স্বামীজীর সম্পর্কে কি বলেছিলেন কবিগুরু?

স্বামীজীর সম্পর্কে কি বলেছিলেন কবিগুরু?

মনীষী রোমা রোলাঁ (Roma Rola) যখন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-চরিতের উপাদান সংগ্রহ করছিলেন, তখন শান্তিনিকেতনে একদিন এক সন্ন্যাসীর কাছে এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ (Rabindranath Tagore) বলেছিলেন, "রোমা রোলাঁর সহিত আমার কথা হয়েছিল, আমি তাঁকে বলেছিলাম - If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative, everything positive." ['উদ্বোধন' পত্রিকা, ৪৩শ বর্ষ, ৮ম সংখ্যা - ভাদ্র, ১৩৪৮- প্রকাশিত 'কবি-সম্রাট রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণ' নামে একটি লেখা থেকে জানা যায়]
 

ADVERTISEMENT

রোলাঁও লিখেছেন - "I cannot touch these sayings of his, scattered as they are through the pages of books at thirty years’ distance, without receiving a thrill through my body like an electric shock. And what shocks, what transports must have been produced when in burning words they issued from the lips of the hero!"
 

অন্যদিকে অমিতাভ চৌধুরীর লেখা 'কবি সন্ন্যাসী' থেকে জানা যায়, "জাপানী মনীষী ওকাকুরা এসেছিলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে, ভারতবর্ষকে জানতে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ভারতবর্ষকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন; - “If you want to know India, study Vivekananda. There is in him, everything positive, nothing negative.'"
 

রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ দুজন দু পথের পথিক দুই বিশ্ব বিখ্যাত বাঙ্গালী মনীষা একই জায়গায়, একই সময়ে তাঁদের বিচরন অথচ একান্ত ভাবে মিল হয়নি উভয়ের, কেউ কাউকে দিয়ে অনুপ্রাণিত হননি কোনদিন এক বিরল এবং বিস্ময়কর ঘটনা তারপরও বিবেকানন্দের মতাদর্শের প্রতি তাঁর বিরূপতার কোন নজির নেই মাত্র দু-বছরের ছোট বিবেকানন্দকে রবীন্দ্রনাথ কিন্তু একটু আলাদারকমই শ্রদ্ধা করতেন

যাই হোক, আবার গোড়ার কথায় ফিরে আসি কথা হচ্ছে – If you want to know India, then what? ভারতবর্ষকে বিদেশীরা কীভাবে চিনবেন? সে সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথের মতামত কী? সেটা সরাসরি দেখা যাক দিলীপকুমার রায় তাঁর 'স্মৃতিচারণ' বইয়ে লিখেছেন -

আত্মমর্যাদার কথা বলতে একদিনের কথা মনে 'ড়ে গেল আমি সেদিন তাঁর ওখানে সাউথ কেনসিংটনে 'সে তাঁর সঙ্গে গল্প করছি এমন সময়ে কয়েকটি ভারতীয় ছেলে এল দরবার করতে কী, না জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজার বারোশো নিরস্ত্র নরনারী জেনারেল ডায়ারের গুলিতে মরেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভায় তাঁকে সভাপতি 'তে হবে রবীন্দ্রনাথের গৌর আনন লাল হয়ে উঠল বিরক্তিতে তিনি উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেনঃ "তোমাদের কি লজ্জা করে না একটুও? জালিয়ানওয়ালাবাগে আমরা পশুর মত মার খেয়েছি - হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে অনেকে প্রাণ বাঁচিয়েছিল - এই কথা এখানে হাটে-বাজারে প্রচার করতে চাও? - আমাদের চরম অপমানের কথা ঘোষণা করবে বড় গলা করে?...যাও তোমরা দেশের গ্লানি ঢাক পিটিয়ে প্রচার করতেই যদি কোমর বেঁধে থাকো তবে সে ঢাকীদের মধ্যে আমাকে ভর্তি করবার মিথ্যে চেষ্টা কোরো না

কবির ক্রুদ্ধ রাঙা মুখ আজও মনে পড়ে ... ওরা 'লে যাবার পরে আমাকে বললেনঃ "দিলীপ, পেট্রিয়ট 'লে কি জাঁক 'রে বোকা বনতেই হবে? আমরা -স্বাধীন দেশে এসেও কি আমাদের জাতীয় অগৌরব লজ্জা হীনতা ভীরুতা প্রচার 'রে এদের আদর কাড়তে ছুটব? ... এখানে এসে যদি ভারতের কথা বলতে হয় তবে আমরা যেন কেবল সেই সেই গুণ, সেই সেই সম্পদ, সেই সেই সাধনার কথাই বলি যাদের দৌলতে ভারত বড় হয়েছিল - যেমন বিবেকানন্দ বলেছিলেন তাই তো তিনি এদের শ্রদ্ধাও পেয়েছিলেন তিনি এদের এসে ডাক দিয়েছিলেন 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত' 'লে- কাঁদুনি গান নি আমাদের হাজারো দুর্দশার কথা জানিয়ে .. আমেরিকানদের সামনে এসে তিনি মাথা উঁচু 'রেই বলেছিলেন ভারতের ধর্মতত্ত্বের কথা - যদি কেঁদে ভাসাতেন 'দুটি ভিক্ষে দাও গো' 'লে, তাহ'লে না পেতেন ভিক্ষা, না সমাদর"
 

আরও পড়ুন : মূর্তিপূজায় প্রবল অবিশ্বাসী নরেন্দ্রনাথের কালীভক্ত বিবেকানন্দ হয়ে ওঠার কাহিনী
 

তবে থেকে মনে হয় বিদেশীদের কাছে ভারতবর্ষের কোন পরিচয় তুলে ধরতে হবে, সে বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের যা আদর্শ, তাকে তিনি বিবেকানন্দের মধ্যেই মূর্ত হতে দেখেছিলেন কাজেই বিদেশীদের সঙ্গে ভারতের পরিচয় ঘটাতে হলে ভারতবর্ষের ব্যাখ্যাতা হিসেবে বিবেকানন্দের নাম করা রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তেমন অসম্ভব কিছু নয়
 

অন্যদিকে কেউ কেউ রোমা রোলাঁর ভারতবর্ষীয় দিনপঞ্জী থেকে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করতে চান রবীন্দ্রনাথ কালীপূজাকে ঘৃণা করতেন এবং বিবেকানন্দ কালীপূজক, অতএব রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দকে সহ্য করতে পারতেন না মজার ব্যাপার হল দীর্ঘ উদ্ধৃতিতে রবীন্দনাথের কালীপূজার প্রতি ঘৃণার প্রকাশ যথেষ্টই আছে বটে, কিন্তু তিনি এখানে বিবেকানন্দের নাম করেননি, রোলাঁই সিদ্ধান্ত করেছেন - 'এটা স্পষ্টই বোঝা গেল, তাঁর চোখের সামনে এই মুহূর্তে আছেন বিবেকানন্দ' অথচ এই কথোপকথনের আরেকটা অংশ পাচ্ছি অ্যালেক্স অ্যারনসন কৃষ্ণ কৃপালনি সম্পাদিত 'রোলাঁ অ্যান্ড টেগোর' বইতে যেখানে সরাসরি রোলাঁর বিবেকানন্দ-বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ জানাচ্ছেন - "আমি যতদূর বুঝেছি, বিবেকানন্দের মনোভাব ছিল - জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলিকে আমাদের স্বীকার করতে হবে ...আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার এমন ঊর্ধ্বস্তরে আমাদের উন্নীত হতে হবে যেখানে ভালো বা মন্দ কিছুই নেই বিবেকানন্দ ভাল বা মন্দের ঊর্ধ্বে উঠবার চেষ্টা করেছিলেন বলে তিনি এমন অনেক ধর্মীয় রীতি-নীতিকে সহ্য করতে পেরেছিলেন যেগুলিতে বস্তুতঃ কোনোই আধ্যাত্মিকতা নেই"
 

দেখা যাচ্ছে বিবেকানন্দের সঙ্গে একমত না হলেও কালীপূজা সম্পর্কে কবির বিরুদ্ধতার ঝাঁজের ছিটেফোঁটাও এখানে অনুপস্থিত মনে হয় কালীপূজার বিরুদ্ধে নিজের রুচিগত আপত্তি সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ তাকে অতিক্রম করে বিবেকানন্দের মূল্যায়নে সচেষ্ট ছিলেন আর সেটা অস্বাভাবিকও নয় কে কালীপূজা করে আর করে না - তাই দিয়ে পৃথিবীর লোককে আমরা-ওরার বাইনারিতে ভেঙে চটজলদি মূল্যায়ন সেরে ফেলবেন - রবীন্দ্রনাথের মত মানুষের চরিত্র এই মাপে ছেঁটে ফেলাটা যথেষ্ট কষ্টকল্পনা নইলে একজন কালীপূজকের প্রয়াণে ভবানীপুর সাবার্বান স্কুলের হলে অনুষ্ঠিত শোকসভায় রবীন্দ্রনাথ সভাপতিত্ব করতে যাবেনই বা কেন? সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এই সভার উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁর 'রবীন্দ্র-স্মৃতি' বইয়ে তিনি জানাচ্ছেন - "এই সময়ে বিবেকানন্দ স্বামী পরলোকগমন করেন Excelsior Union থেকে আমরা করলুম শোকসভার আয়োজন স্থির হলো, সে-সভায় স্বামীজির সম্বন্ধে প্রবন্ধ পড়বেন ভগ্নী নিবেদিতা এবং সভাপতিত্ব করবার জন্য আমি এবং মণিলাল (গঙ্গোপাধ্যায়) এবং আমি গেলুম রবীন্দ্রনাথের কাছে; তাঁকে ধরলুম - সভাপতি হতে হবে তিনি সম্মত হলেন " আবার ১৯০৫ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর মাত্র ষোল দিনের মধ্যেই বিবেকানন্দের জন্মোৎসবে তিনি বেলুড় মঠে যাচ্ছেন রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা কালীপূজক জেনেও তাঁদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক
 

গেল কালীপূজা সম্পর্কে নিজস্ব বিরূপতাকে অতিক্রম করে ব্যক্তি বিবেকানন্দ সম্পর্কে কবির অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গির কথা ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের ভূমিকা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ কী ভাবতেন? যে সময়ের কথা, তখন ভারতীয় রাজনীতির এক নম্বর চরিত্র বলতে গান্ধীজি ১৯২৮ সালের ৯ই এপ্রিল সরসীলাল সরকারকে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সেই গান্ধীজীর চরকা কাটার নির্দেশের পাশে বিবেকানন্দের ভূমিকার একরকম তুলনাই করেছিলেন - "বস্তুত চরকা কাটো, কথার মধ্যে কোনো মহৎ অনুশাসন নেই এইজন্যে কথায় পূর্ণভাবে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন ঘটায় না আধুনিককালের ভারতবর্ষে বিবেকানন্দই একটি মহৎ বাণী প্রচার করেছিলেন, সেটি কোনো আচারগত নয় তিনি দেশের সকলকে ডেকে বলেছিলেন, তোমাদের সকলের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি - দরিদ্রের মধ্যে দেবতা তোমাদের সেবা চান এই কথাটা যুবকদের চিত্তকে সমগ্রভাবে জাগিয়েছে তাই এই বাণীর ফল দেশের সেবায় আজ বিচিত্রভাবে বিচিত্র ত্যাগে ফলছে তাঁর বাণী মানুষকে যখনি সম্মান দিয়েছে তখনি শক্তি দিয়েছে সেই শক্তির পথ কেবল একঝোঁকা নয়, তা কোনো দৈহিক প্রক্রিয়া পুনরাবৃত্তির মধ্যে পর্যবসিত নয়, তা মানুষের প্রাণমনকে বিচিত্রভাবে প্রাণবান করেছে বাংলাদেশের যুবকদের মধ্যে যেসব দুঃসাহসিক অধ্যবসায়ের পরিচয় পাই তার মূলে আছে বিবেকানন্দের সেই বাণী যা মানুষের আত্মাকে ডেকেছে, আঙুলকে নয়"


আরও পড়ুন :
জাদুকর ও তাঁর জাদুদণ্ড - শ্রী রামকৃষ্ণ দেব ও তাঁর চারজন গুণমুগ্ধ ভক্তের কাহিনী
 

এবার কল্পনা করুন সেই দৃশ্য, সঙ্গীতের মহড়া চলছে রবীন্দ্রনাথ বাজাচ্ছেন অর্গান, আর নরেন্দ্রনাথ বাজাচ্ছেন পাখোয়াজ সময়টা ১৮৮১ রাজনারায়ণ বসুর কন্যা লীলাবতীর বিবাহ পাত্র কৃষ্ণকুমার মিত্র রাজনারায়ণ বসুর অনুরোধে এই বিবাহ উৎসবের জন্য রবীন্দ্রনাথ তিনটে গান রচনা করে নিয়ে এসেছেন,  – ‘দুই হৃদয়ের নদী’, ‘জগতের পুরোহিত তুমিএবংশুভদিনে এসেছে দোঁহে’, আর সংগীতে যোগ দেওয়ার জন্য আহ্বান জানান নরেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ নিজে নরেন্দ্রনাথকে শেখাচ্ছেন সেই গান আর সুন্দরী মোহন দাস, নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, অন্ধ চূণীলাল সবার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ নরেন্দ্রনাথ গলা মিলিয়ে সে গান গাইছেন উদাত্ত কন্ঠে,-

 দুই হৃদয়ের নদী একত্র মিলিল যদি

          বলো, দেব, কার পানে আগ্রহে ছুটিয়া যায়
 

পরবর্তীকালের বিশ্বপথিক দুই মহাপুরুষ সেদিন সঙ্গীতের ছন্দে ঘনিষ্ট ভাবে একসূত্রে গ্রথিত হয়েছিল দুই হৃদয়ের নদী একত্রে মিলিত হতে চেয়েছিলএক চায় একেরে পাইতে দুই চায় এক হইবারে এক হওয়ার জন্য দুজনে চাইলে কী হবেপরবর্তীকালের ইতিহাস কিন্তু অন্যরকমদুজনের জীবনের মোড় নিল দুদিকেদুই হৃদয়ের নদী একসঙ্গে গিয়ে সাগরে পড়লনা দুজনের উৎস একই, - সেই গঙ্গোত্রি; মোহনা একই সেইবঙ্গোপসাগর অথচ গতিপথ রইল পৃথক, মোহনার মুখ রইল পৃথক, অশান্ত অশ্রান্ত দুদিকে ছুটে মিলল গিয়ে একই শান্তির পারাবারে তবু পদ্মা রইল পদ্মা, গঙ্গা রইল গঙ্গা
 

দুজনেই প্রায় সমবয়সী মাত্র দেড়-বছরের ব্যবধান একজনের জন্ম ১৮৬১ সালের মে মাসে অন্য জনের ১৮৬৩ সালের জানুয়ারিতে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সমবয়সী ভ্রাতস্পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথের পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের সহপাঠি বন্ধু সেই সূত্রে নরেন্দ্রনাথের নিয়মিত যাতায়াত ঠাকুর বাড়িতে দ্বিপেন্দ্রনাথের আসরে নরেন্দ্রনাথ আসেন নানা বিষয়ে আলোচনা গল্প করতে তিনি এলেইকী হে নরেনবলে দ্বিপুবাবু তাঁকে সাদর আহ্বান জানান দুই বন্ধুতে বড় মধুর সম্পর্ক
 

জোড়াসাঁকোর বাড়িতে যাতায়াতের সময়ই নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় শুধু ভ্রাতস্পুত্রের বন্ধু হিসাবে নয়, একজন উৎসাহী ব্রাহ্ম সুকন্ঠ সঙ্গীতবিদ হিসাবে নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসেন পরবর্তীকালের দুই শ্রেষ্ট বাঙালির মধ্যে প্রথম পরিচয় কিভাবে হয়েছিল তার কোনও প্রামাণিক বিবরণ কোথাও নেই তবে একথা নানা সূত্রে জানা যায়, নরেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন পারদর্শী গায়ক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তাঁর যৌবনের সূচনাতেই ব্রাহ্ম সমাজের বিভিন্ন উপাসনায় তিনি নিয়মিত ব্রহ্ম সঙ্গীত গেয়ে সকলকে মুগ্ধ করেছিলেন তাঁর প্রিয় গানগুলি ছিল, - সখি আমারি দুয়ারে কেন, মরি লো মরি আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে, তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা, দিবানিশি করিয়া যতন হৃদয়েতে রচেছি আসন, মহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিত, আজ বহিছে বসন্ত পবন, তাহারে আরতি করে চন্দ্র তপন
 

স্বামী বিবেকানন্দ হয়ে যাওয়ার পরও রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর কন্ঠে ধরা ছিল এমনকি ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবকেও নানা সময়ে তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছেন বাগবাজারে বলরাম বসুর বাড়িতে ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে ১৪ জুলাই শোনানতোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা
 

আর রবীন্দ্রনাথ? স্বামীজী যতদিন জীবিত ছিলেন, নিন্দা বা প্রশংসা কোথাও কোনও লিখিত উক্তি করেননি বিবেকানন্দ সম্পর্কে করে থাকলেও তার কোনও রেকর্ড নেই বিশাল কর্মময় জীবন স্বামীজীর তাঁর অভীমন্ত্রে সারা বিশ্ব তোলপাড়, পরাধীন ভারত নব আশায় বলীয়ান, আসমুদ্র হিমাচলের সর্বত্র স্বামী বিবেকানন্দ নামটি মন্ত্রের মত কাজ করছে, আমেরিকা জয়ের পরে কলকাতা শহরে প্রবল উত্তেজনা, কিন্তু সর্ব বিষয়ে সদা জাগ্রত রবীন্দ্রনাথ এই ব্যাপারে যেন তেমন আগ্রহী নন তাঁর কলম দিয়ে অজস্র রচনা অনর্গল উৎসারিত হচ্ছে, সভা সমিতি অনুষ্ঠানে তিনি একজন প্রখর বক্তা, তবু সমসাময়িক কোনও রচনা বা বক্তৃতায় বিবেকানন্দের নাম সম্পুর্ণ অনুচ্চারিত তিনি যা কিছু বলেছেন বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণের পর
 

স্বামীজী দেহ রক্ষা করেন ১৯০২ সালে তাঁর প্রয়াণের পর কলকাতায় একটি শোক সভা হয় ভবানীপুরে ১৯০২ সালের ১২ জুলাই সভায় বক্তৃতা দেন ভগিনী নিবেদিতা; আনন্দচরণ মিত্র প্রমূখ এবং সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ তিনি বাংলায় স্বামীজীর জীবন বাণী সম্পর্কে একটি দীর্ঘ ভাষণ দেন আক্ষেপের বিষয়, তাঁর এই মুল্যবান বক্তৃতার বিস্তারিত বিবরণ আজও জানা যায়নি তবে ১৯০২ সালের ১৫ জুলাইবেঙ্গলিদৈনিকে এই সভার একটি বিবরণ বেরিয়েছিল সংবাদদাতা লেখেন, -

“On Saturday (12 July 1902) last the Excelsior Union of Bhawanipur held a meeting to do honour to the memory of the Late Swami Vivekananda. There was a larger gathering of the student of the locality in the specious hall of the south suburban school, and Babu Rabindranath Tagore presided.
 

সংবাদদাতা লেখেন, রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দকে শাশ্বত ভারতের চিরস্মরণীয় মহাপুরুষদের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে নানাভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন ১৯০৮ সালে স্বামীজী সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ এক সভায় বলেন, অল্পদিন পূর্বে বাংলাদেশে যে-মহাত্মার মৃত্যু হইয়াছে, সেই বিবেকানন্দও পূর্ব পশ্চিমকে দক্ষিণে বামে রাখিয়া মাঝখানে দাড়াইতে পারিয়াছিলেন ভারতবর্ষের ইতিহাসের মধ্যে পাশ্চাত্যকে অস্বীকার করিয়া ভারতবর্ষকে সংকীর্ণ সংস্কারের মধ্যে চিরকালের জন্য সংকুচিত করা তাহার জীবনের উপদেশ নহে গ্রহণ করিবার, মিলন করিবার, স্বজন করিবার প্রতিভাই তাহার ছিল তিনি ভারতবর্ষের সাধনাকে পশ্চিমে পশ্চিমের সাধনাকে ভারতবর্ষে দিবার লইবার পথ রচনার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করিয়াছিলেন 
 

স্বামী অশোকানন্দকে লিখিত এক পত্রে বিবেকানন্দ সম্পর্কে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে বিবেকানন্দ বলেছিলেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ব্রহ্মের শক্তি; বলেছিলেন দরিদ্রের মধ্যে দিয়ে নারায়ণ আমাদের সেবা পেতে চান কে বলি বাণী এই বাণী স্বার্থবোধের সীমার বাইরে মানুষের আত্মবোধকে অসীম মুক্তির পথ দেখালে এতে কোনো বিশেষ আচারের উপদেশ নয়, ব্যাবহারিক সঙ্কীর্ণ অনুশাসন নয়
 

রবীন্দ্রনাথ স্বামীজির বাংলা রচনারও গুণগ্রাহী ছিলেন, তার প্রমাণও আছে স্বামীজির প্রায় সবকটি বই তিনি মন দিয়ে পড়েছিলেন শুধু চিন্তাধারার জন্য নয়, তাঁর প্রাঞ্জল গদ্য রীতিও রবীন্দ্রনাথকে আকৃষ্ট করেছিল বিশেষ করেপরিব্রাজকএবংপ্রাচ্য পাশ্চাত্য ডঃ দীনেশচন্দ্র সেনকে তিনি বইগুলির গুণের কথা অনেকবার উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ দীনেশ সেন মশায়কেপ্রাচ্য পাশ্চাত্যসম্পর্কে এক চিঠিতে লেখেন, আপনি এখনি গিয়ে বিবেকানন্দের এই বইখানি পড়বেন চলিত বাংলাকে কেমন জীবন্ত প্রাণময় রূপে প্রকাশিত হতে পারে, তা পড়লে বুঝবেন যেমন ভাব তেমনি ভাষা, তেমনি সূক্ষ্ম উদার দৃষ্টি আর পুর্ব পশ্চিমের সমন্বয়ের আদর্শ দেখে অবাক হতে হয় (উদ্বোধন সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যা ১৩৫৪ মাঘ) প্রসঙ্গত স্মরণীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সর্বপ্রথম বিশ্বভারতীতেই রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে বিবেকানন্দেরপ্রাচ্য পাশ্চাত্যপাঠ্যগ্রন্থ হিসাবে গৃহীত হয়
 

১৯১৩ তে এই একমাত্র বাঙালি যখন নোবেল পান, তার এক দশক আগেই বিবেকানন্দ প্রয়াত যদি তিনি সে সময় বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়ত দৃশ্যপট পাল্টে যেত হয়তো বিবেকানন্দ অভিনন্দিত করতেন কবিকে কবির লেখা তার প্রিয় গানমহা সিংহাসনে বসি শুনিছ হে বিশ্বপিতগানটি হয়ত গেয়ে শুনাতেন বা শুনতে চাইতেন একজন জীবে দয়ার মাঝে প্রথাগত ইশ্বর কে পেয়েছিলেন, অন্যজন নতুন ইশ্বরের সন্ধানেমানুষের ধর্মপ্রতিষ্টায় নিজেকে সমর্পণ করেন আমৃত্যু দুজনেই স্ব স্ব জায়গায় ছিলেন অনড়
 

ঋণঃ রবীন্দ্র রচনাবলী। স্বামী বিবেকানন্দর বাণী রচনা। খেরোর খাতা – চিরন্তন কুণ্ডু। একত্রে রবীন্দ্রনাথঅমিতাভ চৌধুরি 'রবীন্দ্রসূত্রে বিদেশিরা' সমীরসেনগুপ্ত

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait