্রতিভা দু রকমের হয়। সদর্থক ও নংর্থক। যে প্রতিভার বিকাশে কারো কোনো ক্ষতি হয় না তাকে মেনে নিতে বড়ই আপত্তি আমাদের। সুন্দর করে সাজা বা সুন্দর রান্না করা কোনো অংশে কম নয় একটা অফিসের প্রেজ়েনটেশন দেওয়ার চাইতে বা ভর্তি ক্লাসরুমে পড়ানোর চাইতে। এক আকাশ ভর্তি তারার নীচে শুয়ে কত সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে, ভবিষ্যতেও বা কত হবে তার হিসাব কেউই রাখে নি!
আরও পড়ুন : শাওনা চক্রবর্ত্তী ঘোষের লেখা প্রবন্ধ “একা এবং ঈশ্বর”
ঈশ্বরকে যদি হাসাতে চাও তো নিজের ভবিষ্যৎ সাজানোর চেষ্টা করো’, একটা প্রাচীন প্রবাদ এটা। সেই ঈশ্বর যখন সৃষ্টি করেন তখন নাকি এ ব্রহ্মাণ্ড স্তব্ধ হয়ে থাকে। ঈশ্বর এক নিবিড় আইসোলেশনে চলে গিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে রচনা করেন নতুন সৃষ্টি, আপন খেয়ালে। সেই নিদানও আমরা মেনে নিতে পারছি না। পারস্পরিক হিংসা, নিন্দা, পরশ্রীকাতরতা এই নির্জন, ভূতুড়ে শহরেও আমাদের ছায়া হয়ে সেঁটে আছে মস্তিষ্কে।
বস্তুত আমাদের থেকে বেশি কৃপার পাত্র বোধহয় দুনিয়ায় আজ কেউ নেই৷ শুনেছি মানুষ যখন মৃতপ্রায় হয় তখন সারাজীবনের তার করা কাজগুলো সংক্ষিপ্তআকারে তার মস্তিষ্কের কোষে কোষে ভেসে উঠতে থাকে। এই আইসোলেশন তারই ইঙ্গিতবাহী নয় তো?
ছবি সৌজন্য : THE CONVERSATION
0 comments