মহাত্মা গান্ধীর সংগ্রামী জীবনে নারীর ভূমিকা ও নারীর অনুপ্রেরণা

মহাত্মা গান্ধীর সংগ্রামী জীবনে নারীর ভূমিকা ও নারীর অনুপ্রেরণা

মহাত্মা গান্ধীর সংগ্রামী জীবনে নারীর ভূমিকা ও নারীর অনুপ্রেরণা

 

নারীর ভূমিকা

চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ নারীদের মুক্ত আকাশের নিচে রাজপথে নিয়ে এসেছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ইংরেজদের বেড়ি ছিঁড়ে বের হতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরা স্বাধীনতা আন্দোলনে নামায় সেই আন্দোলন সম্পূর্ণতা পেয়েছিল। আর এর পুরো অবদান গান্ধীজীর।

মূলত গান্ধীজীর ডাকেই ভারতের রাজনীতিতে মহিলাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা গিয়েছে। এর পিছনে অন্যতম কারণ হতে পারে গান্ধীজীর অহিংসানীতি। রাজনৈতিক পন্থা হিসাবে অহিংসানীতি মহিলাদের মানসিক গঠনের সঙ্গে অনেকটা মিলে যাওয়াতেই তাঁরা গান্ধীজীর পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, 1922 সালের সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সভায় অংশগ্রহণকারী 350 সদস্যের মধ্যে মাত্র 16 জন মহিলা প্রতিনিধি ছিলেন। তবে অন্য চিত্র ছিল গান্ধীজীর নেতৃত্বে চম্পারণ আন্দোলনে মহিলাদের অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে। প্রাথমিক ভাবে 25 জন সত্যাগ্রহীকে নিয়ে শুরু করা গান্ধীজীর চম্পারণ সত্যাগ্রহে 12 জন মহিলা ছিলেন।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

পরবর্তীকালে 1921 সালে অসহযোগ আন্দোলনেও ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নেন মহিলারা। গান্ধীজী মনে করতেন সমাজের পুরুষদের সমান স্থান প্রাপ্য মহিলাদের। তাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের অংশগ্রহণ খুব দরকার। গান্ধজীর প্রদর্শিত পথেই 1925 সালে কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদে প্রথমবার কোনও নারী আসীন হন। তাঁর নাম, সরোজিনী নাইডু।

1933 সালে গান্ধীজীর হরিজন উন্নয়ন যাত্রাতেও বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল মহিলারা। গান্ধীজীর আন্দোলনে শুধু পা মেলানোই নয়, অর্থ জোগান দিতে নিজেদের গয়না পর্যন্ত দান করেছিল তারা। সেই আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি ছিলেন সরোজিনী নাইডু। সঙ্গে ছিলেন কমলা দেবী চট্টোপাধ্যায় ও আরও অনেক মহিলারা । এমন কী হিজাবের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে গান্ধীজীর খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন রক্ষণশীল পরিবারের মুসলিম নারীরাও। এমনকি অহিংস আন্দোলন সংগঠিত করে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সুচেতা কৃপালাণী । এছাড়া জওহরলাল নেহরুর বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতও গান্ধীর সংস্পর্শে আসেন এবং পরাধীনতা থেকে ভারত মুক্তির শপথে দীক্ষিত হন।

নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে গান্ধীজী মন্তব্য করেছিলেন, "ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস যখন লেখা হবে নারীদের বীরত্বের কথা সেই ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি জায়গা দখল করবে ।"

নারীর অনুপ্রেরণা:

যে নারীদের অনুপ্রেরণা মহাত্মা গান্ধীজীর জীবনে ও আদর্শে একটা বড়সড় প্রভাব ফেলেছে, পারিবারিক ক্ষেত্রে পত্নী কস্তুরীবাঈয়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। গান্ধীজীর জীবনাচরণকে তিনি বারে বারে প্রভাবিত করেছেন। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বালক ও ছাত্রাবস্থায় বিবাহ করেন কস্তুরবাকে। বাল্যবিবাহ হলেও কখনও অসংযমী ছিলেন না দু’জনে। বিবাহ হয় ১৮৮২ সালে। গান্ধীজী ব্যারিস্টারি পাশ করে দক্ষিণ আফ্রিকা গেলে স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যান এবং বিলাতি আদবকায়দা ও খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত করান। পরে সবরমতী আশ্রমে আশ্রমিক জীবনের কড়া অনুশাসন গ্রহণ করতে বাধ্য হন কস্তুরবা। তবু মুখ বুঝে নতমস্তকে গান্ধীর সব আদেশ মান্য করেন। চারটি পুত্র সন্তানের জননী হয়েও শরীরের যত্ন নেননি সেভাবে কোনওদিন। ভগ্নস্বাস্থ্য নিয়েও অকপটে ঘরে-বাইরে কাজ করে গেছেন। গান্ধী তাঁকে ভালোবেসে ‘বা’ বলে সম্বোধন করতেন।

আর একজন মেডেলিন স্লেড ওরফে মীরাবেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল স্যার এডমন্ড স্লেডের কন্যা। উচ্চপদস্থ এক ব্রিটিশ অফিসারের মেয়ে হওয়ার কারণে তাঁর প্রথম জীবনটা ছিল কঠোর অনুশাসনে বাঁধা।

স্লেডের লেখা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সেই জীবনী মেডেলিন স্লেডের জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল, যে তিনি গান্ধীজীর পথেই চলার সিদ্ধান্ত নেন। এতটাই রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন মেডেলিন যে, গান্ধীজীকে নিজের মনের কথা জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতেই জানিয়েছিলেন যে, গান্ধী-আশ্রমে আসতে চান তিনি। মদ ছেড়ে দিয়েছিলেন, চাষবাসের কাজ শিখতে শুরু করেছিলেন, এমন কি নিরামিষাশীও হয়ে গিয়েছিলেন মেডেলিন স্লেড। নিয়মিত পড়তে শুরু করেছিলেন গান্ধীজীর সম্পাদিত কাগজ `ইয়ং ইন্ডিয়া`। অবশেষে, ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে মুম্বাই হয়ে আহমেদাবাদে পৌঁছিয়েছিলেন মেডেলিন স্লেড।

জন্মসূত্রে বাঙালী ছিলেন আভা গান্ধী। তাঁর বিয়ে হয়েছিল গান্ধীজীর সম্পর্কে নাতি কানু গান্ধীর সঙ্গে। গান্ধীজীর সব প্রার্থনা সভায় ভজন গাইতেন আভা আর ছবি তুলতেন তাঁর স্বামী কানু। শেষমেশ, যখন নাথুরাম গডসে গান্ধীজীকে গুলি করে হত্যা করে, তখনও পাশেই ছিলেন আভা গান্ধী। ভারতের স্বাধীনতার সময়ে দাঙ্গা বিধ্বস্ত নোয়াখালীতে আভা গান্ধী আর মনু গান্ধীই ছিলেন গান্ধীজীর ছায়াসঙ্গী। গান্ধীজীর যে অতি পরিচিত ছবিগুলো দেখতে পাওয়া যায়, তার অনেকগুলিতেই গান্ধীজী যে দুই নারীর কাঁধে ভর দিয়ে চলতেন, সেই দুজন ছিলেন আভা গান্ধী আর মনু গান্ধী।

একবার গান্ধীজীর বিরোধীরা তাঁর যাওয়ার রাস্তায় মল-মূত্র ফেলে রেখে দিয়েছিল। ঝাড়ু হাতে সেগুলো পরিষ্কার করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন আভা আর মনু গান্ধীই। মনু গান্ধীর ডায়েরীর পাতাগুলোয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনের শেষ কয়েক বছরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়।

মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন আরেক বিদেশিনী নীলা ক্র্যাম কুক। আদতে মার্কিন নাগরিক মিজ কুক মাইসোরের রাজকুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। সেখানে থাকার আগে রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে এক ধর্মীয় গুরুর কাছেও থাকতেন তিনি।১৯৩২ সালে প্রথমবার নীলা চিঠি লেখেন মহাত্মা গান্ধীকে। ব্যাঙ্গালোর থেকে পাঠানো সেই চিঠিতে তিনি অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সেখানে ঠিক কী হচ্ছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে শুধু চিঠিতেই দুজনের যোগাযোগ ছিল। গান্ধীজীই তাঁকে সবরমতী আশ্রমে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। উদার চিন্তাভাবনার মিজ কুকের পক্ষে গান্ধী-আশ্রমের পরিবেশে বেশী দিন মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় নি। একদিন হঠাৎই তিনি আশ্রম থেকে পালিয়ে যান। পরে তাঁকে বৃন্দাবনে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবী চৌধুরাণী গান্ধীজীর ভক্ত ছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত, সৌম্য দর্শন সরলা দেবী বিভিন্ন ভাষাচর্চা, সঙ্গীত আর লেখালেখির মধ্যেই থাকতে পছন্দ করতেন।তাঁর স্বামী, স্বাধীনতা সংগ্রামী রামভূজ দত্ত চৌধুরী যখন জেলে ছিলেন, সেই সময়ে একবার লাহোরে গিয়ে গান্ধীজী তাঁর বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ মি. দত্ত চৌধুরীর বাড়িতেই উঠেছিলেন। সেই সফরের সময়েই সরলাদেবীর সঙ্গে গান্ধীজীর ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়।

সরলাদেবীকে নিজের `আধ্যাত্মিক পত্নী` বলে মনে করতেন গান্ধী। পরে অবশ্য নিজেই স্বীকার করেছিলেন, যে ওই সম্পর্কের কারণে তাঁর বিবাহ ভেঙ্গে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। শেষমেশ অবশ্য গান্ধীজীর বিয়ে ভাঙ্গেনি। কিন্ত দুজনের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা পৌঁছতে শুরু করেছিল গান্ধীজীর ঘনিষ্ঠদের কানেও। হঠাৎই নিজেকে সরলাদেবীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন গান্ধীজী।

গান্ধীজীর আরেক ঘনিষ্ঠ নারী ছিলেন সরোজিনী নাইডু। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সভাপতি ছিলেন তিনি। দুজনের প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল লন্ডনে। সেই বিষয়ে সরোজিনী নাইডু লিখেছিলেন, “একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ। মাথায় একটাও চুল নেই। মেঝেতে কম্বল পেতে বসে তিনি তেলে ভেজানো টম্যাটো খাচ্ছিলেন তখন। সারা পৃথিবীর মানুষ তখন গান্ধীজীকে চেনে। সেই মানুষটাকে ওইভাবে দেখে আমি হেসে ফেলেছিলাম। উনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, `নিশ্চয়ই আপনিই মিসেস নাইডু? এতটা অশ্রদ্ধা আর কে-ই বা করতে পারে আমাকে? আসুন, আমার সঙ্গে খাবার শেয়ার করুন”। এইভাবেই সরোজিনী নাইডু আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল।

রাজকুমারী অমৃত কৌর পড়াশোনা করেছেন ইংল্যান্ডে। ১৯৩৪ সালে প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকে গান্ধীজী আর রাজকুমারীর মধ্যে অসংখ্য চিঠি চালাচালি হয়েছে। অমৃত কৌরকে লেখা চিঠিগুলো গান্ধীজী শুরু করতেন এইভাবে- ‘আমার প্রিয় পাগলী আর বিদ্রোহী’ বলে। অমৃত কৌরকে গান্ধীজীর সবথেকে ঘনিষ্ঠ সত্যাগ্রহীদের মধ্যে একজন বলে মনে করা হত। লবণ সত্যাগ্রহ বা ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জেলেও যেতে হয়েছে রাজকুমারী অমৃত কৌরকে। পরে স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাস্থ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন অমৃত কৌর।

ডা. সুশীলা নায়ার (১৯১৪-২০০১) ছিলেন গান্ধীজীর ব্যক্তিগত সচিব পেয়ারেলালের বোন। দীর্ঘদিন সচিবের কাজ সামলিয়েছেন যে মহাদেব দেশাই, তাঁর পরে পাঞ্জাবী পরিবার থেকে আসা পেয়ারেলাল গান্ধীজীর সচিব হয়েছিলেন। নিজেদের মায়ের অনেক বিরোধিতার সত্ত্বেও দুই ভাই বোন হাজির হয়েছিলেন গান্ধীজীর কাছে। দুই ছেলে মেয়ে গান্ধীজীর কাছে চলে গেছে বলে যে মা প্রথমে কাঁদতেন, পরে অবশ্য সেই তিনিও গান্ধীজীর কট্টর সমর্থক হয়ে গিয়েছিলেন।

ডাক্তারী পাশ করে সুশীলা গান্ধীজীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হয়ে গিয়েছিলেন। মনু আর আভা ছাড়া গান্ধীজীর আর যে একজনের কাঁধে ভর দিয়ে বিভিন্ন সভায় বা প্রার্থনায় যেতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সুশীলা।

ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে যখন গান্ধীজীর স্ত্রী কস্তুরবা মুম্বাইতে গ্রেপ্তার হলেন, তখন একই সঙ্গে কারাবরণ করেছিলেন সুশীলাও। পুনেতে কস্তুরবা শেষ সময়েতেও পাশে ছিলেন সুশীলাই। আর ব্রহ্মচর্যের যে অভ্যাস করতেন গান্ধী, তাতেও সাহায্য করতেন সুশীলা।

ঋণ: বিবিসি/ই্টিভি

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait