পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের লজ্জা

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের লজ্জা

কিছুই হবেনা জানেন তো। এই মুদ্রাস্ফীতির মরশুমে, এই করোনা ভীতির আবহে, কথায় কথায় সাম্প্রদায়িক হানাহানির আবহে আমোদগেঁড়ে শহুরে শিক্ষিত বাঙালির দুদিনের মশলাদার গঞ্জিকা-নেশা ছাড়া আর কিছুই হবে না। ঐ সুন্দরী কচি যুবতী আর  ঐ ভুঁড়িওয়ালা দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতার যৌনকেচ্ছা, সারাটা রাজ্যজুড়ে কোটি কোটি টাকার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি এখন মিডিয়ার জয়নগরের মোয়া। হলুদ ট্যাক্সির মিটারের মতো টিআরপির মিটার চড়ছে বাইশে জুলাই থেকেই। কিন্তু এও খানিক লিঙ্গোত্থানের মতোই। উত্তেজনা আসতেও যতক্ষণ, যেতেও ততক্ষণ, বড্ড ক্ষণস্থায়ী।
 
 
লালপার্টি চৌত্রিশ বছর এমনি এমনি সরকারে ছিল না। তাদের ভোটব্যাঙ্ক ছিল মূলত গ্রাম গঞ্জের চাষাভুষো শ্রেণী। গ্রামের চাষা মার্ক্স লেনিন বুঝত না, কেবল বুঝত এরা থাকলে জমি তার দখলে থাকবে। যবে থেকে এই নীতি থেকে নড়ে গেল, বুদ্ধবাবুর মতো শিক্ষিত লোকজন গ্রামের মানুষকে জ্ঞান দিতে গেল শিল্প-টিল্প নিয়ে, জমি দখল করে চিমনীর ধুঁয়ো দেখাতে গেল… প্রপাত ধরণীতল। বুদ্ধবাবুর শিক্ষাদীক্ষা আর সাংস্কৃতিক চেতনাই কাল হলো বাংলার লালেদের।
 
 
দরকার ছিল জ্যোতি বসু, অনিল বিশ্বাসের মতো ধুরন্ধর রাজনীতিবিদদের যারা বাংলায় টিকে থাকার রাজনীতিটাই ভালো জানে। আজ বাংলায় লালপার্টি ভোট পাচ্ছেনা কারণ ঠিকঠাক কোনো অ্যাজেন্ডা নেই সেইমতো। জমি বেহাত হয়ে যাবার ভয় আর নেই গ্রামের মানুষের। গরীব মানুষ সাইকেল, কাঁচা টাকা, ডিমসিদ্ধ, বিদেশি মদ, সিভিক ভলান্টিয়ার… সবই পাচ্ছে। কাজেই কেনই বা লালপার্টি আর ভোট পাবে!
 
 
রাজনীতিতে ফিরতে হলে ফেবু বা মিডিয়া নির্ভর ইন্টালেকচুয়ালিটি ছেড়ে আবার ঐ অনিল বিশ্বাস জ্যোতিবাবুদের পথেই যেতে হবে তাদের। গ্রামের প্রান্তিক মানুষের যেনতেনপ্রকারেণ তুষ্টিই এ রাজ্যের ভোটসন্তুষ্টি,  সেখানে মার্ক্স লেনিনের পুষ্টির কিস্যু দরকার নেই।   
গেরুয়াবাহিনীর বরং অ্যাজেন্ডা আছে বাংলায়। হিন্দু তাস খেলে দিয়েছে লালেদের দূর্গ পতনের পরেই। ভারতের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর দেশে এ তাস যে মহার্ঘ্য। ২০১১ এর পরে তো আর প্রশাসন বলে তো কিছু নেই। সস্তার একটা যাত্রাপালা চলছে মাত্র।
 
 
তারওপর সীমানাবর্তী এই বাংলা যে অবাধ অনুপ্রবেশের দ্বার এ জানতে কারো বাকি নেই। অনুপ্রবেশকারীদের জাল পরিচয়পত্রই তো এ রাজ্যের অন্যতম কুটিরশিল্প আজকাল। এই সবুজ প্রশাসন তো ‘দুধেল গাই’ এর সংজ্ঞা তো স্পষ্ট জানিয়েই দিয়েছে। দিনের পর দিন তোষণের রাজনীতি খেলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে কাঁচকলা দেখিয়েছে। বিরুদ্ধ রাজনীতি তার ফায়দা তুলেছে যথারীতি। তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বাঙালীর চেতনাকে অধিকার করে নিয়েছে।
 
 
রাজ্যে শিল্প-টিল্পর বালাই নেই, মাঝে মাঝে শিল্পমেলা হয় যেখানে কোট-প্যান্ট-টাই পরে হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সঙেদের তোষামোদী চলে। বেকার যুবক যুবতীরা রাস্তায় বসে ধর্না দেয়, কিংবা লাঠি হাতে সিভিক ভলান্টিয়ার হয় বা গরম গরম চপ ভাজে। গ্রামের চাষীর জমি দখলের ভয় নেই, বরং উপরি পাওনা হিসেবে  নিত্য নতুন ভাতা আসছে, রেশন আসছে, কাঁচা টাকা ঢুকছে বাড়ির লক্ষীভাঁড়ে। অনুপ্রবেশকারীদের শেল্টারের চিন্তা নেই, রাজনৈতিক নেতারা দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। দালালদের রোজগারের ভয় নেই, জাল পাসপোর্ট, জাল আধার থেকে নারী কিংবা গরু পাচার সবেতেই এ রাজ্যে কুটির শিল্পের ছড়াছড়ি। যারা ভোট দেয় তারা তো মহানন্দেই আছে, সুখে আছে। ভোটের সময় ডিমভাত বা মাংস ভাত থেকে গুড় বাতাসা… সবই পাচ্ছে। রাজনৈতিক নেতা মদ্যপান করে এসে ফেসবুকের লাইভ করে ‘এন্টারটেইমেন্ট’ দিচ্ছে তাদের। কথায় কথায় সিনেমার নায়ক নায়িকারা গ্রামে গঞ্জে নাচাগানা করতে চলে যাছে রাজনীতির উঠোনে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব সস্তার কবিতা লিখে পুরষ্কারের তেল-পুকুরে ডুবকি লাগাচ্ছে। আপামর বাঙালী বেশ ভালোই আছে।
 
 
তাছাড়া এই সরকার না এলে বুঝতেই পারতাম না বাঙালী শিল্পী, বুদ্ধিজীবী নামক তথাকথিত শ্রদ্ধাশীল লোকজনের অধিকাংশই স্রেফ ক্ষমতা আর টাকার পদলেহনকারী। তাদের যত বিপ্লব, আদর্শ সবই হয় মঞ্চে, সিনেমার পর্দায় কিংবা লেখার পান্ডুলিপিতে। চারিত্রিক দিক থেকে তারা নেহাতই কেন্নো, ভীতু, আপোষী।
 
 
এই সরকার দেখিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের পাপেট শো করে কীভাবে সীমাহীন দুর্নীতি আর ঔদ্ধত্য  দেখেও চোখ উলটে ফেলে কবিতা উৎসব, সঙ্গীতমেলা, ফিল্ম কিংবা বই মহোৎসব আয়োজন করা যায়! কাজেই গুটিকয় শহুরে ফেবু বাঙালীর এই নাচোনকোঁদন, ফেবু প্রতিবাদে কীই বা এসে যায়!
 
 
গণতন্ত্র শব্দটি খুব সুস্বাদু হলেও এর ভার যেন দ্বিমুখী ছোরার মতো। সংখ্যাগরিষ্ঠকে যেন তেন প্রকারেন খুশি রাখতে পারলেই ভোটরাজ্যের অধীশ্বর হওয়া বাঁধা। এ রাজ্যের গণতন্ত্র এখন সস্তা একটা ভাঁড়ামি ছাড়া আর কিছুই নয়। গণতন্ত্রে ভোট প্রক্রিয়া নিয়ে সিরিয়াসলি ভাবার সময় এসেছে।
 
 
শুনেছি মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের কর্মচারীরা নাকি খুব খুশি থাকে ‘বস্‌’ এর ওপরে। তাদের খুশি করে দেয় তাদের বস। তারা দেখতেও যায় না টাকায় রক্ত লেগে আছে কিনা। 'আপনে বাঁচলে বাপের নাম।' কিন্তু তাই বলে দাউদকে যদি জাতির পিতা বলে আগামীতে ঘোষণা করা হয় ব্যাপারটা যেমন হবে এখন ঠিক তাইই হচ্ছে। একটা রাজ্যের প্রশাসন শুধু জনগণেশের ভোটের ওপরে টিকে থাকতে পারেনা।
 
 
নিয়মিত ‘অডিট’ এর রেজাল্টে যদি ধরা পরে সীমাহীন দুর্নীতির পোকা কুরে কুরে খাচ্ছে রাজ্যটাকে, তবে সে প্রশাসনকে সিংহাসনচ্যুত করার অধিকার যেন নিরপেক্ষ ফার্স্ট-ট্র্যাক আদালতের হাতে থাকে। নাহলে এভাবে চলতে পারেনা। পৃথিবীর বৃহত্তম হাস্যকর গণতন্ত্রের অংশ হয়ে নিজেরই লজ্জা লাগছে। 
 
 
অতনু প্রজ্ঞান 
২৮ শে জুলাই , কোলকাতা
ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

0 comments

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait