কি নিদারুণ সময় এলো! এতো সাম্যের যুগ! আমরা সাম্যবাদ নিয়ে এতকাল কত জ্ঞান শুনে এসেছি, কিন্তু নিজেদের জীবনে যে এত ভালভাবে সবাই সাম্যবাদী হয়ে উঠব, জন্মেও ভাবিনি!
আর এই সাম্য নিয়ে এলো একটি মুখাবরণ! আজ্ঞে হ্যাঁ! মাস্ক! নানা রঙের নানা রকমের মাস্ক! সৌজন্যে কোভিড-19 ।
বিশদে বলি! ভগবানের বিচিত্র এই সৃষ্টিতে ততোধিক বিচিত্র প্রজাতি আমরা, এই মানুষ প্রজাতি! আমরা ছাড়া আরো কত জীবজন্তু পাখপাখালি গাছপালা কীটপতঙ্গ আছে এই পৃথিবীতে! কেউ আমাদের মত এত কৃত্রিম নয়! ভগবান যাকে যেমন সৃষ্টি করেছেন সে সেরকমই ভাবে কাটিয়ে দেয় তার জীবনকাল, শুধু মানুষ ছাড়া! শুধু মানুষের লাগে প্রসাধন, মানুষের লাগে আবরণ, মানুষের লাগে পর্দা! মানুষের আছে মুড সুইং, মানুষের আছে অভিমান, মানুষের আছে রাগ, আছে ব্যাথা, বিরহ! আছে অনুভূতি! সে অনুভূতি সূক্ষ, তার প্রকাশ সূক্ষতর! মানুষের আছে বুদ্ধি! কিন্তু সে তো অন্য প্রাণীদেরও আছে! তাদেরও বুদ্ধি আছে, সে বুদ্ধি আত্মরক্ষার! সে বুদ্ধি খাদ্য যোগানের! সে বুদ্ধি বংশবৃদ্ধির! সে বুদ্ধি কিন্তু ক্ষতিকর নয় অন্য কারো জন্য! হিংস্র প্রাণীদেরও নিয়মে বাঁধা জীবন! প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিকার তারাও করে না!
ADVERTISEMENT
মানুষেরও বুদ্ধি আছে! সে বুদ্ধি দিয়ে সে সমাজকল্যাণের জন্য কত কিছু করেছে সৃষ্টির আদিকাল থেকে! কিন্তু আরো একটি বস্তুও মানুষের আছে! আর তা হল ক্ষতিকারক ‘বদবুদ্ধি’! সেই বদবুদ্ধি দিয়ে সে সর্বদা মতলব আঁটছে কিকরে অন্যকে পিছনে টেনে নামানো যায়, কিকরে কাদা ছেটানো যায়, কিভাবে ক্ষতি করা যায়!
এই সমাজের মাপকাঠিতে সুন্দর-অসুন্দর, গরীব-বড়লোক, চালাক-বোকার নিরিখে মানুষ বিচার হয় আজও! সততা কি আজও নেই? আছে বটে! কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রের চোখরাঙানিতে সে ভয় পেয়ে গর্তে লুকায়! সৎ হতে গেলে যে খাঁড়ার ঘা টা তার ওপরেই আগে পড়ে! কত প্রতিভা আজও হারিয়ে যায় অর্থবলের চাপে! অযোগ্য যোগ্যতা পায়, যোগ্যতা নিভৃতে হারিয়ে যায়! খেলার মাঠে ভাল খেলোয়াড়কে ‘ল্যাং মেরে’ তার পা ভেঙ্গে দিয়ে তার কেরিয়ার নষ্ট করার বহু উদাহরণ আছে! তা একই ভাবে প্রযোজ্য জীবনের খেলার মাঠেও!
কিন্তু বাবার ও তো বাবা আছে! তাঁর সাম্যের রাজ্যে, তাঁর নিয়মের রাজ্যে নৈরাজ্য অরাজকতা সৃষ্টি করলে তাঁকে তো শাসন করতেই হয়! তাই তিনি আমাদের সাথে শাসনেরই চাবুক উঠিয়ে একটু বিপজ্জনক ‘মজা’ করলেন! আমাদের সবার জন্য একটি করে ‘মাস্ক’ উপহার পাঠালেন! এই মাস্ক হয়ত আমাদের আজীবন মুখের ওপর পরে থাকতে হবে! জীবনে অনেক সময় আমাদের সবার এসেছে যখন ব্যস্ত রাস্তায় পরিচিত কাউকে লক্ষ্য করিনি! কিছুদিন পরে শুনতে হয়েছে যে অহংকারবশত নাকি রাস্তায় চেনা দিই নি, যা আদপেই সত্যি নয়! এমনও সময় এসেছে যখন রাস্তায় কাউকে আমরা চেনা দিতে চাইনি ইচ্ছে করে, অবজ্ঞা করে চলে এসেছি, কিছুদিন পরে ইশারা পেয়ে তিনি যখন আমায় চিনতে পারেন নি তখন ভেবেছি ‘যাক, বাঁচা গেল’! কতজন উপহাস করে দুঃখ দিয়েছে আমাদের, কতজন মান দিয়েছে, সেই মান থেকে অহংকারের জন্ম হয়েছে, নিজেদের কেউকেটা ভেবেছি আমরা! মান পেতে পেতে নিজেদের কখনো ভগবান ভাবতে শুরু করেছি, দয়া আর উপহাস পেতে পেতে জীবনটাকে কখনো অসহ্য লেগেছে হয়ত আমাদের সবার! আমরা তো নিজেদের দুঃখ লুকিয়ে নিজেদের সুখ জাহির করে মুখোশ নিয়েই বাঁচছিলাম!
তিনি অন্তর্যামী, অন্তরের কথা ঠিক বুঝেছেন! সেই অন্তর্যামী ঈশ্বরকে প্রণিপাত! তিনি আমাদের মাস্ক পাঠিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছেন! এমনিতেই তো আমাদের প্রত্যেকের তিন চারটে অদৃশ্য মুখোশ আছেই, প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগাই! এবার থেকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত! আর রাস্তায় কেউ কাউকে দেখে চেনার উপায় রইল না! কোনো কথা শোনার বা শোনানোর অবসর রইল না!! সামাজিক মেলামেশা কতদিনের জন্য বন্ধ হল কে জানে? জীবন কি আবার আগের মত হবে?
আমরা ছটফট করব সেই দিনগুলো ফেরত পাওয়ার জন্য! প্রতীক্ষায় থাকব কোনো চেনা মানুষের। কোনো এক মিষ্টি বিকেলে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে বসে তুমুল আড্ডা হচ্ছে, হাসতে হাসতে গায়ে চাপড় দিচ্ছি, এরকম স্বপ্ন দেখব, তবুও ছুঁতে পারব না কাউকে। কারণে অকারণে কারো গায়ে হাত তুলে, চায়ের দোকানের কিশোর ছেলেটার একটা কাপ ভেঙে ফেলার শাস্তি স্বরূপ তাকে থাপ্পড় মেরে, ছোট শিশুকে হাতের কাছে পেয়ে নিজের সমস্ত রাগটা তার ওপর উগরে দিয়ে নিজেদের পুরুষত্ব চরিতার্থ করতে পারব না! আর যেহেতু রাগ জাহির করতে পারব না, তাই গুমরে মরব আর ভাবব, ‘আহা! কত কিছু হয়ে গেল অপচয়’!
এটাই আমাদের শাস্তি!
অলক্ষে বসে তিনি বাঁশি বাজাবেন, বড় বেদনাতুর সুরে! আমরা শুনতে পাবো কি???
0 comments