ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি
‘হে পণ্ডিতের গ্রহ,
তুমি জ্যোতিষের সত্য
সে-কথা মানবই,
ADVERTISEMENT
সে সত্যের প্রমাণ আছে গণিতে’।….
জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের কথা আমরা অল্পবিস্তর জানি। ‘বিশ্বপরিচয়’ নামে তাঁর একখানা অসাধারণ বই তো আছেই, আর আছে নানা সময়ে নানা জনের সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে আলোচনার টুকরো কথা। কিন্তু মহাকাশের নক্ষত্রমন্ডলীর নাড়ী বিচারের সঙ্গে সঙ্গে এই পৃথিবীর সাধারণ মানুষের উপর গ্রহ-উপগ্রহের প্রভাব সম্পর্কে তার কোন আগ্রহ ছিল কি? যেমন ছিল প্লানচেট মিডিয়াম, বায়োকেমিক ওষুধ ইত্যাদি সম্পর্কে?
কোনও কোনও গানেও তিনি জ্যোতিষচর্চা করেছেন পরিহাসচ্ছলে। ‘ফাল্গুনি’ নাটকে নবযৌবনের দল গেয়েছে, -
“জন্ম মোদের ত্র্যহস্পর্শে, সকল-অনাসৃষ্টি।
ছুটি নিলেন বৃহস্পতি, রইল শনির দৃষ্টি”।
অযাত্রাতে নৌকো ভাসা,
রাখি নে, ভাই, ফলের আশা--
আমাদের আর নাই যে গতি ভেসেই চলা বই॥
আবার ‘শিশু’ কাব্যগ্রন্থে ‘জ্যোতিষ-শাস্ত্র’ নিয়ে একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন, -
“আমি শুধু বলেছিলেম—
‘কদম গাছের ডালে
পূর্ণিমা-চাঁদ আটকা পড়ে
যখন সন্ধেকালে
তখন কি কেউ তারে
ধরে আনতে পারে”।…
না রবীন্দ্রনাথ নিজে কোনদিন জ্যোতিষচর্চা করেছেন বলে আমার অন্তত জানা নেই। তবে ওই পরলোকচর্চা ব্যাপারটায় যেমন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা না ভেবেই তিনি কৌতূহল দেখিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি কোষ্ঠি, ঠিকুজি, হস্তরেখা-বিচার ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর অনাগ্রহ ছিল না। এই মনোভাবের প্রতিফলন পাই স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা কয়েকটি চিঠিতে। চিঠিপত্র প্রথম খণ্ডে ১৯০১ সালে শিলাইদহ থেকে মৃণালিনী দেবীকে তিনি লিখছেন, “…দুটো চাবি পেয়েছি, কিন্তু আমার কর্পূর কাঠের দেরাজের চাবিটা দরকার তার মধ্যে রথীর ঠিকুজি আছে সেইটের সঙ্গে মিলিয়ে রথীর কুষ্ঠি পরীক্ষা করতে দিতে হবে। সেটা চিঠি পেয়েই পাঠিয়ো” । এই কয়েকটি লাইনেই প্রমাণ, ঠিকুজি-কুষ্ঠিতে তাঁর বিশ্বাস কিছুটা আছে।
১৮৯১ সালে সাজাদপুর থেকে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে আর একখানা চিঠিতে লেখেন, “আমার কুষ্ঠিতে লেখা আছে কি না বিনা চেষ্ঠায় আমার যশ এবং আর দুই একটা জিনিস হবে”।
রবীন্দ্রসদনে রাখা রবীন্দ্রনাথের ওই কুষ্ঠিতে কি লেখা আছে যা জীবনস্মৃতির প্রথম পাণ্ডুলিপি থেকে বর্জিত একটি অনুচ্ছেদে রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন তাঁর জন্মকুন্ডলী কি রকম, -
“ইহা হইতে বুঝা যাইবে ১৭৮৩ সম্বতে অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৬১ খৃষ্টাব্দে ২৫শে বৈশাখে কলিকাতায় আমাদের জোড়াসাঁকোর বাটিতে আমার জন্ম হয়। ইহার পর হইতে সন-তারিখ সম্বন্ধে আমার কাছে কেহ কিছু প্ৰত্যাশা করিবেন না” ।
‘প্রিয় পুস্পাঞ্জলি’ গ্রন্থে “ফলিত জ্যোতিষ প্রবন্ধে (পৃ ২৩৭) কবিবন্ধু প্রিয়নাথ সেন রবীন্দ্রনাথের জন্মকুণ্ডলী বিচার করেছেন একই ভাবে।— রবীন্দ্রসদনে রক্ষিত পারিবারিক ঠিকুজির খাতায় পাওয়া যায়— কৃষ্ণপক্ষ ত্রয়োদশী সোমবার রেবতী মীন শুক্রের দশা ভোগ্য ১৪।৩।১১।৩৯”
মীন রাশি মীন লগ্নের জাতক রবীন্দ্রনাথ ছিলেন লগন-চাঁদা ছেলে তবে সে বিচারের ক্ষেত্র এই রচনা নয়। আমাদের আলোচ্য জ্যোতিষ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ্বাসের কথা আগেই বলেছি, তবে তার সঙ্গে কিঞ্চিৎ ঠাট্টার ভাবও ছিল। সে ঠাট্টা অবশ্য জ্যোতিষ নিয়ে নয়, কখনও জ্যোতিষী নিয়ে, কখনও নিজের ভাগ্য নিয়ে।
ঠিকুজী কোষ্ঠি ছাড়াও হাত দেখা গনৎকাররাও রবীন্দ্রনাথের কাছে অনেক সময় এসেছেন। একজনের কথা তিনি স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে জানিয়েছেন,
সাহাজাদপুর । ১৮৯১ ]
ভাই ছুটি, আজ সকালে এ অঞ্চলের একজন প্রধান গণৎকার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল । সমস্ত সকাল বেলাটা সে আমাকে জালিয়ে গেছে— বেশ গুছিয়ে লিখতে বসেছিলুম বকে বকে আমাকে কিছুতেই লিখতে দিলে না। আমার রাশি এবং লগ্ন শুনে কি গুণে বল্লে জান ? আমি সুবেশী, সুরূপ, রংটা শাদায় মেশানো শ্যামবর্ণ, খুব ফুট্ফুটে গৌর বর্ণ নয়, – আশ্চর্য! কি করে গুণে বলতে পারলে বল দেখি ? তার পরে বল্লে আমার সঞ্চয়ী বুদ্ধি আছে কিন্তু আমি সঞ্চয় করতে পারব না— খরচ অজস্র করব কিন্তু কৃপণতার অপবাদ হবে, মেজাজটা কিছু রাগী (এটা বোধ হয় আমার তখনকার মুখের ভাবখানা দেখে বলেছিল)। আমার ভার্য্যাটি বেশ ভাল । আমার ভাইয়েব সঙ্গে ঝগড়া হবে— আমি যাদের উপকার করব তারাই আমার অপকার করবে । ষাট বাষট্টি বৎসরেব বেশি বাঁচব না । যদিবা কোন মতে সে বয়স কাটাতে পারি তবু সত্তর কিছুতেই পেরতে পারব না। শুনে ত আমার ভারি ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে । এই ত সব ব্যাপাব । যা হোক তুমি তাই নিয়ে যেন বেশি ভেবো না । এখনো কিছু না হোক ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আমার সংসর্গ পেতে পারবে । ততদিনে সম্পূর্ণ বিরক্ত ধরে না গেলে বাচি । আমার ঠিকুজিটা সঙ্গে থাকলে তাকে দেখানে যেতে পারত। সেটা আবার প্রিয়বাবুর কাছে আছে। সে বল্লে বৰ্ত্তমানে আমার ভাল সময় চলচে— বৃহস্পতির দশা— ফাল্গুন মাসে রাহুর দশা পড়বে। ভাল অবস্থা কাকে বলে তাত ঠিক বুঝতে পারিনে।
এর পরের ইতিহাস সকলের জানা। গণৎকারকে মিথ্যে প্রমাণ করে পত্রলেখক দীর্ঘ আশি বছর বেঁচে ছিলেন। হ্যাঁ এই কাহিনি ১৮৯১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজের জীবনের ঘটনা। দীর্ঘ জীবনে প্রিয়জনদের মৃত্যু বারবার তাঁকে শোকাহত করলেও মৃত্যুঞ্জয়ী রবীন্দ্রনাথ নিজে মৃত্যুর করাল কবল থেকে একাধিক বার বেঁচে ফিরে এসেছিলেন।
১৮৯২ সালের কথা। সেবারও জমিদারির কাজে শিলাইদহে আছেন কবি। জুলাই মাস। ভরা বর্ষার কাল। কবি পদ্মা বোটে সেদিন গোরাই নদীবক্ষে। নদীবক্ষেই থাকতে বেশি পছন্দ করতেন। বর্ষার জলে গোরাই সেদিন জলে পরিপূর্ণ একেবারে। তিনি সেই ভরা নদীর সৌন্দর্যে মোহিত। পাল তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে শিলাইদহ যাচ্ছেন। হু হু করে বোট দুলে দুলে চলেছে। কবি কখনও লেখাপড়া করছেন, কখনও বা বাইরের ভিজে অঝোর শ্রাবণকে দেখছেন। বেলা তখন সাড়ে দশটা হবে। হঠাৎই বিপদ ঘনিয়ে এল। কবি ছিন্নপত্রে স্নেহের বিবিকে লিখছেন
আজ এই মাত্র প্রাণটা যাবার জো হয়েছিল। কী করে যে বাঁচল ঠিক বুঝতে পারছি নে। যা হোক, বেঁচেছে সে জন্য দুঃখিত নই। পান্টি থেকে আজ শিলাইদহে যাচ্ছিলুম— বেশ পাল পেয়েছিলুম, খুব হুহু শব্দে চলে আসছিলুম— বর্ষার নদী চার দিকে থৈ থৈ করছে এবং হৈ হৈ শব্দে ঢেউ উঠছে — আমি মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছি এবং মাঝে মাঝে লেখাপড়া করছি। বেলা সাড়ে দশটার সময় গড়ুই নদীর ব্রিজ দেখা গেল । বোটের মাস্তুল ব্রিজে বাধবে কি না তাই নিয়ে মাঝিদের মধ্যে তর্ক পড়ে গেল, ইতিমধ্যে বোট ব্রিজের অভিমুখে চলেছে। মাঝিদের আশা ছিল যে, আমরা স্রোতের বিপরীত মুখে যখন চলেছি তখন ভাবনা নেই, কারণ ব্রিজের কাছাকাছি এসেও যদি দেখা যায় যে মাস্তুল বাধবে তখনই পাল নাবিয়ে দিলে বোট স্রোতে পিছিয়ে যাবে। কিন্তু ব্রিজের কাছে এসে আবিষ্কার করা গেল মাস্তুল ব্রিজে ঠেকবে এবং সেখানে একটা আওড় ( আবর্ত ) আছে। সেই আওড় থাকাতে সেখানে স্রোতের গতি বিপরীত মুখে হয়েছে। তখন বোঝা গেল সামনে একটি সর্বনাশ উপস্থিত। কিন্তু বেশিক্ষণ চিন্তা করবার সময় ছিল না— দেখতে দেখতে বোটটা ব্রিজের উপর গিয়ে পড়ল। মাস্তুল মড় মড় করে ক্রমেই কাত হতে লাগল— আমি হতবুদ্ধি মাঝিদের ক্রমাগত বলছি, তোরা ওখান থেকে সর্, মাস্তুল ভেঙে তোদের মাথার উপর পড়বে – এমন সময় আর-একটা নৌকা তাড়াতাড়ি দাঁড় বেয়ে এসে আমাকে তুলে নিলে এবং রশি নিয়ে আমাদের বোটটাকে টানতে লাগল। তপসি এবং আর-একজন মাঝি রশি দাঁতে কামড়ে ধরে সাৎরে ডাঙায় গিয়ে টানতে লাগল। ডাঙায় আরও অনেক লোক জমা হয়ে বোট টেনে তুললে। কারও কোনো আশা ছিল না । মাস্তুল যত কাত হচ্ছিল বোটও তত কাত হয়ে পড়ছিল— যদি সময়মত নৌকো না আসত আর বেশিক্ষণ টিকত না । সকলে ডাঙায় ভিড় করে এসে বললে, "আল্লা বাচিয়ে দিয়েছেন, নইলে বাঁচবার কোনো কথা ছিল না । … মাঝিরা বলছে এ যাত্রাটাই ভালো নয়— তিনবার এই রকম হল ।
পরে বোটে বসেই স্ত্রী মৃণালিনীদেবীকে এই ঘটনার কথা লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ—
ভাই ছুটি— আজ আর একটু হলেই আমার দফা নিকেশ হয়েছিল। তরীর সঙ্গে দেহতরী আর একটু হলেই ডুবেছিল। আজ সকালে পান্টি থেকে পাল তুলে আসছিলুম— গোরাই ব্রিজের নীচে এসে আমাদের বোটের মাস্তুল ব্রিজে আটকে গেল— সে ভয়ানক ব্যাপার— একদিকে স্রোতে বোটকে ঠেলচে আর এক দিকে মাস্তুল ব্রিজে বেধে গেছে— মড়মড় মড়মড় শব্দে মাস্তুল হেলতে লাগল একটা মহা সৰ্ব্বনাশ হবার উপক্রম হল এমন সময় একটা খেয়া নৌকা এসে আমাকে তুলে নিয়ে গেল এবং বোটের কাছি নিয়ে দুজন মাল্লা জলে ঝাপিয়ে সাৎরে ডাঙ্গায় গিয়ে টানতে লাগল— ভাগ্যি সেই নৌকো এবং ডাঙ্গায় অনেক লোক সেই সময় উপস্থিত ছিল তাই আমরা উদ্ধার পেলুম, নইলে আমাদের বাচবার কোন উপায় ছিল না— ব্রিজের নীচে জলের তোড় খুব ভয়ানক – জানিনে, আমি সাৎরে উঠতে পারতুম কি না কিন্তু বোট নিশ্চয় ডুবত। এ যাত্রায় দু তিনবার এই রকম বিপদ ঘটল। পান্টিতে যেতে একবার বটগাছে বোটের মাস্তুল বেধে গিয়েছিল সেও কতকটা এই রকম বিপদ— কুষ্টিয়ার ঘাটে মাস্তুল তুলতে গিয়ে দড়ি ছিড়ে মাস্তুল পড়ে গিয়েছিল আর একটু হলেই ফুলচাদ মারা গিয়েছিল – মাঝিরা বলচে এবার অযাত্রা হয়েচে ।…
পরদিন স্নেহের বিবিকে আবার লিখলেন, “কাল যে কান্ডটি হয়েছিল সে বরঞ্চ কিছু গুরুতর বটে। কাল যমরাজের সঙ্গে এক রকম হাউ-ড্যু-ডু করে আসা গিয়েছে। মৃত্যু যে ঠিক আমাদের নেক্সটু-ডোর নেবার এ রকম ঘটনা না হলে সহজে মনে হয় না”।
আর একজন গণৎকার যে জোড়াসাঁকো বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের হাত দেখতে এসেছিলেন, সেই সম্পর্কে সাক্ষ্য দিয়েছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রবধূ শ্রীমতী অমিতা ঠাকুর। তিনি বলেছেন, এই গণৎকার ছিলেন নন্দলাল বসুর বন্ধু, সে সুবাদেই এসেছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তিনি কি বলেছিলেন, অমিতা দেবী জানেন না। শুধু শুনেছেন গণৎকার নাকি বলেছেন, রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে ভাল বোঝেন তাঁর বৌমা – অর্থাৎ প্রতিমা দেবী। তাছাড়া জীবনের শেষ দিকে একজন মহিলা রবীন্দ্রনাথকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। গণৎকার মহিলার নাম করেননি, তবে অনুমান করা যায়, সম্ভবত তিনি ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো।
আর একটি প্রাসঙ্গিক ছবি আছে, তার বৃত্তান্তও পুরো জানা যায়নি। ছবিটিতে যিনি একেবারে ঘরোয়া পরিবেশে লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী পরা রবীন্দ্রনাথের হাত একাগ্র মনে দেখছেন, তিনিই বা কে? সঙ্গে নন্দলাল বসুর ছবি থাকতে অনুমান, ইনিই তাঁর সেই বন্ধু গণৎকার। রবীন্দ্রনাথের পাশে চেয়ারে বসা নন্দলাল বসু ছাড়াও ছবিতে রয়েছেন আরও দুইজন শিল্পী – দাঁড়িয়ে ঝুঁকে সুরেন্দ্রনাথ কর এবং একেবারে ডানপাশে রামকিংকর বেইজ। যে মহিলা রবীন্দ্রনাথের পিছনে দাঁড়িয়ে, তিনিও ঠাকুর বাড়ির কেউ নন, শান্তিনিকেতনের এক ছাত্রী, নাম গীতা রায়। ছবিটি সম্ভবত ১৯২৯ সালে তপতী অভিনয়ের সময় তোলা।
এই দুস্প্রাপ্য ছবি হঠাৎ চোখে চমক লাগায়। সেই বয়সে প্রায় সব সময়েই রবীন্দ্রনাথ বক্তা অন্যেরা শ্রোতা। এক্ষেত্রে প্রধান বক্তা ওই গণৎকার। বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন নয়, রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ বা কৌতূহল যাই বলুন, চোখে মুখে স্পষ্ট। কিন্তু গণৎকার ভদ্রলোক কি বলেছিলেন খ্যাতির চূড়ায় অধিষ্টিত এই পূর্ণ মানবকে? তাঁর মনের কথা, তাঁর দুঃখের কথা? জনতার মধ্যেও নিঃসঙ্গ, ঘনিষ্ট হয়েও দুরতিক্রম্য, শোকে সংযত, যশে উদাসীন এই অসাধারণ মানুষটি সম্পর্কে গণৎকাররা দূরে থাক, সামান্য আভাস দেওয়া ছাড়া তিনি নিজেও কি সবকিছু বলতে পেরেছেন তাঁর সৃষ্টিতে? মনে হয় না।
তবে জ্যোতিষ শাস্ত্র নিয়ে হেমন্তবালা দেবী রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, -
শ্ৰীচরণেষু— দাদা, আমার গ্রহে দৃঢ় বিশ্বাস আছে। ভক্তি করার কথা হচ্ছে না। আমি বিশ্বাস করি না যে নবগ্রহস্তোত্র পড়লেই গ্রহের গতি ফিরবে। কারণ, আমার মতে গ্রহ প্রাকৃতিক শক্তি, গ্রহের দেবতা থাকেন তো থাকুন, যেমন রাগ রাগিণীর দেবতা আছেন । … গ্রহসংস্থান দ্বারা ম্যালেরিয়া দূর হবে কিনা তারও বিচার হয়। ঝড়বৃষ্টি, ভূমিকম্প, যুদ্ধবিগ্রহ, আকস্মিক দুর্ঘটনার বিচারও হয় । আপনি পরীক্ষা করে? দেখুন, এইমাত্র আমার নিবেদন । আপনি ভক্তি না করুন, ভক্তি চাই না । পুরুষকার দ্বারা গ্রহখণ্ডন হয় কিনা, জানি না। আমার মতে হয় না । যার কোষ্ঠীতে ঐ খণ্ডনের ব্যাপারও আছে অন্য গ্রহের যোগে, তারই গ্রহখণ্ডন হয়, অন্যের হয় না। বিশ্ববিধাতা আমাদের কার্য্যপ্রণালী নিৰ্দ্ধারিত করে দিয়েছেন, জন্মের ষষ্ঠ দিনে নয়, মাতৃগর্ভে আসবার সঙ্গে সঙ্গেই । সেইটেই স্বব্যক্ত হয় ভূমিষ্ঠকালে । গ্রহ যেন ঘড়ি। ঘড়ির হুকুমে সময় চলে না, সময়ের তালেই ঘড়ি চলে। তবুও, ঘড়ি দেখেই সময় ঠিক করতে হয় । তেমনি গ্রহ বিধাতার উপর টেক্কা দেয় না, বিধাতার ইচ্ছাকেই গ্রহ প্রকাশ করে । কোষ্ঠী দেখে সেটা আমরা বুঝতে পারি। আমার এই বিশ্বাস যদি ভ্রান্ত হয়, সেটা আপনি প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিন। গ্রহের সঙ্গে হিন্দুধৰ্ম্মের সম্পর্ক নেই। গ্রহ সকলের নিয়ামক । তবে হিন্দুরা এই শাস্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন বলে’ তাই জ্যোতিষ হিন্দুয়ানির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে । আমি তর্ক করছি না, জানতে চাই যে, গ্রহ সত্যই বুজরুকির ব্যাপার কিনা ? আপনার ন্যায় ব্যক্তি যে জিনিষটি উড়িয়ে দেন, সেটি অন্য পণ্ডিত ও বুদ্ধিমান লোক কোন সাহসে আঁকড়ে আছেন ? আমি সেইজন্য কোষ্ঠী বিচার করে জানতে চাই যে, জ্যোতিষ সত্য কিনা ? গোবর যে শুচি, এর প্রমাণ দেওয়া শক্ত, ওটা অভ্যস্ত সংস্কার মাত্র । কিন্তু, গ্রহ যে সত্য, এর প্রমাণ দেওয়া খুবই সোজা— বিচার করে দেখলেই হ’ল। তবে কি পুরুস্কার মানব না ? মানব । সে এইভাবে, যেমন মুমূর্ষ, রোগীরও চিকিৎসা করা হয়, সে মরবে জেনেও । আমার এত দৃঢ় করে বলা স্পৰ্দ্ধা, কিন্তু স্পৰ্দ্ধা করছি না দাদা, আমার বিশ্বাসটা নিবেদন করছি মাত্র ।
গ্রহ সম্বন্ধে দু’খানা বই,– আপনি দয়া করে একটু চোখ বুলিয়ে দেখবেন এবং অন্ততঃ একজনের জন্মসময় আমাকে জানালে আমি সমস্ত ফলাফল এনে দেব, মিলিয়ে দেখে যদি ঠিক না হয়, আমি গ্রহকে আর মানব না। আমার মঙ্গলের জন্যই আশা করি আপনি এটা করবেন। আপনার স্নেহের ওপর নির্ভর করেই আমি এত স্পৰ্দ্ধা প্রকাশ করছি দাদা— রাগ বা বিরক্তির কথা মনে আনবেন না— দুটি পায়ে পড়ি । প্রণাম নিবেদন ইতি আপনার সেবিকা
ঋণঃ রবীন্দ্ররচনাবলী। চিঠিপত্র – প্রথম খণ্ড। ছিন্নপত্র। একত্রে রবীন্দ্রনাথ – অমিতাভ চৌধুরি। ইন্টারনেট।
0 comments