স্বামীজী বলতেন, “প্রত্যেক নারীই জগন্মাতার প্রতিমূর্তি | তাঁর গুরুদেব একবার এক বারবনিতাকে পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলেছিলেন, “মা তুমি একরূপে জগৎ -প্রপঞ্চহয়েছ, আর একরূপে তুমিই এখানে দাঁড়িয়ে আছ|” তিনি আরও বলতেন, ‘আমার আনন্দময়ী মা ই সব হয়েছেন ।’ স্বামীজী বলতেন, ‘এই মাতৃজাতির অবমাননার ফলেই ভারতবাসী পশুতে পরিণত হয়েছে | এ জাতির অভ্যুথান সম্ভব হবে যখন আবার নারী জাতির অভ্যুত্থান ঘটবে | ‘
সমাজের পশুত্ব এখন আমরা প্রতিনিয়ত দেখি । আমরা মহিলারা , ‘মেয়েছেলে’ ডাকটি রাস্তাঘাটে শুনে অভ্যস্ত । গা রিরি করে জ্বলে ওঠে যখন এই সম্বোধন শুনি । তথাকথিত শিক্ষিত লোকেরাও বলেন কথাটি । অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে আজ গালাগাল এর বিভেদ ঘুচে গেছে । যে গালাগাল গুলো অবলীলায় গুন্ডাদের মুখে ফুটে ওঠে আজ ভদ্রবেশী ছেলে মেয়েরা রাস্তায় ওই গালি দিয়ে একে অপরকে ডাকছে । এরপর আসুন পাড়ার মোড়গুলোতে । সেখানে সদাসর্বদা পাড়ার বৌ মেয়েরা কি পরল কি খেলো কার সাথে ঘুরতে বেরোলো এইসব চর্চা হচ্ছে । যে ভারতবর্ষ গার্গী মৈত্রেয়ি খনার জ্ঞান এর জন্য প্রসিদ্ধ , যে ভারতবর্ষ সীতা সাবিত্রী সারদা মায়ের দয়া ও সহিষ্ণুতার জন্য চিত্রিত , সেখানে মেয়েরা স্কূল কলেজ ‘এ’ বাড়ি ‘ও’ বাড়ি ‘সে’ বাড়ি অফিস সর্বত্রই লাঞ্ছনার জন্য চিন্হিত । মেয়েরা তা সে যত গুনীই হোন না কেন দিনের শেষে সবাই প্রস্তুত এক ঝুড়ি প্রশ্ন নিয়ে । ‘সারাদিন কি করেছ ,কোথায় ছিলে ,কার কার সাথে আজ সারাদিন কথা হল ‘ ইত্যাদি কত আর বলব ?? এর সাথে আজকাল যুক্ত হয়েছে সোশাল মিডিয়া তে মহিলাদের তির্যক কুত্সিত আক্রমণ । জঘন্য নোংরা ভাষায় সবাই সবাইকে আক্রমণ করে চলেছে । যেন বহুদিনের অবদমিত রাগ কুত্সিত দানবীয় রূপ নিয়ে লেখার অক্ষরে ফেটে পড়ছে । এ অভিজ্ঞতা কমবেশি সকলেরই ।
ADVERTISEMENT
অথচ এই ভারতবর্ষেই পুরান এ দেখা যায় হলাহল পান করে মহাদেব ‘মা’ ‘মা’ করে দেবী দুর্গার ক্রোড়ে আশ্রয় নেন । এখানেই সমস্ত দেবতারা একত্রিত হয়ে এক নবযৌবনপ্রাপ্ত সাধারণ মেয়েকে দেবীত্বে উন্নীত করে তাঁর কাছে প্রার্থনা করেন অসুরবিজয় যাত্রায় যাওয়ার জন্য । এই মাটিতেই জন্ম নেন মা সাবিত্রী যাঁর অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় প্রসন্ন হয়ে যমরাজ ফিরিয়ে দেন তাঁর স্বামীর প্রাণ । এখানেই ঠাকুর তাঁর স্ত্রী কে মাতৃজ্ঞানে পূজা করে মহিমান্বিত করে দেন । এখানেই সতীদাহ প্রথা রদ করার জন্য রাস্তায় মার খেতেও কুণ্ঠিত হন না রাজা রামমোহন । এখানেই আগুন জ্বলে ওঠে বিদ্যাসাগরের কলমে ,তিনি নারীশিক্ষার জন্য জীবন দিয়ে দেন। এই মাটিরই সন্তান স্বামীজী তাঁর বিদেশীনি পাণিপ্রার্থী সুন্দরী বিদূষী কন্যাকে বলে ওঠেন, ‘জগতের সব নারীকে আমি মাতৃজ্ঞানে দেখি ‘। এই মহাভারত এ বারংবার বিদেশিনীরা এসে হয়ে ওঠেন ভারতকন্যা ।
পুরুষ ও নারী একে অপরকে মহিমান্বিত করেছে বারবার ।। কিন্তু আজকাল স্রোত খুব চোরা দিকে বইছে । দিকে দিকে নৈরাজ্য , দিকে দিকে অশিক্ষা । এ কাদের দোষ ?? হ্যাঁ আমাদেরই । আমরাই ধ্বংস করছি নিজেদের প্রতিনিয়ত । বাঙ্গালী বা ভারতীয় হিসাবে গর্ব করার আজ আর কিছুই নেই । সব শেষ হয়ে গেছে । একটা জাতির পতন তখনই চিন্হিত হয় যখন সে তার গর্বের সবকিছু নমুনা কে নিজেই ধ্বংস করে ফেলে । কে করে কেন করে তর্কের বিষয় । কিন্তু যখন স্বার্থসিদ্ধির জন্য রাস্তায় নামে তখনই ভয়ের ব্যাপার ।
বিদ্যাসাগর মহাশয়ও আজ ভূলুণ্ঠিত ।। নারীদের এই অপমান বোধহয় তাঁর ও সহ্যের বাইরে চলে গেছে । আমাদের সব কিছু ভূলুণ্ঠিত । দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ হয়েছিল ভরা সভায় ,কর্ণ তাতে ইন্ধন যুগিয়েছিলেন । তিনি কিন্ত মহাবীর ছিলেন । পঞ্চপাণ্ডব সহ্য করেছিলেন স্ত্রীর এই লাঞ্ছনা । শুধু ভগবান শ্রী কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তাঁকে আজ বড় দরকার সমাজের এই দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণকে শাস্তি দেয়ার জন্য ।একমাত্র তিনিই পারেন এই পচে যাওয়া সময় ও সমাজ টার মুখে নির্মম পদাঘাত করতে ।নাহলে আজ মা সীতার মত আমাদেরও আজ বলতে হবে ,’হে ধরণী দ্বিধা হও। আমার সবটুকু অস্তিত্ব নিয়ে তোমার গর্ভে আশ্রয় দাও ‘।। আমাদের যে আজ আর কিছু নেই কেউ নেই !!!
2 comments