১৮৬৩ সাল। পৌষ মাসের প্রবল শীত। দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিনী মন্দিরে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব বসে আছেন। দেখলেন গঙ্গাপারে কাশীধামের দিকের আকাশ থেকে এক অত্যুজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক কলকাতার দিকে চলে গেল। ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হলেন। ভাবে দেখলেন আলোকময় এক পথ ধরে তিনি ক্রমশ উর্ধগামী হয়ে চলেছেন। শেষে এমন এক স্থানে তিনি এলেন যে স্থান দেবতাদেরও অগম্য। সেখানে সপ্তর্ষিমণ্ডলের সাত ঋষি বসে ধ্যান করে চলেছেন। সেখানে তখন হঠা্ৎ এক দিব্য বালক এসে উপস্থিত হল। সে ওই সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রধান ঋষির গলা জড়িয়ে ধরে আবদারের সুরে বলে উঠল, “আমি যাচ্ছি, তোমাকেও আসতে হবে।” ঋষির ধ্যান ভাঙল। তিনি কোনও কথা বললেন না। স্মিত হেসে তাঁর সম্মতি জানালেন। উত্তরকালে ঠাকুর বলবেন, সেই ছোট বালক তিনিই। আর সেই ঋষি? নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভাবীকালের স্বামী বিবেকানন্দ। নরত্রাণতরে যিনি দেহ ধারণ করে এই সংসারে নেমে এসেছিলেন। ঠাকুর বুঝলেন, ওই জ্যোতিষ্কের পতন সেই ঋষিরই আগমনের ইঙ্গিত। আশায় বুক বাঁধলেন তিনি।
সে বছরের ১২ই জানুয়ারি। পৌষ সংক্রান্তির দিন সিমলা পাড়ার দত্তবাড়ি থেকে ঘন ঘন শাঁখের আওয়াজ আসছে। জানা গেল সে বাড়ির কর্তা বিশ্বনাথ দত্ত ও তাঁর স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দেবীর কোল আলো করে এক পুত্র এসেছে। বীরেশ্বর শিবের পুজো করে ছেলে পেয়েছেন, তাই শিশুর নাম হল বীরেশ্বর। ক্রমে সে হয়ে উঠল সবার আদরের ‘বিলে’। সে একাধারে যেমন মেধাবী, সত, কর্তব্যনিষ্ঠ, সাহসী অন্যদিকে তেমনই ডানপিটে। দিদিদের সাথে দুষ্টুমি করে, তাঁরা বকতে গেলে নর্দমায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে দিদিরা যেতে পারেন না। শেষে মা এসে খুব বকলে তখন রেগে যায়। আর একবার রেগে গেলে তাকে থামায় সাধ্যি কার? মা এসে তখন তার মাথায় ঘটি করে জল ঢালেন আর ‘শিব শিব’ বলেন। এই আশ্চর্য ওষুধ কাজে দেয়। ছেলের রাগ কোথায় উড়ে যায়। মা আক্ষেপ করে বলেন, “শিবের কাছে একটি ছেলে চাইলাম। তিনি পাঠালেন একটি ভূতকে!!”
ADVERTISEMENT
আরও পড়ুন – স্বামী বিবেকানন্দের মাতা-ঠাকুরাণী
সেই ছেলে একটু বড় হল। সঙ্গীদের সাথে খেলায় সর্বদা রাজা সাজত সে। সবাই তাকে নেতা হিসাবে মেনে নিল ওই ছোট বয়সেই। উত্তরকালে স্বামীজী বলবেন, নেতা হওয়া সহজ কথা নয়। দাসস্য দাস হয়ে থাকতে হয়, সবার মন জুগিয়ে চলতে হয়, তবে নেতা হওয়া যায়। সেইজন্যই তো বিলেকে ছোটবেলায় নেতা হিসাবে সবাই একবাক্যে মেনে নিয়েছিল। শুধু তাই নয়, জাতপাতের অসারতা সম্বন্ধেও ওইটুকু বয়সেই তিনি বিপ্লব ঘোষণা করেছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন নামজাদা উকিল। তাই তাঁর বিভিন্ন জাতের মক্কেলদের জন্য বসার ঘরে থাকত অগণিত হুঁকা। কেউ ছোট বিলেকে একবার বারণ করেছিল ওই হুঁকাগুলোয় হাত না দিতে। তাহলে নাকি জাত যাবে। একদিন বিলে এ কথার সত্যতা জানার জন্য বসার ঘরে ঢুকে হুঁকা টেনে দেখতে লাগল জাত কিভাবে পালায়! তার এই আচরণে তার বাবা সেদিন মনে মনে খুব খুশি হয়েছিলেন। তাই তো স্বামীজীর মুখ দিয়ে ভাবীকালে বেরোলো সেই মহাবানী! তিনি বললেন, ‘দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর সবাই আমার ভাই! সগর্বে বলো, আমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই!’ দুনিয়া কেঁপে উঠল। পরাধীন ভারতবর্ষে, নীচু জাতের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা ভারতবর্ষে, অজ্ঞানের অন্ধকারে ডুবে থাকা ভারতবর্ষে কে তুমি এলে যুগপুরুষ?? ছোটবেলায় ব্রহ্মদৈত্য দেখতে গিয়ে সারারাত গাছে কাটিয়েছেন, মা উদ্বিগ্ন হয়ে সারারাত ঘর বার করেছেন, সকালে ঘরে ফিরে মা কে বলেছেন সব নাকি মিথ্যে, ব্রহ্মদৈত্য বলে কিছু নেই৷ মা বলেছেন, ‘নিজে চোখে না দেখে কিছু বিশ্বাস করবি না’। সেই শিক্ষার জোরে যুবক নরেন্দ্র ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ‘ভগবান দেখেছেন, ভগবান আছে?’ এর আগে বহুজনের কাছে এ প্রশ্ন তিনি রেখেছেন কিন্তু কারো কাছে সদুত্তর পান নি। এখন ঠাকুরের কাছে উত্তর পেলেন, জানলেন খুব মন দিয়ে ডাকলে ঈশ্বরকে দেখা যায়, তাঁর সাথে কথাও বলা যায় বইকি!
সত্যের খাতিরে বারবার পরীক্ষা করেছেন ঠাকুরকেও! ঠাকুর টাকাপয়সা ছুঁতে পারেন না শুনে তাঁর অনুপস্থিতিতে তাঁর খাটের তলায় একটি মুদ্রা রেখে দিয়েছিলেন। ঠাকুর সেই খাটে বসতে গিয়ে যেন বিছের কামড় খেলেন! পরে জানলেন যে এই কাজ নরেনের। খুশি হলেন! বললেন, ‘বেশ করেছিস! কোনো কিছু পরীক্ষা না করে বিশ্বাস করবি না। যাচাই করে নিবি।’ বহুদিন পর স্বামীজী আমাদের উদ্দ্যেশ্যে বললেন, ”সত্যের জন্য সব কিছুকে ত্যাগ করা চলে, কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা চলে না”। স্বামীজীর সত্যনিষ্ঠার একটি ছোট উদাহরণ এই প্রসঙ্গে খুব উল্লেখযোগ্য। একবার তিনি ঠাকুরকে কথা দিয়েছেন দক্ষিণেশ্বরে আসবেন। নির্দিষ্ট সময়ের বহু আগেই তিনি দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছেছেন কিন্তু ঠাকুরের ঘরে ঢুকছেন না। এদিকে ঠাকুর টের পেয়ে তাঁকে ভিতরে আসতে বলছেন কিন্তু নরেন্দ্রকে রাজি করানো যাচ্ছে না। এর একমাত্র কারণ, সময়ের আগে নরেন্দ্র এসেছেন। সময়ের আগে ঠাকুরের ঘরে ঢুকলে তিনি সত্যভ্রষ্ট হবেন! এই নাহলে ঠাকুরের যোগ্য শিষ্য!! এই সত্যনিষ্ঠা প্রাচীন ভারতের গর্ব ছিল, ঠাকুর স্বামীজীর মধ্যে দিয়ে তাকে আধুনিক ভারতের পবিত্র ভিত্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করে দিলেন।
আরও পড়ুন - জাদুকর ও তাঁর জাদুদণ্ড
পরিব্রাজক রূপে ভারতবর্ষের কোণে কোণে স্বামীজী ঘুরেছেন, দেখেছেন মানুষে মানুষে ভেদ, অশিক্ষা, কুসংস্কার, গোঁড়ামীর অন্ধকার আবর্তে ভারতবর্ষ নিমজ্জমান। অথচ এই ভারতের অতীত গৌরবের কথা ভেবে তাঁর চোখে জল। তাই সমুদ্রের মাঝে ভারতবর্ষের জনহীন শেষ শিলাখণ্ডটির ওপর বসে তিনি ধ্যানমগ্ন হলেন। ধ্যানে নির্দেশ পেলেন, ভারতবর্ষের অতীত গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। তাঁর গুরুর আদর্শকে মাথায় নিয়ে চললেন আমেরিকায়, বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিতে। তখন ঠাকুর শরীর ত্যাগ করেছেন। যাবার আগে নির্দেশ চাইলেন তাঁর আর এক মায়ের, যাঁকে তিনি বলতেন ‘জ্যান্ত দুর্গা’!! হ্যাঁ, তিনি আমাদের সবার মা, জননী সারদামনি! ঠাকুর ও শ্রীমার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ধর্মসম্মেলনে হিন্দুধর্ম তথা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে ফিরে এলেন তাঁর স্বপ্নের দেশ ভারতবর্ষে। ফিরে এসে বললেন, ”ভারতবর্ষের ধূলিকণা পর্যন্ত মহাপবিত্র”। সিস্টার নিবেদিতা বলেছেন,”ভারতবর্ষকে তাঁর মত এত ভাল কেউ বাসেনি, ভারতবর্ষকে এমন নির্মম কষাঘাতও কেউ করেনি।” স্বামীজী নিজেকে বলতেন ‘ঘনীভূত ভারত’! ভারতবর্ষের মূল ধরে নাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন। আমাদের ভাবজগতে বিপ্লব তিনিই এখনো সাধিত করে চলেছেন।
এই মহাজীবন আজ ১৫৭ তম বর্ষে পদার্পণ করলেন। পৃথিবী যতদিন থাকবে, ততদিন তাঁর বাণী আমাদের উদ্বুদ্ধ করতে থাকবে। আমরা মিশে থাকব বিশ্বভাতৃত্বের বন্ধনে। তাঁর মূর্তিকে কিছু দুষ্কৃতকারী কালিমালিপ্ত করতে পারে, কিন্তু তিনি যে চাবুক কষিয়ে আমাদের মেরুদন্ডকে শক্ত করে দিয়ে গেছেন, সেই কষাঘাতকে বিনষ্ট করা যাবে না। সে প্রক্রিয়া নিরন্তর চলতেই থাকবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের মনের মধ্যে।
জয়তু স্বামীজী!
স্বদেশ টাইমস এখন টেলিগ্রামেও। সাবস্ক্রাইব করতে এখানে ক্লিক করুন।
স্বদেশ টাইমস ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
0 comments