বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত ভারতের প্রাচীন ইতিহাস

বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত ভারতের প্রাচীন ইতিহাস

বিষ্ণুপুরাণে বর্ণিত ভারতের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা

 

অতি প্রাচীনকাল থেকেই পুরাণের সংজ্ঞা বা প্রকৃতি নির্ধারণ করতে গিয়ে পণ্ডিতদের বহু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সাধারণভাবে পুরাণ শব্দের অর্থ করা পূর্বতন বা প্রাচীন কথা।

 

পদ্মপুরাণ এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী পুরাণ হল যা প্রাচীন পরম্পরার কথা বলে অথবা অতীতের কথা বলে। হিন্দু শাস্ত্রকারগণের মতে পুরাণগুলিও শ্রুতির মত ব্রহ্মার মুখ থেকে বিনিঃসৃত হয়েছিল। ব্রহ্মা অতীত কল্পের স্মৃতি থেকে এই পুরাণাদি তার মানসপুত্র ভৃগু, অত্রি,মরিচ প্রভৃতির কাছে প্রকাশ করেছিলেন। পরে তাদের অধঃস্তন অন্যান্য ঋষিগণ গুরু পরস্পর ক্রমে তা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অতএব পদ্মপুরাণ এর মতে,যা প্রাচীনতা কামনা করে তাইই  পুরাণ। পুরাণ কথার অর্থ হল প্রাচীনকালে এটি ছিল নতুন, এখন যা পুরাতন।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

 

ভারতীয় সাহিত্যের মূল আধার হল পুরাণ।ভারতীয় সাহিত্যে বেদের পর যে শাস্ত্র প্রাচীনত্ব দাবি রাখে সেটি পুরাণ। ভারতবর্ষকে জানতে গেলে এই শাস্ত্রকে না জেনে উপায় নেই। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এর সভ্যতা ধর্ম-কর্ম,ধ্যান-ধারণা, তন্ত্র-মন্ত্র,পৃথিবীর সর্বজনবিদিত। আধুনিক ভারতীয় সমাজ ও পুরাণের আধারের উপরেই নিজেকে নিয়ন্ত্রিত করতে পুরাণ ভারতীয় সংস্কৃতির প্রাণস্বরূপ।

 

পুরাণ কথার অর্থ পুরাতন কাহিনী বা প্রাচীন কথা। তা বারবার রামায়ণে উল্লিখিত হয়েছে। যেমন রামায়ণে বলা হয়েছে পুরাণ প্রসিদ্ধ নিসিংহরূপী বিষ্ণু রক্ষস্বরূপ হস্তিগুলিকে বিমর্দিত করতে থাকলে তাদের চিৎকার ও বেগ এমনভাবে উত্থিত হয়েছিল তা যেনো সিংহপীড়িত হস্তিগণের চিৎকার ও বেগের সমান।ইনি দ্বাদশ আদিত্যর তুল্য তেজময় এবং পুরুষোত্তম।ইনি সুরোপতি এবং সুরোগণের শ্রেষ্ঠ।

 

শঙ্করাচার্য পুরাণকে প্রামাণ্য গ্রন্থ বলেছেন।এই সকল প্রমাণে বেদের ব্রাক্ষণ অংশই পুরাণ।কিন্তু ভগবান শঙ্করাচার্য পুরাণের আধুনিক চলিত অর্থ গ্রহণ করেছেন।মহাভারতেও পুরাণ শব্দের বার বার ব্যাবহার হয়েছে।যেমন - সৌতি বলেছেন,পুরাণ পূর্ণচন্দ্র এর দ্বারা শ্রুতিরূপ জ্যোৎস্না প্রকাশিত হয়ে থাকে।এবং এই পুরাণ চন্দ্রদ্বারাই  মনুষ্যের বুদ্ধিরূপ কুমুদও বিকশিত হয়ে থাকেন।বেদের বহু শাখা ইদানিং লুপ্ত,পুরাণের দ্বারা সেই লুপ্ত বেদের অনুমান করা যায়।এজন্য পুরাণ পূর্ণ চন্দ্র আর শ্রুতি জ্যোৎস্না,পুরাণ কথার অর্থ নানাভাবে বিবৃত হয়েছে।বায়ুপুরাণে পুরাণ শব্দের অর্থ করা হয়েছে এইভাবে - যা পুরাকাল থেকে এখনও পর্যন্ত বর্তমান।মৎসপুরাণে পুরাণ কথার অর্থ এইভাবে নিরূপিত হয়েছে - পুরাতত্ববিদগণ পুরাণসমূহকে পুরাকালিয় ইতিবৃত্ত বলেই বিদিত করেছেন ।অন্য দুটি স্থানে বলা হয়েছে যে,যত কিছু শাস্ত্র আছে, তারমধ্যে পুরাণই সর্বপ্রথম গ্রুপে ব্রহ্মা কর্তৃক স্মৃত হয়েছে।এই উদাহরণগুলি থেকে স্পষ্ট জানা যায় যে পুরাণ কথার অর্থ হল প্রাচীন কথা।

ঋগবেদ এ পুরাণ কথাটি বিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়েছে যার সাধারণ অর্থ হলো প্রাচীন। বিভিন্ন উপনিষদেও পুরাণ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। যেমন শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের এক জায়গায় বলা হয়েছে-"আমি সেই পুরাণপুরুষকে জেনেছি, যিনি জরাহীন অজর "। এই উপনিষদের আরেকটি মন্ত্র থেকে বোঝা যায় যে, পুরাণ শব্দের অর্থ হল প্রাচীন। বলা হয়েছে- "তখন অন্ধকার ছিল না, দিনও ছিল না, তখন ছিলেন একমাত্র মঙ্গলময় শিব।  তিনি অক্ষর নির্বিশেষ ব্রহ্ম। তিনিইআদিত্যমন্ডলের বরণীয় পুরুষ। তা থেকে উৎপন্ন হয়েছে পুরাণী প্রজ্ঞ।

 

পাৰ্জিটারের মতে, " পঞ্চলক্ষণ হল প্রাচীন পুরাণগুলির বৈশিষ্ট্য।  যে পুরাণ গুলিতে এর থেকে বেশি বিষয় আছে সেগুলি অপেক্ষাকৃত আধুনিক। পঞ্চ লক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, "The term could not have been coined after The Puranas substantially took their present composition,  comprising great quantities of other matters, especially Brahminc Doctrine and ritual, dharma of all kinds and the merits of tirthas, which are often explained with exphatic prominence. It belongs to a time before these matters where Incorporated into the Puranas. Eid is there for ancient characteristics of the earliest Puranas, and shows what their contents were."

 

পুরাণ ও উপপুরাণের  লক্ষণ একই প্রকারের। উপপুরাণগুলি পুরাণগুলির  তুলনায় পরবর্তীকালে রচিত হয়েছিল।  পুরাণের সঙ্গে নানা বিষয়ে সংযোজিত হওয়ায় পুরাণ মহাপুরাণ এ পরিণত হয়।  মহাপুরাণগুলি থেকে ভারতের ভৌগোলিক বিবরণ,রাজনৈতিক ব্যবস্থা, ভারতীয় রীতিনীতি,জীবনযাত্রা,সাহিত্য, বিজ্ঞান সবকিছুর বর্ণনা পাওয়া যায়।  কোন কোন মহাপুরাণকে এনসাইক্লোপিডিয়া বলা যায়। হাজরা মনে করেন যে,অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে মার্কণ্ডেয়পুরাণ,বায়ুপুরাণ,ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ,মৎস্যপুরাণ,ভাগবতপুরাণ ও কূর্মপুরাণ হল প্রধান বা মুখ্য পুরাণ।  কারণ এগুলি অপেক্ষাকৃত প্রাচীন সময় রচিত এবং এগুলিতে অনেক পুরনো বিষয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।অন্যদিকে ব্রহ্মান্ডপুরাণ,লিঙ্গপুরাণ,পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত ও ভবিষ্যপুরাণ হল গৌণ বা অপ্রধান পুরাণ।কারণ এগুলিতে পরবর্তীকালে হস্তক্ষেপ করা হয়েছিল এবং এগুলির পূর্বতন বিষয়বস্তু ও আকৃতি হারিয়ে গেছিল।

অমরকোষ এর মতে পুরাতন ঘটনার বিবরণ হল ইতিহাস। এদিক থেকে দেখলে পুরাণ ইতিহাসরূপে বিবেচ্য হতে পারে।আধুনিক ধারণা অনুযায়ী মানবজাতি ও তাদের সমাজের বিবর্তনের কাহিনী হল ইতিহাসের উপজীব্য বিষয়। মহাপুরাণগুলিতে রাজনৈতিক ইতিবৃত্তকে কোনরকম অবহেলা না করে ও মানুষের আর্থিক অবস্থা,আচার-আচরণ,সামাজিক জীবন এবং সাংস্কৃতিক জীবনকে স্থান দেওয়া হয়েছে।তাই পুরাণের ঐতিহাসিক গুরুত্বকে অবহেলা করা যায় না।

 

পুরাণ শব্দটির অর্থ হল যা প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত এবং মানুষের মুখে মুখে  বিরোচিত। খ্রিস্ট জন্মের বহু পূর্ব থেকেই পুরাণ বলতে একশ্রেণীর গ্রন্থ বোঝাত, যে গ্রন্থগুলিতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে বিশ্বের পুরনো কাহিনী ও প্রবাদ কাহিনী বর্ণিত হত। প্রথমদিকে পুরাণ নামটিই  ব্যবহৃত হত। মহাপুরাণ নামটি পরবর্তীকালে দেওয়া হয়েছে।  মহাভারতে পুরাণ শব্দটি একবচন ও বহুবচন দু'ভাবেই ব্যবহৃত হয়েছে।  মনুসংহিতা যাগ্যবল্ক ও তৈত্তিরীয় আরণ্যকে পুরাণ শব্দটি বহুবচনে ব্যবহৃত হয়েছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে,মূল সংহিতাগুলির পরের পর্বে পুরাণের সংখ্যা বেড়ে হয় দশ এবং শেষ পর্বে তা হয় আঠারো। মহাভারত এবং হরিবংশে অষ্টাদশ পুরাণের উল্লেখ আছে। তবে ওই অনুচ্ছেদগুলি পরবর্তীকালের সংযোজন বলে মনে করা হয়।বায়ুপুরাণে অষ্টাদশ পুরাণের উল্লেখকেও প্রক্ষিপ্ত অংশ বলে মনে করা হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণগুলির গ্রন্থস্বত্ব থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, পরম্পরার উদ্ভব খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের প্রারম্ভ কালের পরে হয়নি। সুতরাং অন্তত খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের শেষে রচিত পুরাণের সংখ্যা অষ্টাদশ ছিল।অষ্টাদশ পুরাণ বলতে মূলতঃ মহাপুরাণগুলিকে বোঝানো হয়।

 

অষ্টাদশ মহাপুরাণের যে তালিকা মহাপুরাণ গুলিতে পাওয়া যায় তাতে বিভিন্ন ধরনের মত আছে। যেমন পদ্মপুরাণের মতানুসারে ব্রহ্মপুরাণ, পদ্মপুরাণ,বিষ্ণুপুরাণ,শিবপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ, নারদপুরাণ, মার্কণ্ডেয়পুরাণ, অগ্নিপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,লিঙ্গপুরাণ,স্কন্দপুরাণ, মৎস্যপুরাণ,বরাহপুরাণ,গরুড়পুরাণ এবং ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ ও কূর্মপুরান এই আঠারোটি পুরাণকে পণ্ডিতরা মহাপুরাণ বলে নির্দেশ করেন। বিষ্ণুপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে এই মতের সমর্থন রয়েছে।

পদ্মপূরাণে শিবপুরাণ কে মহাপুরাণ রূপে গণ্য করে বায়ুপুরাণকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আবার স্কন্দপুরাণে পদ্মপুরাণকে মহাপুরাণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়নি। অন্যদিকে অগ্নিপুরাণ এ শিবপুরাণের পরিবর্তে বায়ুপুরাণকে মহা পুরাণের তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে। আধুনিক কিছু গবেষক মনে করেন যে,বায়ুপুরাণ প্রকৃতপক্ষে একটি মহাপুরান কিন্তু শিবপুরাণ পরবর্তীকালে রচিত এবং বাস্তবে এটি মহাপুরাণ নয়। একে উপপুরাণ বলা যেতে পারে।

 

মহাপুরাণগুলিতে সত্ত্ব, রজঃ এবং তম এই তিনটি গুণের প্রাধান্য অনুসারে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে সত্ত্বগুণ বা পবিত্রতার প্রাধান্য, দ্বিতীয় ভাগে রজগুণ বা ভাবাবেগের প্রাধান্য, এবং তৃতীয় ভাগে তমোগুণ বা অন্ধকার অজ্ঞতার প্রাধান্য থাকে। এই শ্রেণীবিভাগ গরুড় পুরাণ ও ভবিষ্যপুরাণে প্রদত্ত তালিকা থেকে সামান্য পৃথক। যেমন পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত তালিকায় পদ্মপুরাণকে সাত্ত্বিক শ্রেণীভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু গরুড়পুরাণ এর মতে পদ্মপুরাণ রাজস শ্রেণীভুক্ত।

 

পুরাণের শ্লোক সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।  লোকসংখ্যার বিষয়ে নানা রকম পরস্পরবিরোধীতা কাজ করে। পুরাণগুলিতে ব্যবহার করা সংখ্যাগুলি থেকে আঠারোটি পুরাণের শ্লোক সংখ্যা দাঁড়ায় চার লক্ষ ছয়শ। এটি কিছু পুরাণের বক্তব্যের সঙ্গে মিলে যায়।তবে এটা লক্ষণীয় যে কতগুলি পুরাণে যতগুলি শ্লোক থাকার কথা হয়েছে আমরা সেগুলিতে কম সংখ্যক শ্লোক পাই। ভবিষ্যপুরাণ এর ব্রহ্ম পর্ব থেকে আমরা একটি কৌতূহলোদ্দীপক বক্তব্য পাই যে,সব পুরাণগুলিতে বারো হাজার শ্লোক আছে। কালক্রমে গল্প কাহিনী প্রবেশ করানোর ফলে সংখ্যাটি ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেশিরভাগ পুরাণ অনুসারে কূর্মপুরাণের শ্লোক সংখ্যা সতেরো থেকে আঠারো হাজার। কিন্তু এখন আমরা এই পুরাণকে যেরূপে পাই, তাতে মাত্র ছয় হাজার শ্লোক আছে।  ভারতীয় পুরাণে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মপুরাণে এক লক্ষ শ্লোক আছে, যেখানে অগ্নি পুরাণে বলা হয়েছে যে এই পুরাণে পঁচিশ হাজার শ্লোক আছে।  কিন্তু বাস্তব হলো এই যে, আনন্দ আশ্রম প্রেসের ব্রহ্মপুরাণ এর প্রায় চৌদ্দ হাজার শ্লোক আছে। স্কন্দপুরাণ এর ক্ষেত্রে বিষয়টি অন্যরকম। বলা হয় যে, এখানে একাশি হাজার শ্লোক আছে। কিন্তু ভেঙ্কটেশ্বর প্রেসে ছাপানো স্কন্দপুরাণে বেশ কয়েক হাজার বেশি শ্লোক আছে।

 

পুরাণ সংহিতার আকার কখনো নির্দিষ্ট নয়। কারণ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে চিন্তা ও বিশ্বাস জীবনধারা এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের পরিবেশের পরিবর্তন ঘটে। পুরাণগুলিকে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সংস্কার করা হয়।  প্রচলিত পুরাণগুলি থেকেই পুরাণের এই অস্থির চরিত্র সম্পর্কে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরাণ যখন জনসাধারণের দ্বারা আর গৃহীত হয় না তখন ভগবান বিষ্ণু ব্যাস রূপ ধারণ করে একে প্রতি যুগে পুনঃসম্পাদিত করেন। এভাবে সংযোজন ও প্রক্ষেপকে বৈধতা দানের প্রয়াস করা হয়েছে। পুরাণ সাহিত্যকে স্মরণাতীত কাল থেকে এক প্রাচীন জাতির ইতিহাস ও পৌরাণিক কাহিনীর মূল্যবান বিবরণ বলে পরিগণিত করা হয়।

 

স্বয়ং দৃষ্ট বিষয়ের বিবরণের নাম,আখ্যান,শ্রুত বিষয়ের বিবরণ উপাখ্যান,পিতৃপুরুষের গীত হলো গাথা, শ্রাদ্ধ কল পাখির বিবরণ কল্প শুদ্ধি। পুরাণ ও পুরাণ সংহিতা এক নয়।  একাধিক পুরাণ সন্নিবেশিত করে ও তার স্বর উদ্ধার করে পুরাণ সংহিতা রচিত হয়। বিষ্ণুপুরাণে প্রাণের উৎপত্তির বিষয়ে আরও বলা হয়েছে যে, ব্যাসদেবের একজন বিখ্যাত শিষ্য ছিল সূত জাতীয় রোমহর্ষণ। তাকে ব্যাসদেব পুরাণ সংহিতা অধ্যয়ন করান। রোমহর্ষণ এর ছয়জন শিষ্য ছিলেন। এদের মধ্যে কশ্যপ বংশীয় অকৃত ব্রণ, সাবর্ণী ও সংসাপায়ণ,রোমহর্ষণ এর কাছ থেকে অধীত মূল সংহিতা অবলম্বনে প্রত্যেকে এক একটি করে পুরাণ সংহিতা রচনা করেন। এই তিন সংহিতা ও সূতকথিত সংহিতা রোমহর্ষনিকা এই চার সংহিতার সারবস্তু নিয়ে বিষ্ণুপুরাণ রচিত হয়েছিল। এ থেকে বোঝা যায় যে ব্যাস কেবলমাত্র একটি পুরাণ সংহিতা সংকলন করেন। তার মৃত্যুর পর পুরাণের সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে।

উপরিউক্ত বর্ণনা থেকে বোঝা যায় যে ব্যাসদেব দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত আখ্যান উপাখ্যান গাঁথা গল্প শুদ্ধির বিষয়ে দক্ষ ছিলেন এবং এগুলিকে নিয়ে তিনি একটি পুরাণ সংহিতা সংকলন করেন।  কিন্তু এসব প্রাচীন বিষয়গুলি জন্ম কখন হয়েছিল কারাই বা এগুলিকে সংরক্ষণ করেছিলেন এই প্রশ্ন খুব স্বাভাবিক। বায়ু এবং পদ্মপুরাণ অনুসারে দেবতুল্য ঋষি বিখ্যাত রাজা কবিরদের বংশানুচরিত সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল সূত বা চারণ কবিদের উপর। বৈদিক সাহিত্যে বহু প্রাচীনকাল থেকেই সূতদের উল্লেখ পাওয়া যায়। অথর্ববেদে সূতের কথা আছে। যজুর্বেদ এর বিভিন্ন সংহিতা থেকে সূতদের কথা জানা যায়।  পরবর্তীকালে তাকে রাজকৃত বা কিংমেকার বলা হয়েছ। ক্ষমতা ও অবস্থান এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি রাজভ্রাতার পরে, স্থপতি অর্থাৎ গভর্নর বা প্রধান বিচারকের সমান ও গ্রামণীর ঊর্ধ্বে ছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের অবস্থানের ক্রমাবনতি ঘটে এবং সেই সঙ্গে তাদের পেশাগত পরিবর্তনও ঘটে।  স্মৃতিশাস্ত্র অনুসারে ক্ষত্রিয় পিতা ও ব্রাহ্মণ মাতার পুত্র সূত হিসাবে বিবেচিত হতেন। বৈদিক যুগে সূতরা কিন্তু মিশ্রবর্ণ রূপে গণ্য হতেন না। কারণ এ সময় বর্ণ অপেক্ষা শ্রেণীর ধারণা প্রচলিত ছিল। ফলে দুটি ভিন্ন বর্ণের বিবাহের ফলে বর্ণসঙ্কর উদ্ভবের কোন বিষয় ছিল না।  কৌটিল্য দেখিয়েছেন যে পরবর্তীকালে সূত বলতে কাদের বোঝানো হত তাদের থেকে পুরাণোক্ত সূতরা পৃথক এবং ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় উভয় থেকেই এরা ভিন্ন।  ক্রমে এই সূতরা গায়ক ও কবি স্তরে নেমে যেতে থাকেন এবং প্রচলিত লোককাহিনীর বাহক হয়ে ওঠেন ও বেদ পাঠের অযোগ্য বলে বিবেচিত হন।  সূতরা রাজাদের বিবরণের পরম্পরাগত রক্ষক হয়েছিলেন। সুতরাং পুরাণকথায় এগুলির পূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন। সৌতের বিবরণী ছিল পুরাণের মূল ভিত্তি।

 

মহাভারতের যুদ্ধ খ্রিস্টপূর্ব এগারোশো শব্দে হলে বলা যায় যে মূলপুরাণ সংহিতা সম্পূর্ণ হয় খ্রিস্টপূর্ব একহাজার অব্দে। ভারতবংশীয় রাজা অধিসীমকৃষ্ণের রাজত্বকালে পুরাণ সংহিতাটি মূল আকার ধারণ করে। তার পরবর্তী রাজাদের ইতিহাস মূল সংগ্রহের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে পরবর্তীকালে কিন্তু ভবিষ্যৎবাণীর আকারে। ঋষিদের মতে কোন একটি গ্রন্থ থেকে যেমন ব্রাহ্মণ গাঁও পরিষদ গুলির উদ্ভব ঘটেনি তেমনি কোনোসময়ই একটিমাত্র পুরাণ  ছিল না, যা থেকে অন্য পুরাণগুলির উদ্ভব ঘটেছে। একটি মূল পুরাণের অস্তিত্বের ধারণার তত্ত্বকে প্রত্যেকেই সমর্থন করেছেন ঠিকই তবে তারা মনে করেন পৌরাণিক পরম্পরা বিভিন্ন পরিবারের পুনর্গঠন,পরিবর্তনসহ নানা বিভাজন সামান্য পরিবর্তনসাধন এবং তথ্যের নতুন সংযোজনের ফলে নানা পুরাণ সংহিতার সূচনা হয়। বিভিন্ন পুরাণে কিছু বিষয়ের সাদৃশ্য আছে যা তাদের একটি সাধারণ উৎসের ইঙ্গিতবাহী।

 

উইন্টারনিৎস এর মতে,এই ব্যক্তিরা কখনো শিক্ষিত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন না। তারা ছিলেন মন্দিরের অশিক্ষিত পুরোহিত। এরা নিজেদের মন্দিরের উপাস্য দেবদেবী এবং যেসব ধর্মীয় স্থানকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতেন সেগুলিকে গৌরবান্বিত করার জন্য এই প্রচেষ্টা করেছিলেন।বৈদিক পুরোহিতরা সম্ভবত তাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে এই জ্ঞান উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন। বায়ু,ব্রহ্মাণ্ড ও মৎস পুরাণের মত প্রাচীন পুরাণগুলিতে ব্রাহ্মণদের দ্বারা গীত অনুবংশ শ্লোক সমূহ রাজাদের বংশ তালিকা ও বিবরণ পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এগুলি বিষ্ণু, শিব ও অন্যান্য দেবদেবীদের জনপ্রিয় ধারণার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে।

আরসি হাজরা প্রচলিত পুরাণ সমূহের বৈশিষ্ট্য রচনার পটভূমি বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। গৌতম বুদ্ধের কালের বহু পূর্ব থেকেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল বলে তিনি মনে করেন। সম্ভবত সবগুলি অব্রাহ্মণবাদী  ছিল। আদি জৈন গ্রন্থ গুলিতে অনেক বেশি সংখ্যক ব্রাহ্মণ্য মতবাদ বিরোধী সম্প্রদায়ের কথা আছে। তারা কঠোর জীবন,আত্মত্যাগ,যোগাভ্যাস প্রভৃতিকে স্বর্গসুখ অর্জনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় বলে মনে করতেন। এইসব ধর্মপ্রচারকরা যে সকল তথ্য প্রচার করেছিলেন সেগুলি বৈদিক ধর্মের অনুসরণকারীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। সাধারণ মানুষ এইসব ধর্মমতের দিকে আকৃষ্ট হয়েছিল এবং এর ফলে এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যা বেদ বা ব্রাহ্মণ্য চিন্তার অনুরোধ ছিল না। এই জাতিগুলি কালক্রমে ভারতবর্ষে বসবাস করতে থাকে বৌদ্ধধর্ম,শৈবধর্ম,বৈষ্ণবধর্ম ইত্যাদি গ্রহণ করায় শীঘ্রই এদের ভারতীয়করণ হয়। তাদের মধ্যে পল্লব, কুষাণ,শক,হুন ইত্যাদি জাতিগুলির নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এরা বহিরাগত জাতি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এই বিদেশিদের ভাবধারা,পরম্পরা,আচার-আচরণ ভারতীয়দের প্রভাবিত করে। এই সময়ে নন্দ,মৌর্যদের মত ক্ষত্রিয় বা শুদ্রদের রাজনৈতিক প্রাধান্য ব্রাহ্মণ্যবাদকে আরো অসুবিধাগ্ৰস্ত করেছিল।

