মানবসভ্যতা বড়সড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বছরের শুরুটা হল কোরোনার আক্রমণের সাথে। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিলই, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ যখন ভয়াবহ অদৃশ্য ভাইরাসের আক্রমণে শেষ হয়ে যেতে বসেছে, তখন ভারতে হানা দিল কোরোনা নামক অদৃশ্য ভাইরাস। তারপর তো এই আড়াই মাস ধরে আমরা কতকিছু দেখলাম। আড়াই মাস ধরে আমরা ঘরবন্দি। জরুরি কাজে যাঁরা বাইরে যাচ্ছেন তাঁদের ও তাঁদের পরিবারের সবার প্রাণ যেন হাতের মুঠোয়। এই ঘরবন্দি থাকতে থাকতে আমরা কেমন যেন কুঁড়ে হয়ে গেলাম। আজকাল তো আর ঘরের বাইরে বেরোতেই ইচ্ছে করে না। বাইরের স্বাদ ভুলে গেলাম, ঘরে জীবন কাটছে ব্যস্ততাহীন, গতানুগতিক!
কোমরটা অকেজো হয়েছিল, এবার সেই অকেজো কোমরটাকে এক্কেবারে ভেঙে দিয়ে গেল এক সামুদ্রিক দানব, আমফান। সে কি প্রলয়ংকর ঝড়! কি তার শব্দ! যেন রাগে ফুঁসছে, যেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে সাগর থেকে মাথা তুলেছে আমাদের শেষ করে দেবে বলে! করেও গেল। ঝড়ের দুদিন পরে শহরটা কেমন যেন ছন্নছাড়া, কেমন যেন অসহায়। দিগ্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে গাছ, গাছ না মৃতদেহ! ওই গাছগুলোর তলায় কত না স্বপ্ন কতজনে বুনেছিলো কতদিন ধরে। রাস্তার ধারের বাতিস্তম্ভগুলো, রেলিংগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে। যে রাস্তাগুলো দিয়ে আচমকা স্পিড তুলে বেড়িয়ে যেত বাইকগুলো, আর আমরা সাবধানীরা বিরক্ত হতাম ছেলেমানুষদের রক্তের তেজ দেখে, রাস্তাগুলোর সহ্যক্ষমতা দেখে অবাক হতাম, সেই রাস্তাগুলোর চামড়া উঠে কঙ্কাল বেড়িয়ে পড়েছে। আর দেখা যাচ্ছে না সেই দৃশ্য। কান্না চাপা গেল না। চলে এলাম বাড়ি। ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার চিরকালের আশ্রয় সেই ঈশ্বরকে বলেছি, এই দৃশ্য দেখতে যেন বাইরে যেতে হয় না আর!
ADVERTISEMENT
অনেকে ভাবছিলেন দেশের পূর্বদিক ক্ষতিগ্রস্ত হল, কিন্তু অন্যান্য অংশটা ঠিক আছে। আমরা আবার মাথা তুলে দাঁড়াব কিন্তু হায়! তাদের ভুল প্রমাণিত হতে হল। ভাইজাগ এ হঠাত করে গ্যাস দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হল হাজার হাজার মানুষ! আসাম বন্যাকবলিত হয়ে পড়ল। দেশের উত্তর ভাগে ভূমিকম্প অনুভূত হল! উত্তরাখন্ডের বনে দাবানল, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থানে হঠাত পঙ্গপালের হানা দেখা গেল, অসংখ্য রবিশস্য নষ্ট হল! ক্ষেতের পর ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেল। একটা জাতির পাঁজর, হাত, পা, বুকের বল সব সব সব ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেল। গরীব-বড়লোক এখন এক ছাতার তলায়। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচে আজ আমরা সবাই যাচকের দলে। কাজী নজরুল লিখেছিলেন না, “…তারপর বামুন চাড়াল এক গোয়ালে নরক কিংবা স্বর্গে…”, সেই দিনটাই এলো নাকি?
হস্তিনাপুরের রাজসভায় শ্রী কৃষ্ণের স্বরূপ প্রদর্শন
এ কিসের ইঙ্গিত? কুরুরাজসভায় যখন মহাভারতের মহাযুদ্ধের আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শান্তিপ্রস্তাব নিয়ে যান, তখন ক্ষমতালোভী দুর্যোধন তাঁকে বন্দী করতে গিয়েছিল। ভগবান রেগে গিয়ে তাঁর স্বরূপ তখন দেখিয়েছিলেন, তাঁর সেই রূপ শুধু ভীষ্ম পিতামহ, গুরু দ্রোণ ও বিদুর দেখতে পেয়েছিলেন, কেননা তাঁদের অন্তর্দৃষ্টি ছিল প্রখরতর। তাঁরা সেই মহাবিনাশের নিদান মাথা পেতে নিয়েছিলেন, তাই মৃত্যুটাও তাঁদের সহজ হয়েছিল। শ্রী ভগবানের রোষ থেকে কিন্তু তাঁর সাধের যদুবংশও রক্ষা পায় নি, তারাও পরস্পর লড়াই করে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। আমরা কখন নিজেদের অজান্তেই দুর্যোধন হয়ে গিয়েছিলাম বুঝতেও পারিনি। “বিনাযুদ্ধে না দিব সুচাগ্র মেদিনী” বলতে থাকা আমরা আজ সব হারাতে বসেছি। এখনও কি দুর্যোধনের ভুলটাই আবার করব, না শান্তিপ্রস্তাব মেনে নেব, আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ!
বর্তমান পরিস্থিতি যদি আবার কোনো মহাবিনাশের সংকেত হয়, তাহলে বুঝতে হবে ঈশ্বর তাঁর সন্তানদের ওপর এতটাই রুষ্ট, যে এবারেও আর পরিত্রাণ নেই৷ যদি তাই হয়, তাহলে সেই মহামহিম ঈশ্বর যেন তাঁর তেজ সহ্য করার শক্তি আমাদের দেন, আমরা যেন তাঁর নিদান মেনে নিতে পারি। আর যদি এযাত্রা বেঁচেও যাই, তাহলে তাঁর নিয়মকে নির্বিচারে ভঙ্গ করার ধৃষ্টতা যেন আর কখনো না দেখাই।
শুভায় ভবতু!
0 comments