দুর্গাপূজা - ভাবনায় কবি ও সন্ন্যাসী

দুর্গাপূজা - ভাবনায় কবি ও সন্ন্যাসী

নবপত্রিকাকে দু’হাতে জড়িয়ে কাঁধের ওপর ফেলে তিনি এগিয়ে চলেছেন। তাঁর পিছনে সুশৃঙ্খলভাবে চলা মঠসেবক থেকে সাধারণ মানুষ। ঢাকের কাঠিতে মিঠে বোল। শাঁখের আওয়াজে চারপাশ মুখরিত। গন্তব্য সামনের গঙ্গার ঘাট। সপ্তমীর বোধনের আগে নবপত্রিকা স্নান করানো হবে। মানুষটি সটান জলে নেমে গেলেন। নিজেই নবপত্রিকাকে স্নান করালেন। ঢাকিদের তালে তালে উল্লাস নাচ। শঙ্খধ্বনি হচ্ছে। সময়টা ১৯০১। বেলুড় মঠের দু্র্গামণ্ডপ থেকে কলাবউকে কাঁধে নিয়ে বেলুড় ঘাটে স্নান করালেন যিনি, তিনি স্বামী বিবেকানন্দ। বেলুড় মঠে দুর্গাপুজোর প্রচলন উনিই করেছিলেন।

১৮৯৩ সালে আমেরিকা থেকে স্বামীজী যখন তাঁর প্রিয় গুরু ভাই স্বামী শিবানন্দজীকে একটি চিঠি লেখেন তখন বিশ্বধর্ম সভায় স্বামীজীর জয়-জয়কার। এই সময়েই তিনি শ্রী রামকৃষ্ণ আন্দোলনকে বিশ্বব্যাপী বিস্তার করার মানসেই একটি স্থায়ী মঠ নির্মাণের গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। শক্তিরূপিণী মা সারদামণি তাঁর এই প্রেরণার উৎস। তখনও বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শক্তিরূপিণী মা সারদা সম্বন্ধে স্বামী শিবানন্দজীকে তিনি লেখেন “মা ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে।... দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম। তুমি জমি কিনে জ্যান্ত জ্যান্ত দুর্গা মাকে যে দিন বসিয়ে দেবে, সেই দিন হাঁপ ছাড়ব”।

ADVERTISEMENT

এরপর ১৮৯৭ খৃষ্টাব্দে ‘বেলুড় মঠ’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই স্বামীজী তার প্রিয় বেলগাছতলায় বসে সম্মুখে প্রবাহিতা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে আপন মনে গাইতেন:

গিরি গণেশ আমার শুভকারী।

পূজে গণপতি পেলাম হৈমবতী,

চাঁদের মালা যেন চাঁদ সারি সারি।...

বেলুড় মঠে শারদীয়া দুর্গাপূজার আগে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাজা মহারাজ) মঠের প্রাচীন ভবনটির বারান্দায় গঙ্গাতীরের দিকে কাঠের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখতে পেয়েছিলেন, স্বয়ং জগজ্জননী ভগবতী দেবী দুর্গা গঙ্গাপথে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির দিক থেকে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে বেলুড় মঠের দিকে মুখ করে এগিয়ে আসছেন।

স্বামী বিবেকানন্দও এই সময়ে মনে মনে বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা করার কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু নিজস্ব চিন্তার কথাটি তাঁরা পরস্পরের মধ্যে তখনও ভাগাভাগি করেননি। এরপর একদিন ১৯০১ খৃষ্টাব্দের মে-জুন মাস নাগাদ স্বামীজীর অন্যতম গৃহী শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী বেলুড় মঠে এলে বিবেকানন্দ তাঁকে ডেকে রঘুনন্দনের ‘অষ্টবিংশতি তত্ত্ব’ কিনে আনতে বললেন। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন, “আপনি রঘুনন্দনের বইটি নিয়ে কি করবেন”? স্বামীজী বললেন, “এবার মঠে দুর্গোৎসব করবার ইচ্ছে আছে। যদি খরচ সঙ্কুলান হয় ত মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোৎসববিধি পড়বার ইচ্ছা হয়েছে। তুই আগামী রবিবার যখন আসবি তখন ঐ পুস্তকখানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসবি”। যথাসময়েই শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী বইখানি বিবেকানন্দকে এনে দিয়েছিলেন। চার-পাঁচ দিনের মধ্যে বইটি পড়া শেষ করে বিবেকানন্দ তাঁর স্নেহভাজন শিষ্যের সঙ্গে আবার দেখা হতেই জানিয়েছিলেন, “রঘুনন্দনের স্মৃতি বইখানি সব পড়ে ফেলেছি, যদি পারি তো এবার মার পূজা করব”।

বেলুড় মঠে এই দুটি বিষয় জানাজানি হলে দুর্গাপূজার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার সময় শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তি সারদাদেবীর নামেই পূজাদির সংকল্প করা হয়েছিল। সারদাদেবীই ছিলেন বেলুড় মঠের শেষ কথা, তথা ‘হাইকোর্ট’। তাঁর নামে সংকল্পিত হওয়া বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা হবে, কিন্তু তার জন্য সবার আগে সারদাদেবীরই অনুমতি চাই। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস যেমন কারো ভাব নষ্ট করার পরিপন্থী ছিলেন না, সারদাদেবীও ঠিক তেমনই ছিলেন। বেলুড়ে সাধুরা যখন পূজার অনুমতি লাভের আকাঙ্ক্ষায় ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন, সেই সময়ে সারদাদেবী বাগবাজারে বলরাম বসুর ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সবকিছু শুনে তিনিও সানন্দে রাজি হয়ে তাঁর আদরের সন্ন্যাসী সন্তানদের বেলুড় মঠে দুর্গাপূজার আয়োজন করার জন্য সাগ্রহে অনুমতি দান করলেন। তখন শারদীয়া দুর্গোৎসবের মাত্র তিন সপ্তাহ মতো বাকি। শ্রীমায়ের সানন্দ অনুমতি পেয়ে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশ মতো কলকাতার কুমোরটুলিতে গিয়ে চিন্ময়ী দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির অনুসন্ধান করা হলো। পূজার মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকা সত্ত্বেও শেষে কুমোরটুলিতেই একটি একচালার মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন মঠের প্রধান সেবক (তথা অধ্যক্ষ), তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র হিসেবে দেখা হয়, তাঁর ওপরেই পড়লো পূজার আয়োজনের যাবতীয় সব দায়িত্ব। ১৭ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার (৩১শে আশ্বিন) শুভ পঞ্চমী তিথিতে যথা সময়ে কুমোরটুলি থেকে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা এসে পৌঁছালো বেলুড় মঠের ঘাটে। আনন্দের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে গোটা মঠ। রাজা মহারাজ পূজার সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। ১৮ই অক্টোবর, শুক্রবার (১লা কার্তিক) শুরু হলো ষষ্ঠীর কল্পাদি। সেবারে দুর্গাপূজার পূজার আসনে বৈদান্তিক নিষ্কাম সন্ন্যাসীর অধিকার না থাকায় পূজকের পদে ব্রতী হন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল। আর তন্ত্রধারকের আসনে বসেন শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের (শশী মহারাজ) পিতা শ্রীঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য। শশী মহারাজের পিতা সুপ্রসিদ্ধ তান্ত্রিক সাধক পণ্ডিত শ্রীজগন্মোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের প্রার্থনায় স্বয়ং জগজ্জননী শ্রীমা সারদাদেবীও সেবারে দুর্গাপূজায় সপার্ষদ অংশ নিয়েছিলেন। সেই বছর তাঁর নামেই দুর্গাপূজার সংকল্প করা হয়। শ্রীমায়ের পার্থিব তনুত্যাগের পরেও সারদাদেবীর নামেই মঠের দুর্গাপূজা সহ বিভিন্ন পূজার সংকল্প করা বন্ধ করা হয়নি। যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরূপে অবস্থান করেন তিনি তো চিরজাগ্রতই। এখনও সেই প্রথার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯০১-এ সেই যে যাত্রা হলো শুরু, সেই অভিযাত্রা কালের দুর্বার গতির সঙ্গে তালে তালে এখনও সচল।

তবে পরবর্তী সময় থেকে জন্মাষ্টমী তিথিকে কাঠামো পূজার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। তার পিছনে একটি সুন্দর পৌরাণিক অনুসঙ্গ রয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জন্মাষ্টমী তিথিতে যখন মথুরারাজ কংসের কারাগারে আবদ্ধ বসুদেব ও দেবকীর গর্ভে স্বয়ং পদ্মনাভ নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্ম হয়েছিল, সেদিনই একই তিথিতে বৃন্দাবনে নন্দরাজ ও যশোদা দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন স্বয়ং দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া। সেই অর্থে দেবী মহামায়ার কায়িক রূপ লাভের তিথি হিসেবে জন্মাষ্টমীকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতি বছর বেলুড় মঠে এবং তার অধিকাংশ শাখাকেন্দ্রে শারদীয়া দুর্গোৎসবের আয়োজনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় এই দিনে এই রীতিতেই। তারপর ধীরে ধীরে একদিকে যেমন দেবীর মূর্তি নির্মাণের কাজ চলতে থাকে, তেমনই নানা স্থানে লোক পাঠিয়ে দুর্গাপূজার যাবতীয় খুঁটিনাটি উপকরণ একটি একটি করে সংগ্রহ করা শুরু হয়। বেলুড় মঠে দেবীর অভিষেকের জন্য সাধারণত ভুবনেশ্বরের বিন্দু সরোবরের জল সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও গঙ্গা সহ বিভিন্ন নদীর জল, শিশিরের জল, সুগন্ধি জল, সোনা-রূপার জল সংগ্রহ করা হয়। শাস্ত্রীয় বিধান মেনে নানাস্থান থেকে সংগ্রহ করা হয় পনেরো রকম মৃত্তিকা। সেগুলি হলো গজদন্ত-মৃত্তিকা, বরাহদন্ত-মৃত্তিকা, চতুষ্পথ-মৃত্তিকা, রাজদ্বার-মৃত্তিকা, গঙ্গা-মৃত্তিকা, বল্মীক-মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ-মৃত্তিকা, পর্বত-মৃত্তিকা, দেবদ্বার-মৃত্তিকা, গোষ্ঠ-মৃত্তিকা প্রভৃতি। এই বিপুল বৈচিত্র্য থেকে শারদীয়া দুর্গোৎসব যে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মানুষের মিলনোৎসব তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সংগ্রহ করা হয় উত্তম বস্ত্র। পুষ্প, মালা, বেলপাতার নিত্য জোগান দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য সাধারণ উপাচার তো রয়েছেই। এখানে ষোড়শোপাচারে সপার্ষদ সপরিবারে জগজ্জননী দেবীর পূজা হয় দুর্গোৎসবের প্রতিদিন। সংস্কৃতজ্ঞ সন্ন্যাসীরা বিশুদ্ধ উচ্চারণে বিধিপূর্বক শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করেন।

“আজ দুর্গার অধিবাস, কাল দুর্গার বিয়ে।

দুর্গা যাবেন শ্বশুরবাড়ি, সংসার কাঁদায়ে॥

মা কাঁদেন, মা কাঁদেন ধূলায় লুটায়ে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কাব্য, সাহিত্য স্মৃতিকথায়, দুর্গাপূজাকে চিত্রায়িত করলেও ঈশ্বরকে গতানুগতিক অনুসন্ধান করতে চাননি। তাঁর সমগ্র ধ্যান ধারণা ও কর্মসাধনায় অনন্তের চৈতন্যই সমধিক গুরুত্ব পেয়েছে। গৃহ ও গৃহকাজের মধ্যেই তিনি ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, তিনি নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন। তাহলে বাঙালির চিরন্তন উৎসব দুর্গাপূজা নিয়ে তাঁর ভাবনা কি ছিল? ১৯০৩ সালের ২২শে অক্টোবর বোলপুর থেকে কাদম্বিনী দেবীকে লেখা একটা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছিলেন,

“সাকার নিরাকার একটা কথার কথামাত্র। ঈশ্বর সাকার এবং নিরাকার দুই-ই। শুধু ঈশ্বর কেন আমরা প্রত্যেকেই সাকারও বটে নিরাকারও বটে। আমি এ সকল মতামত লইয়া বাদ-বিবাদ করিতে চাই না। তাহাকে রূপে এবং ভাবে, আকারে এবং নিরাকারে, কর্মে এবং প্রেমে সকল রকমেই ভজনা করিতে হইবে। আকার তো আমাদের রচনা নহে, আকার তো তাঁহার-ই।”

এরও দুবছর পরে ১৯১২ সালের ১৮ মার্চ আরেকটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ কাদম্বিনী দেবীকে লেখেন,

“প্রতিমা সম্বন্ধে আমার মনে কোনো বিরুদ্ধতা নেই। অর্থাৎ যদি কোনো বিশেষ মূর্তির মধ্যেই ঈশ্বরের আবির্ভাবকে বিশেষ সত্য বলে না মনে করা যায় তাহলেই কোনো মুস্কিল থাকে না। তাকে বিশেষ কোনো একটি চিহ্নদ্বারা নিজের মনে স্থির করে নিয়ে রাখলে কোনো দোষ আছে একথা আমি মনে করিনে। কিন্তু এ সম্বন্ধে কোনো মূঢ়তাকে পোষণ করলেই তার বিপদ আছে।”

নীলমণি ঠাকুরের কন্যা কমলমণি গল্প করতেন যে, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির “প্রথম দুর্গাপূজা খোলার ঘরে হয়”। বস্তুত দ্বারকানাথ ঠাকুরের সময় থেকেই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোর সমারোহ কিন্তু শুরু হয়। তাঁর আমলে ঠাকুরবাড়িতে দুর্গাপুজো, কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো, জগদ্ধাত্রীপুজো, সরস্বতীপুজো অনুষ্ঠিত হতো। তবে যেহেতু দ্বারকানাথ নিজে ভক্ত বৈষ্ণব ছিলেন, তাই পুজোয় জীববলি হত না। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, “আমাদের বৈষ্ণব পরিবারে কী ভাগ্যি পশুবলির বীভৎস কাণ্ড ছিল না সেই রক্ষা, - পশুর বদলে কুমড়ো বলি হয় এই শুনতুম।”

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর এক ভাষণে উল্লেখ করেছেন, “প্রথম বয়সে উপনয়নের পর প্রতিনিয়ত যখন গৃহেতে শালগ্রাম শিলার অর্চনা দেখিতাম, প্রতি বৎসর যখন দুর্গাপূজার উৎসবে উৎসাহিত হইতাম তখন মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, ঈশ্বরই শালগ্রাম শিলা, ঈশ্বরই দশভুজা দুর্গা, ঈশ্বরই চতুর্ভুজা সিদ্ধেশ্বরী।”

তবে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুর্গাপুজোর সময় ইচ্ছে করেই প্রবাসে কাটাতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন,

“পুজোর সময় কোনও মতেই পিতা বাড়ি থাকিতেন না এজন্যই পুজোর উৎসবে যাত্রা গান আমোদ যত কিছু হইত তাহাতে আর সকলেই মাতিয়া থাকিতেন কিন্তু মা তাহার মধ্যে কিছুতে যোগ দিতে পারিতেন না।”…

“…যষ্ঠীর দিন সবাইকে জিনিসপত্র ‘বিলি’ করে দেওয়া হত। শুধু ছেলেমেয়েরাই নয়, আত্মীয়-স্বজন, কর্মচারী, ভৃত্য এবং ঝিয়েরাও নতুন জামাকাপড় পেতেন। এর পরে আসত পার্বণীর পালা। ...দ্বারকানাথ অত্যন্ত দরাজ ছিলেন এবং প্রচুর খরচ করতেন। এ সময়েই মোয়া, ক্ষীর প্রভৃতি মিশিয়ে একটি বৃহদাকার মেঠাই পুজোর সময় তৈরি করা হত এবং ফুটবলসদৃশ এই বিশাল মেঠাইয়ের স্মৃতি অনেকের মন থেকেই মিলিয়ে যায়নি।”

রবীন্দ্রনাথের মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের ঠাকুরবাড়ির দুর্গোৎসব প্রসঙ্গে জানিয়েছেন যে, “দালানে গিয়ে সন্ধ্যার আরতি দেখতুম, তাদের ধূপধুনা বাদ্যধ্বনির মধ্যে আমরা ঠাকুরকে প্রণাম করে আসতুম, এত বাহ্য আড়ম্বরের মধ্যে এই যা ভিতরকার আধ্যাত্মিক জিনিস।”

বিজয়ার দিন প্রতিমার নিরঞ্জনের মিছিলে ঠাকুরবাড়ির ছেলেরা যোগ দিতেন। মহর্ষি-কন্যা সৌদামিনী দেবী (সৌদামিনী দেবী: মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা কন্যা। স্বামী সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়।) জানিয়েছেন, “আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নতুন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে চলিত আমরা মেয়েরা সেইদিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম। তখন বৎসরের মধ্যে সেই একদিন আমরা তেতলার ছাদে উঠিবার স্বাধীনতা পাইতাম।”

দেবেন্দ্র কিন্তু এ ব্যাপারে বাড়ির মেয়েদের কিছু বলা ঠিক বলে মনে করেননি। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে “বিজয়ার রাত্রে শান্তিজল সিঞ্চন ও ছোটবড় সকলের মধ্যে সদ্ভাবে কোলাকুলি” খুব প্রিয় ছিল। এ ছাড়াও সত্যেন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বিজয়ার দিন প্রত্যুষে আমাদের গৃহনায়ক বিষ্ণু আগমনী ও বিজয়ার গান করতে আসতেন।”

অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “এরপরে বিজয়া। সেইটে ছিল আমাদের খুব আনন্দের দিন। সেদিনও কিছু কিছু পার্বণী মিলত। আমাদের বুড়োবুড়ো কর্মচারী যাঁরা ছিলেন যোগেশদাদা প্রভৃতিকে আমরা পেন্নাম করে কোলাকুলি করতুম। বুড়ো বুড়ো চাকরাও সব এসে আমাদের টিপটিপ করে পেন্নাম করত। তখন কিন্তু ভারি লজ্জা হত। খুশিও যে হতুম না তা নয়। কর্তামশায়কে কর্তাদিদিমাকে এ বাড়ির ও বাড়ির সকলেই প্রণাম করতে যেতুম। বরাবরই আমরা বড়ো হয়েও কর্তামশায়কে প্রতিবছর প্রণাম করতে যেতুম। তিনি জড়িয়ে ধরে বলতেন, ‘আজ বুঝি বিজয়া’।”

পরবর্তীকালে নিজেদের বাড়িতে অনুষ্ঠিত ‘বিজয়া সম্মিলনী’ প্রসঙ্গে অবনীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “বসত মস্ত জলসা। খাওয়া দাওয়া, আতর পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ি। ঝাড়বাতি জ্বলছে। কিন্তু ওস্তাদ তানপুরা নিয়ে গানে গানে মাত করে দিতেন।”

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মা দুর্গাকে খাঁটি সোনার গয়না দিয়ে সাজানো হতো এবং সালংকার সেই প্রতিমাকেই বিসর্জন দেওয়া হতো। ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিকথায় পাচ্ছি,

“...ভাসানের সময়েও সে গহনা খুলিয়া লওয়া হইত না সম্ভবত ভাসানের নৌকার দাঁড়ি মাঝি বা অন্য কর্মচারীরা তাহা খুলিয়া লইত, কিন্তু প্রতিমার গা-সাজানো গহনা আবার ঘুরিয়া ফিরিয়া বাড়িতে উঠিত না।”

তাই রবীন্দ্র সাহিত্যে দুর্গাপূজা খুবই স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। কবিতায়, ছড়ায়, গল্পে, উপন্যাসে সর্বত্রই দূর্গা উৎসবের প্রাসঙ্গিকতা দেখতে পাওয়া যায়। আগেই উল্লেখ করেছি, কবিতার মতোই বেশ কিছু ছোটো গল্পের মধ্যেও রবীন্দ্রনাথ দুর্গাপুজোর প্রসঙ্গকে স্থান দিয়েছেন। “দেনা পাওনা” গল্পের রামসুন্দর মিত্রকে আজও বহু মেয়ের বাবার মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়, যাঁদের দুর্ভাগা কন্যারা তাদের শ্বশুরবাড়িতে এক নিদারুণ মানসিক এবং কখনও বা শারীরিক নির্যাতন ও লাঞ্ছনার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। তাদের অপরাধ কেন তাদের বাবারা পর্যাপ্ত পরিমাণে যৌতুক দিতে অপারগ। রামসুন্দর মিত্রের কন্যা নিরুপমাকেও তার শ্বশুরবাড়িতে ঐ অপরাধের জন্য এক অমানুষিক নির্যাতনের বলি হতে হয়েছিল। শ্বশুরবাড়িতে তার আদরের মেয়ে নিরুপমা কেমন আছে তা দেখতে গিয়ে রামসুন্দর মিত্রকে বারবার নিদারুণ অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অবশেষে, রামসুন্দর “মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিলেন, যতদিন না সমস্ত টাকা শোধ করিয়া দিয়া অসংকোচে কন্যার উপরে দাবি করিতে পারিবেন, ততদিন আর বেহাইবাড়ি যাইবেন না।” কিন্তু বাবার মন তো! দেখতে দেখতে পুজোর সময় এসে গেলে। রামসুন্দর আর স্থির থাকতে পারলেন না। “আশ্বিন মাস আসিল। রামসুন্দর বলিলেন, ‘এবার পূজার সময় মাকে ঘরে আনিবই, নহিলে আমি’ খুব একটা শক্ত রকম শপথ করিলেন’।

পঞ্চমী কি যষ্ঠীর দিনে আবার চাদরের প্রান্তে গুটিকতক নোট বাঁধিয়া রামসুন্দর যাত্রার উদ্যোগ করিলেন। পাঁচ বৎসরের এক নাতি আসিয়া বলিল, ‘দাদা, আমার জন্যে গাড়ি কিনতে যাচ্ছিস?’ বহুদিন হইতে তাহার ঠেলাগাড়িতে চড়িয়া হাওয়া খাইবার শখ হইয়াছে, কিন্তু কিছুতেই তাহা মিটিবার উপায় হইতেছে না। ছয় বৎসরের এক নাতিনী আসিয়া সরোদনে কহিল, পূজার নিমন্ত্রণে যাইবার মতো তাহার একখানিও ভালো কাপড় নাই। রামসুন্দর তা জানিতেন এবং সে-সম্বন্ধে তামাক খাইতে খাইতে বৃদ্ধ অনেক চিন্তা করিয়াছেন। রায়বাহাদুরের বাড়ি যখন পূজার নিমন্ত্রণ হইবে তখন তাঁহার বধূগণকে অতি যৎসামান্য অলংকারে অনুগ্রহণপাত্র দরিদ্রের মতো যাইতে হইবে, একথা স্মরণ করিয়া তিনি অনেক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়াছেন; কিন্তু তাহাতে তাঁহার ললাটের বার্ধক্যরেখা গভীরতর অঙ্কিত হওয়া ছাড়া আর কোনো ফল হয় নাই।”

রবীন্দ্রনাথ ‘পার্বণী’ নামের শারদীয় বার্ষিকীতেই প্রথম পুজোর লেখা দেন। ‘পার্বণী’র প্রথম পূজাবার্ষিকীতে রবীন্দ্রনাথ “শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে’’ গানটি ‘শরতের গান’ নাম দিয়ে লিখেছিলেন। আর লিখেছিলেন ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্প ও ‘ঠাকুর্দ্দার ছুটি’ কবিতা।

বিজয়া দশমী নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা চিন্তা ও আগ্রহ কম ছিল না। সমস্ত রকমের ধর্মীয় সংকীর্ণতা এবং কুসংস্কারের বেড়াজালকে ভেদ করে রবীন্দ্রনাথ বিজয়ার মর্ম উপলব্ধি করেছিলেন। বিজয়ার কোলাকুলির মতো আনন্দ-উৎসব থেকে সরিয়ে রাখাকেও তাই রবীন্দ্রনাথ মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। এর কারণ উল্লেখ করে রবীন্দ্রনাথ নিজের ছোট জামাই নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠি লেখেন : “শ্রীমান নগেন্দ্রনাথ, ... আমি কিন্তু বিজয়ার দিনেই দেশের সকল লোকের সঙ্গে কোলাকুলি করিতে সঙ্কুচিত হওয়াকে সঙ্কীর্ণতা মনে করি এই দিনের শুভদিনত্ব বহুদিন ও বহুজনের অন্তর হইতে জাগ্রত হইয়াছে”।…


0 comments

Aniruddha banik

Aniruddha banik

Shared publicly - 24th Oct, 21 06:51 am

Darun hyeche....!

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 24th Oct, 21 03:28 am

অপূর্ব লিখেছেন দাদা

Aniruddha banik

Aniruddha banik

Shared publicly - 23rd Oct, 21 08:49 pm

Nice one!

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait