পাঠ প্রতিক্রিয়া
কে বাজায় বাঁশি (দ্বিতীয় পর্ব)
বিনোদ ঘোষাল
মিত্র ও ঘোষ
মূল্য ৪০০টাকা
"তুমি আমাকে ভালোবাসো নার্গিস। আমি জানি বাসো,হয়তো আমার থেকেও বেশি। জানি না, আমাকে ভালোবেসে তুমি সব হারাবে কিনা কিন্তু আমিও তোমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারব না । এই তোমার করতল স্পর্শ করে আমি কথা দিচ্ছি,আমি তোমার কাছেই রইব। কোথাও যাব না।........কবিপ্রিয়ার চোখে বিরহ অশ্রু মানায় না।.. প্রস্তুত হও কবির সঙ্গে এই জীবনটুকু থাকবে বলে।"
ভালোবাসা, এক গভীর অনুভব, সেই অনুভব যদি থাকে কোনো প্রেমিক কবির তাহলে তা নিজগুনে এক অপার্থিব স্তরে পৌঁছে যায়। যার জন্য এত আকুল কবির হৃদয়, যার জন্য তিনি ছটফট করেছেন দিনের পর দিন, যাকে বিয়ে করতে তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, কী এমন হলো যে তাকে ফেলে , আর ফিরে না তাকিয়ে চলে গেলেন বিয়ের আসর ছেড়ে! একা নার্গিস, বিয়ের সাজে লাজুক নার্গিস, কবির প্রেমে থরথর নার্গিস, চোখের জলে ভিজে যাওয়া নার্গিস, প্রেমিকের হাত হারিয়ে ফেলা নিঃস্ব নার্গিস রয়ে গেলেন একা,হতবাক হয়ে। চোখের জলে ভিজে গেল সেই পথ যে পথে নজরুল চলে গেলেন সেই রাতে তাকে বিয়ে না করে। বলে গেলেন না, ফিরবেন কিনা । জানা হলো না কী অপরাধ তার মত অপাপবিদ্ধার, কেন এই শাস্তি, কার জন্য এই বিপর্যয় জানলো না নার্গিস। শুধু জানলো বিদ্রোহীকবি কথা রাখলেন না, তাকে নিজের করে নিলেন না । কিন্তু নজরুল তো কোনো আপোষের নাম নয়। বশ্যতা আর বিশ্বাসঘাতকতা এসবের ভেতরে তিনি নিজেকে, নিজের সম্মানকে বসিয়েছেন সর্বাগ্রে চিরকাল।
ADVERTISEMENT
নজরুল নার্গিসের প্রেম দিয়ে শেষ হয়েছিল সাহিত্যিক বিনোদ ঘোষালের কে বাজায় বাঁশির প্রথমপর্ব। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি পরের পর্বে সেই প্রেমের পরিণতি জানতে, বসে থেকেছি বিদ্রোহীকবির জীবনের বর্ণময় ঘটনা শুনতে।। কিন্তু দ্বিতীয়পর্বের শুরুতে নার্গিসকে ফেলে নজরুলের চলে যাওয়া বড় বেদনার মত বাজলো। প্রথম পর্বে কিশোর নজরুল, সৈনিক নজরুল, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া নজরুলকে দেখেছি। লেখকের লেখার সহজাত গুণে তিনি আমাদের আপন হয়ে উঠেছেন পাতার পর পাতায়।
দ্বিতীয় পর্বে নজরুল যেন এক লেলিহান আগুনের শিখা। কী তাঁর দীপ্তি, কী তাঁর তেজ। প্রাণবন্ত এক যুবক, কবি, গায়ক , প্রেমিক পুরুষ , পত্রিকার সারথি, অদম্যসাহসী এক তেজিয়ান মানুষ। তিনি নিজেই যেন ধূমকেতু। তাঁর জীবনের বাঁকে বাঁকে বিদ্রোহ, বাঁকে বাঁকে বিষ্ময়।সেনা ছাউনির বারুদের তীব্র ঝাঁঝালো পোড়া গন্ধ, দেশের জন্য ভালোবাসা,উদ্দাম প্রেম, আর একাকীত্ব তাঁর সঙ্গী। তাঁর জীবন যতটা বর্ণময় ততটাই বিবর্ণ। যে কবির কলমের ডগায় সরস্বতী বসে থেকেছেন, সেই কবির জিভ শুকিয়েছে, কথা ফুরিয়েছে, স্মৃতি হারিয়েছে। আর সেদিন এসে দাঁড়িয়েছে নার্গিস। কেন, কেন করলেন এই অন্যায় আমার সঙ্গে! চোখের জলে বুক ভেসেছে কবির। অনুতপ্ত প্রেমিক হৃদয়, জ্বলে পুড়ে খাক হওয়া প্রেম নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকেছেন সেই কবি, যে কবি অবলীলায় একদিন বলতে পেরেছিলেন,
"নার্গিস প্রিয়তমাসু তোমার হৃদয়ই আমার দেশ।"
ঘটনাস্রোত অভিমুখ বদল করেছে, এর মাঝে। বিশ্বকবির স্নেহধন্য হয়েছেন নজরুল, আলাপ হয়েছে শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে। ইতিহাস উঠে এসেছে উপন্যাসের পাতায়। এসেছে খিলাফৎ আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন , এসেছে চৌরিচোরার ঘটনা । বিদেশী পোশাক বর্জনে মেতে উঠেছে দেশ, দেশের মানুষ। সেই সব উন্মাদনা স্পর্শ করেছে নজরুলকে বারবার। তাঁর বন্ধুরা ঘিরে রেখেছেন তাঁকে, আগলে রেখেছেন শৈলজা, পবিত্র, মুজাফফর আহমেদ আজীবন।
ইংরেজ শাসন, লোহার গরাদ তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, হাসতে হাসতে কারাবরণ করতেও তিনি পিছপা হননি। তিনি এক দুর্দম ঝঞ্ঝা, তিনি এসে দাঁড়ালে তাঁর সম্মোহনী জাদুতে মানুষ বিহ্বল, মানুষ অভিভূত। কারণ নজরুল যে এক সময়ের নাম,এক উদাত্ত স্বরের নাম,এক সমুদ্রের নাম, এক তরঙ্গের নাম। সেই তরঙ্গ গিয়ে আঘাত করেছে সেই ইংরেজ শাসনের কঠিন প্রাচীরে। অসির থেকে মসির জোর যে চিরকাল বেশি তার প্রমান কবিতার ছত্রেছত্রে--
কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।
এই কবিতা শুধু শব্দ বর্ণ দিয়ে সাজানো নয়, এই কবিতা পরাধীন দেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলতে যথেষ্ট। চামড়ার নিচের শিরা ধমনীতে টগবগ করে ফোটে রক্তস্রোত আজও এই কবিতার উচ্চারণে।
তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় কেঁপে উঠেছিল তদানীন্তন সরকার। কবিতা লেখার অপরাধে(?) এক বছরের কারাবাস জোটে দুখুমিয়ার।
বল বীর -
চির - উন্নত মম শির!
আমি সন্ন্যাসী, সুর-সৈনিক,
আমি যুবরাজ, মম রাজবেশ ম্লান গৈরিক।
আমি বেদুঈন, আমি চেঙ্গিস,
আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্ণিশ!
যে কবিতা একরাতে শুধু একটা ভাঙা কাঠ পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলেন কবি সেই কবিতা ঝনঝন করে গিয়ে বাজলো ইংরেজ অচলায়তনের অলিন্দে।
বল বীর -
আমি চির উন্নত শির
চমকে গেল দেশবাসী, কেঁপে উঠল ইংরেজ-সরকার। এই হুঙ্কার, এই সাহস, এই স্পর্ধার নেপথ্যের নায়ককে বন্দী করতেই হবে। বন্দী করতে হবে কাজী নজরুল ইসলাম নামের এক ভারতবাসীকে কিন্তু তাঁর ভাবনা, তাঁর সৃষ্টি ,আর তাঁর সাহসকে তো বন্দী করা যায়না। কোনো কারাগার তাঁর সৃষ্টিকে, তাঁর সাহসকে শিকল পড়াতে পারেনি ।
আনন্দাদ্ব্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, এই যার অন্তর মন্ত্র, আনন্দে হৈহৈ করে থাকতে যিনি ভালোবাসেন, তাঁর কাছে একবছরের কারাবরণ তাঁর রোজের জীবনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারেনি। তাঁর কারাবরণের দৃশ্যটি লেখক সাজিয়েছেন এক বর্ণাঢ্য কথামেলায়।।
"বেলা সাড়ে দশটা। কুমিল্লার কান্দির পাড়ের পথে হাজার হাজার মানুষ। এতবড় মিছিল কুমিল্লার মানুষ আগে কখনও দেখেনি। মিছিলের সর্বাগ্রে নজরুল,পরণে ঘোড়সওয়ারের সামরিক পোশাক।গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে উদাত্ত কণ্ঠে গাইছেন ,
'বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান
তুমি কি এমন শক্তিমান!
আমাদের ভাঙাগড়া তোমার হাতে এমন অভিমান
তোমাদের এমনি অভিমান।'
জেলে গিয়ে দেখা হলো নরেন্দ্রনারায়ণ চক্রবর্তী, দেশবন্ধু , শিবরাম চক্রবর্তী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ,জিতেন্দ্রলাল বন্দ্যোপাধ্যায়,মুজিবর রহমান আরো অনেকের সঙ্গে। হয়ে গেলেন কারোর কাজীদা, কারোর কাজিমশাই। হৈহৈ করে রয়ে গেলেন জেলের ভেতর।
এরপর প্রেম এলো দুকূল ভাসিয়ে, সমর্পণ করলেন কবি এবার প্রমীলার কাছে। সেই স্বর্গীয়প্রেমের সুবাস ছড়িয়েছে আবার কে বাজায় বাঁশির সুরে সুরে, তালে তালে। দুলিকে ভালোবেসে ডেকেছেন দোলনা বলে,'তোমায় ভালোবাসি দোলনা, আমার দেশের মত ভালোবাসি তোমায়,কবিতার মত ভালোবাসি'।তার আশালতা নাম বদল করে রেখেছেন প্রমীলা,-
হে মোর রানী
তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে
আমার বিজয়-কেতন লুটায়
তোমার চরণ-তলে এসে।
প্রেম আর বিদ্রোহ নজরুল নামের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে বারবার।
আর আমরা পাঠকরা আর লেখক বুঁদ হয়ে থেকেছি তাঁর বাঁশিতে। তিনি এমন এক মানুষ যাঁকে ভালো না বেসে পারা যায় না। লেখক নিজের সর্বস্ব দিয়ে লিখেছেন এই উপন্যাস। তিনি মনে করেন নজরুলের ধর্ম মানবতা। তাঁর ধর্ম ভালোবাসা, তাঁর ধর্ম দেশভক্তি,তাঁর ধর্ম বিদ্রোহ, তাঁর ধর্ম বন্ধুত্ব।
আর তাই এই জীবন ভিত্তিক উপন্যাস পাঠকের হৃদয়ের কাছে পৌঁছেছে। বিদ্রোহের আগুনে লেখক যেন হাত পুড়িয়ে লিখেছেন এই উপন্যাস। আবার প্রেমের দৃশ্যপটে এমন মুহূর্ত রচনা করেছেন ,এমন আবেগ, এমন শব্দবন্ধ পাঠক চোখের পলক ফেলতে ভুলেছে লেখকের লেখার গুণে।
মিত্র ও ঘোষের প্রকাশনা নিয়ে কিছু বলার নেই, এত নিঁখুত, আর তেমনি সুন্দর বাঁধাই । এই প্রসঙ্গে শিল্পী ওঙ্কার নাথ ভট্টাচার্যের প্রচ্ছদের কথা না বললেই নয়। বিদ্রোহের আগুন আর পরাধীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে কাজী নজরুলের ছবি । বিদ্রোহের রং
লাল, প্রেমের রং লাল আর কে বাজায় বাঁশির দ্বিতীয় পর্ব জুড়ে এই দুটোই তো উপজীব্য। তাই প্রচ্ছদের আকর্ষনীয় রং মনমুগ্ধকর।
পরবর্তী তৃতীয় পর্বের জন্য আগাম শুভেচ্ছা লেখক বিনোদ ঘোষালকে।
0 comments