 

পুরাণগুলির কাল নির্ণয় করা একটি জটিল বিষয়। গতিশীল চরিত্রের জন্য পুরাণগুলিতে বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন স্তর সন্নিবেশিত হয়েছে তাই পুরাণগুলির নির্দিষ্ট রচনা কাল নির্ণয় করা কঠিন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ব্রহ্মা,ব্রহ্মাণ্ড ও মৎসপুরাণের অন্তর্গত বংশতালিকা প্রাচীন হলেও অন্যান্য বিবরণ তুলনামূলকভাবে পরবর্তীকালে। বিপরীতক্রমে পদ্মপুরাণের মত পরবর্তীকালে রচিত পুরাণে কিছু প্রাচীন তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। বিভিন্ন পুরাণের রচনাকাল বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। 

 

অষ্টাদশ পুরাণের মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ অতি উল্লেখযোগ্য। ব্রহ্মান্ডের সম্পর্কে আলোচনা থাকার জন্য এই পুরাণকে ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ বলা হয়। বাস্তবে এটি বর্তমান বায়ুপুরাণ এর অনুরূপ।এই গ্রন্থকে অনেক সময় বায়োবীয় ব্রহ্মাণ্ড বলা হয়। কারণ এটি বায়ুপুরাণ এর মতই বায়ু কর্তৃক কথিত বলে বর্ণিত হয় এবং এর অধ্যায়গুলিও অনেক ক্ষেত্রেই বায়ুপুরাণ এর সঙ্গে সাদৃশ্য যুক্ত। বল্লাল সেন ও হিমাদ্রির রচনায় প্রাপ্ত কিছু শ্লোককে ব্রহ্মাণ্ডপুরাণ এর অন্তর্গত বলা হয়। এই শ্লোকগুলি বায়ুপুরাণে পাওয়া যায় ব্রম্ভান্ডের নয়। এইভাবে এই পুরাণ গ্রন্থ দুটির মূলগত ঐক্য প্রমাণিত হয়।  তবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে কখন এবং কেন একটি মূলপুরাণ যার পরিচয় সম্ভবত বায়ুর নাম ছিল তার ভিন্ন শীর্ষক সম্বলিত একটি দ্বিতীয় রূপের উদ্ভব ঘটেছিল।

 

মৎস্যপুরাণকে সবচেয়ে প্রাচীনতম পুরাণ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।  মৎস্যপুরাণ একটি বিশাল আকারের গ্রন্থ। প্রবল বন্যায় যখন পৃথিবী প্লাবিত হয় তখন ভগবান শ্রী বিষ্ণুর মৎস্য রূপ ধারণ করেন এবং নৌকারোহী মনুকে উদ্ধার করে প্রলয় থেকে তাকে রক্ষা করেন। এই প্রাচীন কাহিনী থেকেই এই পুরাণের সূত্রপাত। অন্যান্য প্রাচীন পুরাণগুলির মতোই মৎসপুরাণের বহু কাহিনী ও অতিকথা আছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কচের সঙ্গে দেবযানীর ব্যর্থ প্রেম এবং শেষ পর্যন্ত রাজা যযাতির সঙ্গে তার বিবাহ,দীর্ঘকাল জীবন উপভোগের পরেও যযাতির অতৃপ্তি। শিব পুরাণ,কার্তিকের জন্ম ,তড়কা দানব বধ।  এখানে কার্তিকের জন্ম সংক্রান্ত অধ্যায়ে  কালিদাসের কুমারসম্ভব এর ভাষাকে ব্যবহার করা হয়েছে।

প্রাচীনকালে অসাম্প্রদায়িক রূপে মার্কন্ডেয় পুরাণের আবির্ভাব ঘটেছিল। এই পুরাণটি প্রাচীন ঋষি মার্কণ্ডেয় নামানুসারে রচিত। মার্কণ্ডেয়পুরাণ মূলত একটি প্রাচীন গ্রন্থ এই গ্রন্থে তুলনামূলকভাবে প্রাচীন অধ্যায়গুলোতে সৃষ্টি কোন সৃষ্টি পৃথিবীর ভৌগোলিক পরিসর অল্পবিস্তর রাজাদের বিবরণ আলোচিত হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় রাজাদের বংশতালিকা ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে মুনি ঋষিদের নাম বাদ গেছে এবং লক্ষণীয়ভাবে কলিযুগের রাজবংশ গুলির বিবরণ অপ্রতুল বলা যায়। অপরদিকে পরবর্তী কালের স্মৃতিগ্রন্থ গুলিতে বর্ণিত কিছু আকর্ষণে যুক্ত করা হয়েছে। যেমন রাজা হরিশচন্দ্রের উপাখ্যান,পুত্রদের আত্মজ্ঞানের শিক্ষাদানকারী রানী মদালসার কাহিনী এই পুরাণে বর্ণিত হয়েছে।

 

অন্যদিকে রাজেন্দ্র চন্দ্র হাজরা মনে করেন যে,বিষ্ণুপুরাণ সম্ভবত খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের শেষ চতুর্থাংশ বা চতুর্থ শতকের প্রথম চতুর্থাংশে রচিত হয়েছিল। এটি শুধুমাত্র সংকলন গ্রন্থ নয় এর চরিত্র অনেক বেশি সমন্বয়ধর্মী।  এতে সৃষ্টিতত্ত্ব পূর্ণ সৃষ্টিতত্ত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে অসংখ্য পৌরাণিক স্তোত্র রয়েছে। প্রীতি অংশের সপ্তদশ ও অষ্টাদশ অধ্যায় বিষ্ণুর নিজের দেহ থেকে মায়ামোহ প্রকাশের কাহিনী রয়েছে যার সাহায্যে নর্মদা তীরের দানবদের অর্হৎ অর্থাৎ জৈন ও বৌদ্ধরূপে পরিণত করা হয়েছে। এই অংশটি খুব সম্ভব পরবর্তী সংযোজন।  বিষ্ণুপুরাণে কলিযুগের রাজবংশের যে বর্ণনা আছে তা অবশ্যই পরবর্তীকালে বিচার পূর্বক সংশোধিত হয়েছিল।

 

প্রচলিত মহাপুরাণগুলির মধ্যে ভাগবত পুরাণ সবচেয়ে জনপ্রিয়। এটি পরিণত বৈষ্ণবদের গ্রন্থ। বৈষ্ণব ব্যতীত অন্যান্য হিন্দু ও হিন্দুদের কাছেও এই গ্রন্থ শ্রদ্ধেয়। বিষ্ণুপুরাণ এর সঙ্গে এই পুরাণের বিষয়বস্তুর অনেক মিল আছে। ভাগব পুরাণে কলি যুগের রাজাদের বংশোদ্ভূত প্রাচীন পুরাণের সব লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় এছাড়াও এই পুরাণের আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক সাক্ষ্য-প্রমাণ আদি থেকে বোঝা যায় যে, এই পুরাণ খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের প্রথমার্ধে রচিত হয়েছিল। তবে এটি অনস্বীকার্য যে, এই গ্রন্থটি মাঝে মাঝে পুনর্বিবেচনা সংশোধিত হয়েছিল। 

 

গৌতম বুদ্ধ সহ বিষ্ণুর অবতার তিনটি তালিকা এই গ্রন্থে পাওয়া যায়।এগুলির মধ্যে দৈর্ঘ্য ও বিন্যাসগত পার্থক্য আছে।  এছাড়া তুলসী গাছ,তন্ত্র,মূল পুরাণগুলির মহাপুরাণ নামকরণ,তাদের অষ্টাদশ বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা,ইত্যাদি এই পুরাণে  সংযোজিত হয়েছে। মৎস পুরানের তিপান্নতম অধ্যায় ভাগবতপুরাণের যে বিবরণ আছে তার সঙ্গে অধুনা প্রচলিত ভাগবতের বিষয়বস্তুর সম্পূর্ণ মিল নেই।  সুতরাং এটি খুব সম্ভব যে বর্তমান পুরাণের অনুরূপ একটি আদি ভাগবত ছিল। বিষ্ণুপুরাণ ও অন্যান্য পুরাণও সম্ভবত ওই আদি  ভাগবত পুরাণের উল্লেখ রয়েছে।

স্কন্দপুরাণ এত বিশাল আকৃতির গ্রন্থ যে এতে বিভিন্ন ঘটনাকে যুক্ত করার সুযোগ থাকায় এর সঠিক তারিখ নির্ণয় করা বেশ কঠিন। পন্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় নেপালের রাজকীয় পুস্তকালযয়ে স্কন্দপুরাণ এর একটি হস্তলিখিত পুঁথি দেখেছিলেন খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শৈলীতে লিখিত হয়েছিল। সব সাক্ষ্য-প্রমাণ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, স্কন্দপুরাণের রচনাকাল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পূর্বে এবং নবম শতকের পরে হতে পারে না।  অগ্নি ও গরুড় পুরাণ আকর্ষক বিষয়সমূহের বিশ্বকোষের বৈশিষ্ট্যযুক্ত।  অগ্নিপুরাণ এ রামায়ণ,মহাভারত হরিবংশ ইত্যাদি সংক্ষিপ্ত আকারে যুক্ত করা হয়েছে। এতে নারদ স্মৃতি, যাগ্যবল্ক, ও স্মৃতি বিষ্ণু পুরাণের মত বহু গ্রন্থ থেকে স্তোত্র বা সম্পূর্ণ অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। মহাভারত, হরিবংশ বিষ্ণুপুরাণ,মার্কণ্ডেয়পুরাণ ও বায়ুপুরাণ এর বিভিন্ন অংশ নিয়ে ব্রহ্মপুরাণ রচিত হয়েছিল। এর যে অধ্যায়গুলি জাল অন্য কোথাও তার চিহ্ন পাওয়া যায় না।

 

ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী হাজরা মনে করেন যে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ সম্ভবত খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে সংকলিত হয়েছিল। খ্রিস্টীয় দশম শতকের থেকে বাংলার লেখকরা এর উপর নির্মাণ শুরু করেন যা খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে বর্তমান রূপ ও সূচি নিয়ে পূর্ণতা পেয়েছিল।  ভারতীয় সংস্কৃতি কোষের বক্তব্য অনুযায়ী আদ্য শঙ্করাচার্য তার 'বিষ্ণুর সহস্রনাম' অভ্যাসে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এ থেকে বলা যায় যে,পুরানো অবশ্যই আদ্য শঙ্করাচার্যের পূর্বে সংঘটিত হয়েছিল।

 

প্রাচীনকাল থেকেই তামিল দেশে শিব পুরাণ জনপ্রিয় ছিল। সম্ভবত খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে পেরুমলনাথ এর কিছু অংশ তামিল ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। একাদশ শতকে আল-বেরুনীর ভারত সংক্রান্ত বর্ণনায় শিব পুরাণের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ থেকে মনে হয় এতে শিব পুরাণ অবশ্যই খ্রিস্টীয় এক হাজার ত্রিশ অব্দের পূর্বে রচিত হয়েছিল। আভ্যন্তরীণ স্বার্থের জন্য শিবপুরাণের কৈলাস সংহিতার ওপর নির্ভর করা যায়। এখানে ষোড়শ ও সপ্তদশ অধ্যায়ে প্রত্যাভিজ্ঞা দর্শনের কথা আছে। এর সঙ্গে সম্পর্কিত সূত্র এবং বার্তিক সম্পর্কে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। শিব সূত্র বাসু গুপ্তের রচনা। বাসু গুপ্ত খ্রিস্টীয় নবম শতকের মানুষ ছিলেন বলে মনে করা হয়। ভরদ্বাজ ও ভাস্কর্য চিত্রের উপর কতকগুলি বার্তিক পাওয়া যায়। এইগুলিও খ্রিষ্টীয় নবম শতকের মধ্যভাগে রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়ে থাকে। এ থেকে বলা যায় যে শিব পুরাণের কাল হল খ্রিস্টীয় দশম শতক।  আবার মহাভারতের রীতি অনুযায়ী মহা ভাগবতপুরাণের উপর শিবপুরাণের প্রভাব রয়েছে বলে অনুমান করা হয় এছাড়াও শিবপুরাণ অবশ্যই মহাভাগবত এর এক বা দুই শতকে রচিত হয়েছিল।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে পুরাণ গ্রন্থগুলির উদ্দেশ্যে শুধুমাত্র জনগণকে শিক্ষাদান করা ও তাঁদের উন্নততর জীবনের ধারণার দ্বারা প্রভাবিত করাই মূল উদ্দেশ্য ছিল না। বিভিন্ন ধর্মীয় আন্দোলন বারংবার বিদেশিদের আক্রমণ জনিত কারণে যেসব আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় সমস্যার সূত্রপাত হয়েছিল এই গ্রন্থগুলি সেই সমস্ত সমস্যার সমাধান সূত্র অনুসন্ধানের কাজ করেছিল। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস ছাড়া মানুষের সমাজ, ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, জীবনধারা ইত্যাদির পরিচয় মহাপুরাণগুলি থেকে পাওয়া যায়।ভারতীয়দের চিন্তাধারা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের ক্রমোন্নতির বিষয়ে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে মহাপুরাণ গুলির অন্যতম উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে এগুলি ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে ব্যবহার করতে গেলে সর্তকতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে।  এই সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত হয়ে পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে মহা পুরাণে বর্ণিত পরিবেশ সচেতনতা,স্বাস্থ্য রক্ষা তথা চিকিৎসাবিষয়ক উপাদানগুলি অনুসন্ধানের প্রয়াস চালিয়েছেন বহু ঐতিহাসিক।আগামীদিনেও পুরাণগুলি এভাবেই নতুন ধ্যানধারণার দ্বারা সংযোজিত হতে থাকবে।

 

তথ্যসূত্র -

Rajendra Chandra Hazra, The Puranas, P - 246
D Pusalkar, Indian Inheritance, Vol- 1,Bombay, 1955,P-109
Rajendra Chandra Hazra, The Puranas, P - 253
Hansa B. Bhatt, A Critical Study Of Mahabhagavadpuranam.
P. Bhargava, Retrieval Of History From Puranic Myths, Delhi, 1998,P- 86
গিরীশচন্দ্র বসু,পুরাণ প্রবেশ,কলিকাতা
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ,শ্রীকৃষ্ণজন্মখন্ড, 6-10
P. Bhatt, Ancient Indian Traditional and Mythology, Translated By a Board Of Scholars, Vol- 39,The Padma Puran, Delhi, 1988,P - XVIII

 


0 comments

Sanchari Bhattacharya

Sanchari Bhattacharya

Shared publicly - 14th Oct, 20 09:50 am

Thank you so much.

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 14th Oct, 20 09:29 am

Analytical article. Very informative.

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait