করোনা পরিস্থিতিতে মা দুর্গার মর্ত্যে গমনাগমন

করোনা পরিস্থিতিতে মা দুর্গার মর্ত্যে গমনাগমন

দেবী দুর্গার মর্ত্যে আগমন ঠেকানো করোনাসুরের পক্ষে সম্ভব নয়তা ছাড়া, করোনাসুর মানুষের দুর্গতির কারণআর দুর্গা তো দুর্গতিনাশিনীতাই অশুভ শক্তি করোনাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য দেবী দুর্গার মর্ত্যে শুভ আগমন হোক যাতে বিশ্ববাসী এই ভয়ংকর মহামারী কাটিয়ে উঠতে পারে

ADVERTISEMENT

এমতাবস্থায় মর্ত্যে করোনাসুরের তান্ডব চলাকালীন দেবী দুর্গার বাপের বাড়ি আসা স্বামীগৃহে ফেরত যাওয়াও তো কম ঝঞ্ঝাটের কথা নয়সেই সব চিন্তা করে শরৎকালের নিশিশেষে গিরিরাজ পত্নী মেনকা কন্যাকে স্বপ্নে দেখে উৎকন্ঠিত হয়ে স্বামীকে ডেকে বলেন, –

আমি কি হেরিলাম নিশি-স্বপনে!
গিরিরাজ, অচেতন কত না ঘুমাও হে!
এই এখনি শিয়রে ছিল,

গৌরী আমার কোথা গেল হে,
স্বামীর ঔদাসীন্য দেখে মেনকার অভিমান আরও বৃদ্ধি পায়সেই আশঙ্কায় তিনি স্বামীকে বলেন, -

যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী
উমা না কি বড় কেঁদেছে
দেখেছি স্বপন নারদ বচন
উমা মা মা বলে কেঁদেছে৷

হিমালয়-পত্নী মেনকার মন মেয়ের জন্য ছটফট করছেতিনি হিমালয়কে বারে বারে অনুরোধ করছেন, মেয়ে উমাকে কৈলাশ থেকে নিয়ে আসার জন্যেহিমালয় আজ নয় কাল করে করে মেনকাকে ভুলিয়ে রেখেছেনএদিকে মলমাসের জন্য পঁয়ত্রিশ দিন দেরি হয়ে গেছেমা মেয়েকে স্বপ্নে দেখেছেন উমামা মাবলে কেঁদেছে মায়ের কাছে আসবে বলেযশোদার গোপালের বিরহে, কৌশল্যা রামের বিরহে যেমন, ঠিক একই অবস্থা হয়েছে মেনকারসেই এক ভাবেই মেনকার অনুরোধ হিমালয়কেউমাকে নিয়ে আসার জন্য করুণ মিনতি, অনুযোগউমার মাহাত্ম্য, জগজ্জননীর মাহাত্ম্য কি মেনকা জানেন না? জানেনমায়ের কাছে সন্তান সন্তানইআর উমা, সে তো অন্নপূর্ণাঅন্নদায়িনীকখনও অসুরদলনে, দুঃখ-দুর্গতি নাশেতাই উমার অর্থাৎ দুর্গার পূজা দেব-মানবের অবশ্য করণীয়দুর্গাপূজায় লাভ ভোগ মুক্তিযে যা চায় সে তাই পায় (স্বর্গাপবর্গদে দেবি নারায়ণি নমোহস্তুতে)রাবণ বিনাশে অকাল বোধনে দুর্গাপূজা করেছিলেন স্বয়ং রামচন্দ্রকুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন দুর্গার স্তব করতে যুদ্ধ জয়ের জন্যআর ভাগবতে যোগমায়া দেবী দুর্গার আবির্ভাব তাঁর পূজার কথা বলে দিয়েছেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণুদুর্গতিনাশিনী দুর্গা আরাধনায় তুষ্ট হয়ে সাধককে কাম-ক্রোধ-লোভের নরকের দরজা থেকে মুক্ত করে দেনঅধর্মের প্রকাশদম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, খারাপ ব্যবহারএগুলিকে গীতায় আসুরিক ভাবের প্রকাশ বলে বলা হয়েছেদুর্গাপূজায় সিদ্ধ হলে সাধক মায়ের কৃপায় দৈবী সম্পদে অর্থাৎ অভিমানশূন্যতা, নিরহঙ্কারিতা, অহিংসা প্রভৃতি গুণে ভূষিত হন মহামায়ার প্রভাব থেকে মানুষ সহজে মুক্ত হতে পারে নাকেবল তাঁর শরণাগত হলে সংসারের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যায় কথাই চণ্ডীতে বলা হয়েছেগীতায়ও এরকম শরণাগতির কথা বলা হয়েছে

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া

মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।

অর্থাৎ আমার এই দৈবী মায়া ত্রিগুণাত্মিকা এবং তা দুরতিক্রমণীয়াকিন্তু যাঁরা আমাতে প্রপত্তি করেন, তাঁরাই এই মায়া উত্তীর্ণ হতে পারেন

যাইহোক, কৈলাস থেকে সন্তানকে নিয়ে মা তো আর হেঁটে আসবেন না পিতৃগৃহেতাই যানবাহন প্রয়োজনতবে দেবী কিন্তু আদি-অনন্তকাল ধরে ৪টি যানেই গমনাগমন করেনপ্রতিটি যানবাহনে গমনাগমনের আবার প্রভাবও পড়ে জগত সংসারে, মানব জীবনেফলে প্রতি বছরই বাঙালির কমন প্রশ্ন হল মা কিসে আসছেন আর কিসে ফিরছেন?

পঞ্জিকা বলছে, বার মা আসছেন দোলায়আর দশমীর দিন তিনি ফিরে যাচ্ছেন গজে অর্থাৎ হাতিতে চেপেদোলায় আগমনের ফলে প্রবল মড়ক প্রাক পুজোর সময় পর্যন্ত চলবে বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরাফলে পুজোর আগে পর্যন্ত প্রবল মহামারীর পরিস্থিতি থেকে যাওয়ার সম্ভবনা প্রবলআর গজে গমন, অর্থাৎ ধীর, শান্ত হাতিতে চড়ে মা এবার পাড়ি দেবেন স্বর্গেযারও একটি বিশেষ ফল রয়েছেশাস্ত্র মতে বলা হচ্ছে, গজে চড়ে মায়ের গমন শুভঅর্খাৎ এর ফলে বিশ্বে শুভ কোনও বার্তা নেমে আসবেগজের গমনে সাধারণত শস্য শ্যামলা বসুন্ধরা হয়আর এবার তারই প্রভাব পড়তে চলেছে বিশ্বে

কী ভাবে দেবীর বাহন প্রতি বছর বেছে নেওয়া হয়, জানেন? অর্থাৎ তিনি কিসে চেপে আসবেন যাবেন, সেটা জানার জন্য একটা মজার অঙ্ক আছেমজার ব্যাপার হল দেবী দুর্গা সিংহবাহনী৷ তা হলে ঘোড়ায় আগমন, দোলায় গমন, গজে গমনের মতো প্রশ্নগুলি আসে কী করে! বিষয়টি বেশ মজার৷ জেনে নেওয়া যাক দেবীর আগমন গমনের বার বাহন অনুযায়ী ফলাফল:

শাস্ত্রে বলা হয়েছে

রবৌ চন্দ্রে গজারূঢ়া ঘোটকে শনি ভৌময়োঃ

গুরৌ শুক্রে দোলায়াং নৌকায়াং বুধবাসরে।।

শাস্ত্রে আছে, দেবীর গমনাগমন যদি রবিবার বা সোমবার হয়, তা হলে তাঁর বাহন হয় গজ৷ আবার দেবীর গমনাগমন শনিবার বা মঙ্গলবার হলে তিনি চড়েন ঘোটকে৷ কিন্তু, বৄহস্পতিবার বা শুক্রবার যদি দেবীর গমনাগমন হয়, তা হলে তিনি দোলায় যাতায়াত করেন৷ আর বুধবার হলে তাঁর যাতায়াতের যানবাহন হয় নৌকা৷

দেবী যদি গজে গমনাগমন করেন, তা হলে পৃথিবীতে জলের সমতা বজায় থাকে এবং ফলন ভাল হয়৷ সুখ সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ থাকে মর্ত্যভূমি৷

হাতি হল অন্নপূর্ণা এবং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার বাহন৷ অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে শস্য শ্যামলা হয়ে ওঠে বসুন্ধরাবিশ্বকর্মার বাহন যেমন গজ, তেমনই বিশ্বকর্মা হলেন শিল্পের দেবতা৷ তাই গজে গমনাগমনের ফলে পৃথিবীতে কৃষিকাজের পাশাপাশি শিল্পের উন্নতি প্রসার হয়৷

দেবী দুর্গা যদি দোলায় চড়ে গমনাগমন করেন, তার ফল মর্ত্যে বহু মৃত্যু৷ এই বহু মৃত্যু হতে পারে প্রাকৄতিক দুর্যোগের কারণে কিংবা যুদ্ধ হানাহানির কারণে

দোলা হল পালকির মতো একটি যান৷ যার স্থিরতা কম, সদা দোদুল্যমান, অল্পে ভঙ্গুর এবং অনেক সময়ই বিপদের কারণ৷ তাই দুর্গার দোলায় গমনাগমনে মর্ত্যভূমির স্থিরতা ব্যাহত হতেই পারে

দেবী দুর্গার গমনাগমন ঘোটকে হলে চরম বিশৃঙ্খলা এবং ক্ষয়ক্ষতি দেখা দেয়৷ ঘোটক অত্যন্ত ক্ষিপ্রগামী, বুদ্ধিমান এবং প্রভুভক্ত৷ তবুও কখনও কখনও তার আচরণে উদভ্রান্ত ভাব লক্ষ্য করা যায়৷ এমন সময় ঘোড়া ছুটতে থাকে লক্ষ্মীর বিপরীতে৷

ঘোড়ার এমন স্বভাবের প্রভাবই মর্ত্যের উপর পড়ে, যখন দুর্গা গমনাগমন করেন ঘোটকে৷ ছাড়া দেখা যাচ্ছে দেবী ঘোটকে গমনাগমন করেন মঙ্গলবার বা শনিবার৷ মঙ্গল গ্রহের সেনাপতি, তেজস্বী বীরদর্পী৷ আর শনি হল কূট বুদ্ধি সম্পন্ন, প্রায়শই অনিষ্টকারী৷

দেবী দুর্গা নৌকায় গমনাগমন করলে মর্ত্যভূমিতে শস্য খুব ভালো হয়ে থাকে৷ কিন্তু, অতি বৄষ্টি বা বন্যার আশঙ্কাও থাকে৷ এক কথায়-জল বৄদ্ধির প্রভাবে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে মর্ত্যভূমিতে

দুর্গা বুধবার যাতায়াত করলেই তার যানবাহন হয় নৌকা৷ বুধবার হল সৌম্যবার৷ খুব শান্ত সৌম্য, শান্তিপ্রিয় হলেও বালক স্বভাবের৷ তাই বুধ সরল কিন্তু চঞ্চল মানসিকতা সম্পন্ন৷

যাইহোক, পিতার সঙ্গে উমা দোলায় চড়ে হিমালয়ে আসেনসপ্তমীর প্রভাতে মা-মেয়ের প্রভাত রাগিনী বেজে ওঠেতারপর সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী তিনদিন হাসি, আনন্দে উচ্ছাসে মা মেয়ের কেটে যায় এবং উমার বিদায়ের দিন অর্থাৎ বিজয়া উপস্থিত হয়বাপের বাড়ি থেকে উমা আবার ফিরে যাবেন স্বামীর ঘরেমা মেনকা বিজয়ার আগেই নবমীর রাতেই কন্যার বিচ্ছেদ আশঙ্কায় কাতর হয়ে ওঠেনতাই নবমীর রাতের কাছে প্রার্থনা করেন,-

ওরে নবমীনিশি না হও রে অবসান
শুনেছি দারুণ তুমি না রাখ সতের মান

কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে রাত্রি প্রভাত হয়এবং তার ফলে মা মেনকা আরও কাতর হয়ে পড়েনমেনকার এই কাতরতার প্রকাশ ঘটেছে একটি পদে,-
কি হল নবমীর নিশি হইল অবসান গো

বিশাল ডমরু ঘন ঘন বাজে শুনি ধ্বনি বিদরে প্রাণ গো

শেষ পর্যন্ত মহাদেব এসে উমাকে হাতির পিঠে চড়িয়ে নিয়ে চলে যায় আর মায়ের হৃদয় কান্নায় ভেঙে পড়েগিরিরাজকে মেনকা তার দুঃখের কথা জানিয়ে বলেন,-

আমার গৌরিরে লয়ে যায় হর আসিয়ে
কী করি হে গিরিবর রঙ্গ দেখ বসিয়ে?
বিনয় বচনে বুঝাইলাম নানামতো
শুনিয়া না শুনে কানে ঢলে পড়ে হাসিয়া
কিন্তু নিষ্ঠুর প্রকৃতি জননীর মিনতিতে সাড়া দেয় নাবুক ভর্তি বেদনা নিয়ে মেনকা কন্যা গৌরিকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানবিদায় লগ্নে মেনকার যন্ত্রণার কথা রামপ্রসাদ একটি মর্মস্পর্শী গানে তুলে ধরেছেন,-

তনয়া পরের ধন, বুঝিয়া না বুঝে মন,
হায় হায় কি বিড়ম্বনা বিধাতার

 

ছবি সৌজন্য- Pinterest

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait