একা এবং ঈশ্বর

একা এবং ঈশ্বর

(এই প্রবন্ধে যা লেখা হয়েছে, সবটাই লেখিকার ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং অনুভব থেকে। কোনো কুসংস্কার বা অন্ধবিশ্বাস থেকে নয়। যদি কারো ভাবাবেগে আঘাত লাগে তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত।)

মহাভারতের সভাপর্বে দেখা যায় সম্রাট যুধিষ্ঠিরের রাজসুয় যজ্ঞের বর্ণনা! এই যজ্ঞে ভারতবর্ষের ততকালীন সমস্ত রাজা ও যোদ্ধারা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকেই প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী। তাই এই সভায় কে অর্ঘ্য গ্রহণের উপযুক্ত এই নিয়ে গোল বাঁধে। তখন পিতামহ ভীষ্ম উপদেশ দেন বাসুদেব কৃষ্ণ কে এই অর্ঘ্য প্রদান করা হোক। তিনি বলেন, “অসূর্যমিব সূর্যেন নির্বাতমিব বায়ুনা/ ভাসিতম হ্লাদিতঞ্চইব কৃষ্ণেনেদম সদো হি ন” (অর্থাত, জ্যোতিষ্কগণের মধ্যে যেমন ভাস্কর, সেইরূপ সমাগত সকল জনের মধ্যে তেজ বল ও পরাক্রমে কৃষ্ণই শ্রেষ্ঠ)।

এই কথা শুনে কৃষ্ণের পিসতুতো ভাই শিশুপালের গোঁসা হল। তিনি নিজেকে সর্বদাই কৃষ্ণের থেকে শ্রেষ্ঠতর মনে করতেন। তাঁর জন্মের সময় তিনটি হাত ও তিনটি চোখ ছিল। দৈববাণী হয়েছিল যাঁর কোলে উঠলে তাঁর অতিরিক্ত একটি হাত ও চোখ খসে যাবে, তিনিই শিশুপালের হন্তা হবেন। কৃষ্ণ একবার তাঁকে কোলে নিলে তাঁর হাত ও চোখ খসে পড়ল। তখন কৃষ্ণের পিসি, চেদিরাজ দমঘোষের মহিষী কৃষ্ণের কাছে পুত্রের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। কৃষ্ণ বললেন, এই শিশুপালের একশত টি অন্যায় তিনি মার্জনা করবেন। অপরাধের সংখ্যা একশত পার হলেই তিনি দুর্বৃত্তকে বধ করবেন।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

শিশুপাল আশৈশব কৃষ্ণনিন্দা করতেন। ক্ষমা পেতে পেতে তাঁর স্বভাব হয়ে গিয়েছিল অন্যায় করার। অবশেষে যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় সেই অন্যায় একশত পার করল। কৃষ্ণ তাঁকে সুদর্শন চক্র দ্বারা বধ করলেন।

আমরা ভাবি মানুষই বোধহয় বিধাতা। কিন্তু আদৌ তা নয়। এই সমগ্র বিশ্বচরাচর ঈশ্বরের নিয়ম এর অধীন। তিনি চাইলেই এক লহমায় প্রজা থেকে রাজা করতে পারেন, আবার রাজা থেকে ভিখারী। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পশ্চাতে অনেক কারণ ছিল। রাজাদের উতশৃঙ্খলতা, সমাজের গরীব মানুষদের সমস্ত সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে রাখা, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারীদের অসম্মান এবং এরকম আরও অনেক কিছুই। শ্রী ভগবান দেখলেন এবার সবকিছু শেষ করে নতুন যুগের আরম্ভ করতে হবে। তাঁর কোপ থেকে একমাত্র পঞ্চপাণ্ডব ছাড়া কেউ বাদ গেল না। তিনি একাই রচনা করলেন ধ্বংসের পরিবৃত্ত। ভারতবর্ষের সমস্ত রাজারা এই মহাযুদ্ধে নিহত তো হলেনই, বাদ গেল না তাঁর নিজের যাদববংশও। সব শেষ করে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে, ধর্মরাজের হাতে ভারতকে তুলে দিয়ে তিনি নিজেও জরা ব্যাধের হাতে মৃত্যুবরণ করলেন। দেখিয়ে গেলেন, তিনিও শুভাশুভ কর্মফলের ঊর্ধে নন। সাথে বলে গেলেন, পাপ যখন মাথার উপর উঠবে, তিনি ধর্মসংস্থাপনার্থ আবার আসবেন।

সেই সময় হয়তবা সমাগতপ্রায়। এবার তিনি নতুন কি লীলা দেখাবেন তিনিই জানেন। করোনা ভাইরাস জৈব মারণাস্ত্র না এমনিই একটি অসুখ সে বিতর্কে যাব না। কিন্তু এই মারাত্মক অস্ত্রের থেকে ছাড় পাচ্ছেন না ধনী দরিদ্র কেউই। তাবড় নামকরা গায়ক গায়িকা, নায়ক নায়িকা, খেলোয়াড়, তাঁদেরও পরিবারবর্গ, প্রথম বিশ্বের রাজপরিবার, উন্নত দেশের প্রধানমন্ত্রী—-তালিকায় সবাই আছেন। ভোগবাদী ইউরোপ বিপর্যস্ত। চূড়ান্ত ভোগবাদী আমেরিকা মহাদেশ নিদারুণ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। ভ্যাটিকান এর প্রাসাদ থেকে পোপ অভ্যাসবশত জনতার প্রতি হাত নাড়ছেন প্রত্যেক বিকেলে। কিন্তু ইতালি তে লোক নেই পোপের হাতনাড়া দেখার জন্য। কেনো এরকম হল? পৃথিবী কেনো ঘরবন্দি? কেননা আমরা, এই বিপজ্জনক মানবপ্রজাতিটা ঈশ্বরের নিয়ম, প্রকৃতির নিয়ম ভুলে গিয়ে যথেচ্ছ ব্যাবহার করেছি প্রকৃতিকে। বনানী ধ্বংস করেছি, অন্যান্য প্রাণীদের মেরে ভারসাম্য নষ্ট করেছি, দুর্গম স্থানে ঘরবাড়ি করেছি। সামুদ্রিক প্রাণীদের মারার জন্য জলে বিষ মিশিয়েছি। প্লাস্টিকে প্লাস্টিকে এমনভাবে পৃথিবীকে মুড়েছি যাতে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার লুঠ করেছি। একশত টি অপরাধ কবেই পার। আর এই কীর্তিগুলো করেছে পৃথিবীর উন্নত ভোগবাদী রাষ্ট্রগুলোই। তাই মহাকালের করাল ছায়া আজ তাদের ওপর এতো বেশি।

বেলুড় মঠের সংঘগুরু ভারতবর্ষে প্রথম বুঝলেন ঘরবন্দি হতে হবে। নাহলে বাঁচা যাবে না। তিনি এগিয়ে এসে দোর বন্ধ করলেন মহাতীর্থের। বোঝালেন, ঈশ্বর শুধু মন্দিরে নয়, মানবহৃদয়ে বিরাজ করেন। কিছুদিনের চাক্ষুষ অদর্শন, ততদিন নিভৃতে পুজো। ঈশ্বর একা রচনা করে চলেছেন কোন খেলা, তা দেখার জন্য একটু অপেক্ষা!

স্বামীজী একদা বলেছিলেন, ভারতবর্ষে বুড়ো শিব ডুগডুগি বাজাবেন, কালী খড়গ হাতে ঘুরে বেড়াবেন আর কৃষ্ণ চিরকাল বাঁশি বাজাবেন। প্রকৃতপক্ষে মানুষের হাতে কিছুই নেই৷ রাখার হলে তিনিই রাখবেন, মারলেও তিনিই মারবেন। মানুষের অপরাধের তো শেষ নেই৷ তাই তাঁর বিধান আমাদের নির্বিচারে মাথা পেতে নিতেই হবে।

আশা একটাই! ভারতবর্ষ দেবভূমি। তিনি চাইলে এই দেবভূমিতে তাঁর পছন্দের পাণ্ডব নির্বাচিত করে দায়ভার তুলে দেবেনই দেবেন। আমরা তারপরই নয় মহাপ্রস্থানের পথ বেছে নেব।


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 01st Sep, 20 06:09 am

Nice thought

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait