লক্ষ্মীরূপেণ
"সুমনস বন্দিত সুন্দর মাধবী
চন্দ্র সহোদরী হেমময়ী
মুনগণ মন্ডিত মোক্ষপ্রদায়নী
মঞ্জুল ভাষীনি বেদনূতে।"
তিনি সত্ত্বগুণে বিষ্ণুর পত্নী লক্ষ্মী, রজোগুণে ব্রহ্মার গৃহিনী বাগদেবী, তমোগুণে শিবের বনিতা পার্বতী। অর্থাৎ, সত্ত্বগুণাশ্রয়ী দেবী মহা লক্ষ্মীর যে চিত্র অঙ্কিত হচ্ছে তা হল এক শান্তশিষ্ট, অতীব মঙ্গলকারিনী, সর্বসুলক্ষনা এক নারীর। যিনি সত্ত্বগুণের আকর। যিনি ক্ষমা, ধৃতি, সহ্যশক্তি সম্বলিতা। মহাবিষ্ণু যেমন ঘোর নিদ্রাবিভূত হয়ে সংকল্পমাত্র জগৎসংসার সৃষ্টি করেন, অতীব সহ্যশীলা দেবী লক্ষ্মী সেই জগৎকে নিজ ঐশী ক্ষমতায় ধারণ করে রাখেন। তাঁকে পেতে গেলে মন্থন করতে হয় সেই সমুদ্র, যে সমুদ্রে সংসারের সমস্ত গুণ নিমগ্ন থাকে। মন্থন করেন দেবতা এবং অসুর। দেবতারা নেন মন্থনসম্ভূত সাত্বিক ও রাজসিক দ্রব্য, যেমন জ্ঞান, বাহন, অস্ত্র, উত্তম পুষ্প, উত্তম পানীয়, ঔষধি, চিকিৎসক (ধন্বন্তরি), এবং সর্বোপরি মা লক্ষ্মী, যিনি সমুদ্রের গভীরে ছিলেন ধ্যানরতা। এবং অসুররা চায় তামসিক দ্রব্যাদি, যেমন সুখ, ঐশ্বর্য, অলংকার, অমরত্ব---এইসব। সেই মহালক্ষ্মী মন্থন থেকে নির্গত হয়ে শ্রী বিষ্ণুর বক্ষে বরমাল্য প্রদান করলেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে তাঁকে আবাহন করতে এক বিশাল যজ্ঞের আয়োজন করতে হয়েছিল দেবে-দানব-এবং অন্যান্য প্রাণীদের। এই দেবী নিপুণ এক কর্মযোগিনী। সাংসারিক সমস্ত কাজে পটুত্ব যাঁর অনায়াস। নিজের গুণে সমস্ত জগৎ সংসার আলোকিত করেন তিনি। তার সাথে তাঁর রূপ ভুবনমোহিনী। যিনি ব্যক্তিত্বময়ী, যাঁকে দেখামাত্রই মনের মধ্যে এক ভক্তিভাব জেগে ওঠে। ঐজন্যই সংসারে মা লক্ষ্মীর মত মেয়ে, বৌমা সবাই চেয়ে থাকেন। কিন্তু শুধু চাইলেই তো হবে না, তাঁকে ঘরে স্থানও তো দিতে হবে, সেটা অনেকেই পারেন না। তিনি অনাচার, অপটুত্ব এবং অনিয়মানুবর্তিতা সহ্য করতে পারেন না, এবং যে স্থানে এই কাজগুলি হয় সেই স্থান তিনি পরিত্যাগ করেন। সাধারণ মানুষ তা বোঝে না, আর বলেন, মা লক্ষ্মী নাকি 'চঞ্চলা'।
ADVERTISEMENT
আমাদের দেশে শক্তিপূজা হয়। সেই শক্তি ভিন্ন ভিন্ন নামে প্রকাশিতা। দেবী দূর্গারূপে মহাগৌরবর্ণা যিনি অসুরদলন করেন, তিনিই আবার মা লক্ষ্মী হিসাবে ভক্তের চতুর্বর্গ মনোবাসনা পূর্ণ করেন। আবার ক্রোধরূপিণী তিনিই মা কালী। তখন তাঁর ক্রোধ তাঁর অঙ্গকে কালো বর্ণে রূপান্তরিত করে। তখন বিশ্বসংসার ত্রাহি ত্রাহি করতে থাকে। জগতকে রক্ষা করার জন্য শিব যখন নীলকণ্ঠ হন, তখন এই মা কালীই তাঁর বিষজ্বালার উপশম করেন।
যে মেয়েটি অন্ধকার ঘরে লণ্ঠনের আলোয় পড়াশোনা করে বৃত্তি পায়, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি অলিম্পিকে মেডেল পায়, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি নিজের শখ আহ্লাদ ভুলে দিনশেষে উপার্জনের কটা টাকা এনে বাবার হাতে তুলে দেয়, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি বাসে ট্রামে চোরা হাতের স্পর্শকে চোখের এক দৃষ্টিতে থামিয়ে দিতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি নিপুণ হাতে সংসার গড়ে তোলে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি তিলতিল করে জমানো টাকার ভাঁড় এক নিমেষে ভেঙে কারো চিকিৎসায় ব্যয় করতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়ে ঘুষ দিতে এলে ঘাম ছুটিয়ে দিতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি সিগন্যাল ভাঙার অপরাধে প্রভাবশালীর ছেলেকে জেলে পাঠাতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি সমাজের নোংরা অশালীনতার গালে সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে 'না' বলতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি পঙ্গু স্বামীর সেবা করে নিজের উপার্জনে সন্তানকে বড় করে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি মারণ রোগে আক্রান্ত হয়ে ন্যাড়া মাথায় অফিস যেতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। যে মেয়েটি নিজেকে তিলতিল করে গড়ে তুলে প্রতি লহমায় সমাজ সংসারের কল্যাণে বিলিয়ে দিতে পারে, সে মা লক্ষ্মী। আর যে মেয়ে একা সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে, সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে দাঁতে দাঁত চেপে সৎভাবে লড়াই করতে পারে, সে মহালক্ষ্মী।
এই মেয়েদের সমাজে সহ্য করা কঠিন। আর কঠিন বলেই, সমাজ আজও লক্ষ্মীছাড়া। মা লক্ষ্মীর মত মেয়ে মানেই চোখে সমস্ত অপমান নির্বিবাদে মেনে নিয়ে চোখের জল লুকিয়ে লোকের মন জোগানো মেয়ে নয়। মা লক্ষ্মী মানেই এক গা গয়না এবং মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক মাটির পুতুলমাত্র নয়। মা লক্ষ্মী মানেই কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথা পেতে মেনে নেওয়া এক পরগাছা নয়। মা লক্ষ্মী মানেই মার খেয়ে রাতের বেলা চোখের জলে বালিশ ভেজানো নয়। সময় এসেছে, সমাজের মনোভাব পাল্টানোর। মা লক্ষ্মী যখন কুপিতা হন, তখনই তাঁর গাত্রবর্ণ কালো হয়ে তিনি মহাকালীতে রূপান্তরিতা হন। তখন সেই রূপ সমাজের কাছে অতীব ভয়প্রদ হয়ে ওঠে। বরাভয়প্রদায়িনী মা লক্ষ্মী তখন সংহারস্বরূপা। তখনই সমাজ সংসার রসাতলে যাওয়ার মত অবস্থা। তাঁর ক্রোধ তখন একমাত্র মহাকাল নিজের বুক পেতে শান্ত করেন। সেইজন্যই কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার পক্ষকাল পরেই মা মহাকালীর আরাধনায় রত হই সবাই।
আমরা বরং মা লক্ষ্মীকে চেনার চেষ্টা করি, শঙ্খ বাজিয়ে তাঁর আবাহন করি। তাঁর তুষ্টিবিধানের চেষ্টা করি। তাঁর তুষ্টি ধন বা বিবিধ অলংকারে নয়, তাঁর তুষ্টি তাঁর ধ্যানে, লক্ষ্মীরূপিণী মহিলাদের সম্মানে। তাঁর জন্যই তো এই পূর্ণিমা রাতে আমাদের রাত জাগা। তাঁর পূজাতেই তো আমাদের ভাঁড়ার পূর্ণ হয়ে উঠবে কানায় কানায়, তেজে, জ্ঞানে, ধৃতি ও ক্ষমায়, সর্বোপরি আত্মজ্ঞানে। আজকের দিনে সেই ত্রিগুণা মহালক্ষ্মীকে আমরা স্তব করি এই মন্ত্রে :
"শ্রীয়মুনিন্দ্রপদ্মাক্ষী বিষ্ণুবক্ষ স্থলস্থিতাম
বন্দে পদ্মমুখী দেবী পদ্মনাভপ্রিয়ম্যহম"
জয় মা লক্ষ্মী।
0 comments