বছর বছর ভাইরাস এসে রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) আপনজনদের কেড়ে নেয়। হ্যাঁ সেসময়ও গঙ্গা নদী দিয়ে বয়ে গেছে শয়ে শয়ে লাশ। ছিল অক্সিজেনের অপ্রতুলতা - ভ্যাক্সিনেশন কম। সঙ্গে যোগ দিয়েছিল ভ্যাক্সিন (Vaccine) নিয়ে কুসংস্কারের লড়াই। ঘটনাটা খুব একটা পুরনো নয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় অর্থাৎ ১৮৬১ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত।
হ্যাঁ আজকের এই করোনা ভাইরাসের মত তখনও নানারকম ভাইরাসের তান্ডবের শিকার হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য শিশু বয়সে ঘরও ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। ইনফ্লুয়েঞ্জা বা যুদ্ধজ্বর ভাইরাসে নিজে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাছাড়াও বছর বছর নানারকম [প্লেগ, কলেরা, বসন্ত, যক্ষা, ইনফ্লুয়েঞ্জা বা যুদ্ধজ্বর] ভাইরাসের তান্ডবে হারাতে হয়েছিল খুব কাছের আপনজকে।
তফাৎ একটাই: মাঝখানের একশো বছরে বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে, হয়তো আমাদের চিন্তাচেতনাও। কিন্তু বদলায়নি সেই ছবি - অক্সিজেনের অপ্রতুলতা - ভ্যাক্সিনেশন কম আর গঙ্গা নদী দিয়ে বয়ে যাওয়া শয়ে শয়ে লাশ।
ডেঙ্গু ভাইরাসের দাপটে – শৈশবে ঘর ছাড়তে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথকে। স্কুল বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার।
১৮৭২ সাল, রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন কেবল ১১। কলকাতায় ভীষণরকম ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। প্রশান্তকমার পাল এর বর্ণনা অনুযায়ী: [1872] কলকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপে প্রথমবার পড়াশুনোয় ছেদ পড়ে…। ছোট্ট রবিকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরবাড়ির বৃহৎ পরিবারের অনেকেই ডেঙ্গু থেকে আত্মরক্ষার জন্য ১৮৭২ সালের ১৪ মে মঙ্গলবার থেকে ৩০ জুন রবিবার পর্যন্ত কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে গঙ্গাতীরবর্তী পানিহাটির বাগানবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ন্যাশন্যাল পেপার এ সে সম্বন্ধে লিখেছিল: “The dengue is now in violent range in Calcutta, sparing neither age, sex, or rank. The fever is rife in European quarter too.”… [8 May 1872].
ন্যাশন্যাল পেপার আরও লেখে, “এই ব্যধির প্রকোপে বহু স্কুল কলেজে ছাত্র ও শিক্ষকের উপস্থিতি এত কমে যায় যে প্রতিষ্ঠানগুলিতে ছুটি ঘোষণা করে দিতে হয়”।
প্রচণ্ড জ্বর, গায়ে ব্যথা ইত্যাদি উপসর্গযুক্ত এই ব্যধি মাত্র তিন-চারদিনে রোগীকে এমন দুর্বল করে দেয় যে তার পরেও বেশ কিছুদিন তাকে প্রায় পঙ্গুজীবন যাপন করতে হয়, সমসাময়িক পত্রিকার বিবরণে রোগটিকে এইভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন: একবার কলিকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে ছাতুবাবুদের বাগানে আশ্রয় লইল। আমরা তাহার মধ্যে ছিলাম।
এইসময় রবীন্দ্রনাথের উপনয়ন হয়। এরপর বর্ষার শেষাশেষি ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ অনেকটা কমে এলে তাঁরা আবার জোড়াসাঁকোয় ফিরে যান। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: জোড়াসাঁকোর বাড়িতে আবার ফিরিলাম। আমার দিনগুলি নর্মাল স্কুলের হাঁ-করা মুখবিবরের মধ্যে তাহার প্রাত্যহিক বরাদ্দ গ্রাসপিণ্ডের মতো প্রবেশ করিতে লাগিল।
পরবর্তীকালে কবি পূণর্মিলন’ কবিতায় সেই বাগানবাড়ির ছবি স্মৃতিতে ধরে রেখেছেন – “আরেকটি ছোটো ঘর মনে পড়ে নদীকূলে, সম্মুখে পেয়ারাগাছ ভরে আছে ফলে ফুলে”।
প্লেগ ভাইরাস কেড়ে নিয়েছিল অবনঠাকুরের মেয়ে ও সুরেন্দ্রনাথের পুত্র সমীরেন্দ্রনাথ
১৪ বৈশাখ ১৩০৫, ২৬ এপ্রিল ১৮৯৮ রবীন্দ্রনাথ তখন শান্তিনিকেতেনে, খবর পেলেন, ‘কলিকাতায় প্লেগ আসিয়াছে।’ তার কয়েকদিন আগে ১০ বৈশাখ ১৩০৫ [22 Apr 1898] রথীন্দ্রনাথের অন্নপ্রাশন হয়। ৮ বা ৯ বৈশাখ তিনি কলকাতা থেকে শান্তিনিকেতনে আসেন। সম্ভবত ১৩ বৈশাখ সমাবর্তন [সোম 25 Apr 1898] অনুষ্ঠানটি হয়েছিল। রথীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘শান্তিনিকেতনে ধুম পড়ে গেল’। তবুও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শান্তিনিকেতনে বেশিদিন থাকতে পারলেন না। ১৪ বৈশাখেই তাঁকে পার্কস্ট্রীট যেতে ও শ্রীমতী ছোটবধূ ঠাকূরাণীকে টেলিগ্রাম করতে দেখা যায়। ‘কবিকেশরী’ লেখক লিখেছেন – ‘রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে থাকিয়া নিশ্চিন্তমনে তথাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সন্দর্শনকরতঃ পরমানন্দ উপভোগ করিতেছিলেন। এমন সময় তথায় সংবাদ পঁহুছিল কলিকাতায় প্লেগ আসিয়াছে।’ বোম্বাই অঞ্চলে প্লেগের ভয়াবহ আক্রমণের বিবরণে গত এক বছরের সংবাদপত্র পূর্ণ ছিল— কলকাতায় যাতে তার সংক্রমণ ঘটতে না পারে তার জন্য বাংলার বিভিন্ন স্থানে বহিরাগতদের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও ১২-১৩ বৈশাখের সংবাদপত্রে যখন প্লেগাক্রান্ত দু’-একটি রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার সংবাদ প্রকাশিত হল, তখন শহরবাসীর মধ্যে এক ভয়ানক আতঙ্ক দেখা দিল। ‘... ১৫ ১৬ ও ১৭ বৈশাখ শহরে জনস্রোতের বিরাম ছিল না। শহরের গাড়ি পাল্কী ক্রমশ দুর্মূল্য হইয়া উঠিল— অবশেষে তাহাও অপ্রাপ্য হইয়া উঠিল।… যখন গাড়ি পাল্কী পাওয়া একেবারে দুর্লভ হইয়া পড়িল, তখন এই দুর্বিপাকে পড়িয়া কত ভদ্র পরিবারের অসূর্যম্পশ্যা রমণী কলিকাতা সহরের রাজপথে বহিষ্কৃত হইয়া পদব্রজে চলিয়া গিয়াছে— কে তাহার গণনা করিয়াছে।’ তখনকার অমৃতবাজার পত্রিকা এই ঘটনাকে 'The Exodus of the East Bengal People and the Marwaris' বলে বর্ণনা করেছে। প্লেগের টিকা দেওয়া নিয়ে ৩ মে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গা বাধে— প্রধানত ইউরোপীয়রা এই দাঙ্গার লক্ষ্য।
অবনীন্দ্রনাথ লিখছেন: “সেই সময়ে কলকাতায় লাগল প্লেগ। চারদিকে মহামারী চলছে, ঘরে ঘরে লোক মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। রবিকাকা এবং আমরা এবাড়ির সবাই মিলে চাঁদা তুলে প্লেগ হাসপাতাল খুলেছি, চুন বিলি করছি। রবিকাকা ও সিস্টার নিবেদিতা পাড়ায় পাড়ায় ইন্পেক্শনে যেতেন। নার্স ডাক্তার সব রাখা হয়েছিল। সেই প্লেগ লাগল আমারও মনে। ছবি আঁকার দিকে না ঘেঁষে আরো গানবাজনায় মন দিলুম। চারদিকে প্লেগ আর আমি বসে বাজনা বাজাই। হবি তো হ, সেই প্লেগ এসে ঢুকল আমারই ঘরে। আমার ছোট্ট মেয়েটাকে নিয়ে গেল। ফুলের মতন মেয়েটি ছিল, বড় আদরের। আমার মা বলতেন, ‘এই মেয়েটিই অবনের সবচেয়ে সুন্দর।’ ন-দশ বছরের মেয়েটি আমার টুক করে চলে গেল; বুকটা ভেঙে গেল। কিছুতে আর মন যায় না। এ বাড়ি ছেড়ে—চৌরঙ্গিতে একটা বাড়িতে আমরা পালিয়ে গেলুম। সেখানে থাকি, একটা টিয়েপাখি কিনলুম, তাকে ছোলা ছাতু খাওয়াই, মেয়ের মাও খাওয়ায়। পাখিটাকে বুলি শেখাই। দুঃখ ভোলাবার সাথি হল পাখির ছানাটা; নাম দিলেম তার চঞ্চু, মায়ের কোলছাড়া টিয়াপাখির ছানা”।
অবনঠাকুরের ছোট মেয়ের মত প্লেগ- কেড়ে গিয়েছিল সুরেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র সমীরেন্দ্রনাথকে। প্রশান্তকুমার পাল লিখছেন: প্লেগ সম্পর্কে পত্রিকায় বিদ্রোহাত্মক প্রবন্ধ লেখার অভিযোগে বালগঙ্গাধর তিলককে গ্রেপ্তার করে দেড় বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি কলকাতায় যখন প্লেগ দেখা দেয় তখন প্লেগের টীকা নেওয়া নিয়ে যে দাঙ্গা বাধে 4th May 1898 [বুধ ২২ বৈশাখ ১৩০৫] – ঐ দাঙ্গার একটি প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ পাওয়া যায় নিবেদিতার রচনায়।
Day after day, Last week, from the terrace of our little villa on the Ganges, we watched crowds of tiny boats come up from Calcutta and speed past us to the West. They were laden with the families and household effects of Hindus and Mussulmans flying in terror from a city in which—not the plague was likely to find foothold, … A few great Hindu families, notably the Tagores, stood firm, in the hope of allaying the agitation, but noting availed till at noon on Saturday the Government issued a proclamation announcing that optional inoculation was to make segregation unnecessary, and that the feelings of the people would be respected as far as possible even in case of an epidemic.
অর্থাৎ এই বিক্ষোভ প্রশমিত করতে ঠাকুর বাড়ির সদস্যদের ভূমিকার প্রশংসাই করেছিলেন নিবেদিতা।
প্লেগের ভয়াবহতার কারণে বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু ভয়ে বাড়ি পরিবর্তন করে বন্ধু রবীন্দ্রনাথকে লিখেছিলেন, “সুহৃদ্বরেষু— উপরের ঠিকানা হইতে বুঝিতে পারিয়াছেন, যে, আমি পলাতক—প্লেগের অনুগ্রহে। আমার একজন ভৃত্য ছুটী লইয়া একদিন বড়বাজার গিয়াছিল । সেখান হইতে আসিয়া একদিন পরেই প্লেগ হয়। আর ৩০ ঘণ্টার মধ্যেই মৃত্যু। বাড়ী ছাড়িয়া আসিয়া উক্ত ঠিকানায় আছি—কতদিন পলায়ন চলিবে জানি না।
এই সময় বেঙ্গল লাইব্রেরীর ক্যাটালগ অনুযায়ী রবীন্দ্রনাথ সম্পাদিত যথাক্রমে পাঁচটি লেখা প্রকাশ পায় - ‘দুঃসময়’, ‘দুরাশা’, ‘কন্ঠরোধ’, ‘বঙ্গভাষা’ এবং –‘প্রসঙ্গ-কথা’।
কলেরা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের কনিষ্ট পুত্র শমীন্দ্রনাথকে
প্লেগের সন্ত্রাস থাকতে থাকতেই ১৯০৭ সালে কলেরাও মারাত্মক আকার নেয়। ঠাকুরবাড়িতেও মৃত্যু হানা দেয়। ১৮১৭ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত সাতবার কলেরা অতিমারী দেখা দিয়েছিল ভারতে। ষষ্ঠ কলেরা-অতিমারি দেখা দিয়েছিল ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে। দেশ জুড়ে প্রাণ নিয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার মানুষের। কলেরা অতিমারীর প্রকোপ তখনও রয়েছে। প্রশান্তকুমার পালের মতে কবি এইসময় ১১ আশ্বিন [শনি 5 Oct 1907] মীরাদেবীর স্বাস্থ্য নিয়ে বিব্রত ছিলেন। পূজোর ছুটিতে শমীন্দ্রনাথকে কোথায় রাখবেন তা নিয়েও ভাবনা ছিল। তাই সোমবার ২৭ আশ্বিন [সোম 14 Oct] শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লেখেন, “কলিকাতায় শমী আসতে চায় না। বোলপুরেও তার একলা ঠেকচে। এই কারণে মনে করচি তাকে দুই-তিন দিনের মধ্যে মুঙ্গের পাঠিয়ে দেব। অসুবিধা হবে না ত? জগদানন্দ তাকে পৌঁছে দিয়ে চলে আসবেন। ভেবেছিলুম সুবোধের সঙ্গে তাকে দিল্লী পাঠাব কিন্তু দিল্লীতে ম্যালেরিয়ার প্রাদূর্ভাব বলে পিছতে হল। শমী এত অল্প জায়গা জোড়ে এবং এত নিরুপদ্রব যে তার আগমনে তোমাদের মুঙ্গেরের শহরের শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা নেই। … আগামীকল্য বোলপুরে গিয়ে শমীকে রওনা করে দেবার ব্যবস্থা করব”।…
সম্ভবত ২৯ আশ্বিন [বুধ 16 Oct 1907] বিজয়াদশমীর দিনে শমীন্দ্রনাথ বন্ধু সরোজচন্দ্র মজুমদারের [ভোলা] মামার বাড়ি মুঙ্গেরে রওনা হন। শমী আর শান্তিনিকেতনে ফিরে আসেননি, কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ৭ অগ্রঃ [রবি 24 Nov] মুঙ্গেরেই তার মৃত্যু হয়।
শমীর মৃত্যুর প্রায় পঁচিশ বছর পরে দৌহিত্র নীতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর মীরা দেবীকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে চিঠিতে এভাবে বর্ণনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: “শমী যে রাত্রে গেল তার পরের রাতে রেলে আসতে আসতে দেখলুম জ্যোৎস্নায় আকাশ ভেসে যাচ্ছে কোথাও কিছু কম পড়েছে তার লক্ষণ নেই। মন বললে কম পড়েনি – সমস্তের মধ্যে সবই রয়ে গেছে, আমিও তারি মধ্যে। সমস্তর মধ্যে আমার কাজও বাকি রইল। যতদিন আছি সেই কাজের ধারা চলতে থাকবে। সাহস যেন থাকে, অবসাদ যেন না আসে, কোনোখানে কোনো সূত্র যেন ছিন্ন না হয়ে যায় – যা ঘটেছে তাকে যেন সহজে স্বীকার করি, যা কিছু রয়ে গেল তাঁকেও যেন সম্পুর্ণ সহজ মনে স্বীকার করতে ত্রুটি না ঘটে…”।
পরবর্তীকালে ‘গোরা’ উপন্যাসে হরিমোহিনীর স্বামী ও পুত্রের মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে নিজের দুঃখের কথাই যেন ব্যক্ত করলেন তিনি, -
“একদিন আমার যেমন অনাদর ও কষ্ট গিয়াছে, কপাল ভাঙিবার পূর্বে বিধাতা কিছু দিনের জন্য আমাকে তেমনি সুখ দিয়াছিলেন। শেষাশেষি আমার স্বামী আমাকে বড়োই আদর ও শ্রদ্ধা করিতেন, আমার সঙ্গে পরামর্শ না করিয়া কোনো কাজই করিতেন না। এত সৌভাগ্য আমার সহিবে কেন? কলেরা হইয়া চারি দিনের ব্যবধানে আমার ছেলে ও স্বামী মারা গেলেন”।
প্রশান্তকুমার পালের তথ্য অনুযায়ী সেই সময় [অগ্রহায়ণ ১৩১৪ – Nov 1907] রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য রচনা – ‘গোরা’। গান – ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর’। ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপনে চাই’। ‘অমল কমল সহজে জলের কোলে’।
‘ইনফ্লুয়েঞ্জা’ বা ‘যুদ্ধজ্বর’ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ, মীরাদেবী ও নীতু। আক্রান্ত। প্রাণ কেড়ে নেয় সুকেশী দেবী, অজিতকুমার এবং মীরাদেবীর দেবর শান্তিকে।
১৯১৮ সালের জুনে প্রধানত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত সৈন্যরাই জাহাজে করে বয়ে নিয়ে আসেন এই যুদ্ধজ্বরের ভাইরাস। ৪ মার্চ, ১৯১৮ সালে আমেরিকার কানসাসের ফোর্ট রাইলিতে একদিনে প্রায় একশো জন সৈন্যের হঠাৎ করেই জ্বর, মাথাব্যথা এবং গলাব্যথা হয়। এমনকি শান্তিনিকেতনে, বড় এবং ছোট অর্থে রবীন্দ্র-পরিবারে, জোর হানা দিয়েছিল যুদ্ধজ্বর। তরুণরা আর মেয়েরাই এতে মরেছিল বেশি। ৯ পৌষ সকালে মেয়েদের ‘আনন্দবাজার’ বসেছিল সেখানে দ্বিজেন্দ্রনাথের কনিষ্ঠ পুত্র কৃতীন্দ্রনাথের স্ত্রী সুকেশী দেবী এই অনুষ্ঠানে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। কয়েকদিন পর ২ জানুয়ারি ১৯১৯ [১৮ পৌষ ১৩২৫] ইনফ্লুয়েঞ্জা জ্বরে তাঁর মৃত্যু হয়। সাংঘাতিক ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন হেমলতা দেবীও, তিনিও কোনও মতে সেরে ওঠেন। স্বয়ং প্রতিমা দেবী মরণের মুখ থেকে ফিরে আসেন। রথীন্দ্রনাথ শ্রীমতী সেমুরকে লেখেন, প্রায় একমাস যমে-মানুষে টানটানি চলার পর তাঁর প্রাণ রক্ষা হয়। রথীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘Pratima’s health completely brokedown after the severe attack of influenza from which she suffered for over two months. … a guest from Calcutta brought the infection and the three persons who attended her were down with it immediately afterwords. One of my cousins never recovered from it –
তবে রথীন্দ্রনাথের ইঙ্গিত অনুযায়ী, মিল ফেরিং [মাদ্রাজ থেকে গাঁধীর ‘কন্যাসম’ এসথার ফেরিং (Esther Faering, ১৮৮৯-১৯৬২) নাম্নী এক ডেনিশ মহিলাকে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন অ্যান্ড্রুজ] রোগের বীজ বহন করে এনেছিলেন। পৌষোৎসবের সময় মিস ফেরিং নামের একজন ডেনিশ মহিলা শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। আসার কিছুদিন পরেই তিনি ইনফ্লুয়েনঞ্জায় আক্রান্ত হন। অল্পদিনের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও আশ্রমের মহিলাদের মধ্যে যাঁরাই তাঁর সেবা করেছিলেন তাঁদেরঅনেকেই এই রোগের সংক্রমণে অসুস্থ হয়ে ওঠেন। অজিতকুমার চক্রবর্তীও ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর সংকটজনক অবস্থার কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ ১৪ পৌষ ১৩২৫ [রবি 29 Dec 1918] দ্বিজেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লেখেন: “অজিতের অবস্থার কথা শুনে মন বড় উদ্বিগ্ন হল। বুঝতে পারচি কোনও আশা নেই এবং এতক্ষণে হয়ত জীবন অবসান হয়ে গেছে। অল্প বয়স থেকে ও আমার খুব কাছে এসেছিল – ও যদি চলে যায় ত একটা ফাঁক রেখে যাবে”। ওইদিনই অজিতকুমারের জীবনাবসান ঘটে।
মীরা দেবী পুত্র নীতীন্দ্রকে নিয়ে হায়দ্রাবাদে ছিলেন। সেখানে তাঁর কনিষ্ঠ দেবর শান্তির ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে মৃত্যু হয়। এর পরে মীরাদেবী ও নীতুও এই রোগে আক্রান্ত হন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সুস্থ হয়ে ওঠেন। ২ ফাল্গুন ১৩২৫ [শুক্র 14 Feb1919] রবীন্দ্রনাথ মাদুরায় স্থানীয় আমেরিকান মিশনারী কলেজের হলে বিরাট জনসভায় তিনি “The Message of the Forest” প্রবন্ধটি পাঠ করেন। রবীন্দ্রনাথ সেই রাত্রেই তিনি আক্রান্ত হন ইনফ্লুয়েঞ্জায়।
রবীন্দ্রনাথ রানুকে লেখেন [৫ শ্রাবণ ১৩২৫]: “তোমাদের ওখানে এবং এখানে ডাকওয়ালাদের সকলের প্রায় অসুখ হয়েচে, তাই ডাক যেতে আসতে এত দেরি হয়। আমাদের ইস্কুলেও সেই জ্বর এসে পড়েচে । কিন্তু অন্য জায়গার মত তেমন প্রবল নয়। অনেক ছেলেই এখন হাঁসপাতালে গেছে”।
১৯১৯ সালের ১ জানুয়ারি বন্ধু জগদীশচন্দ্র বসুকে সে সময়ের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারির কথা বলে চিঠি লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখছেন, “আমার এখানে প্রায় দু’শো লোক, অথচ হাসপাতাল প্রায়ই শূন্য প’ড়ে আছে— এমন কখনও হয় না— তাই মনে ভাবচি এটা নিশ্চয়ই পাঁচনের গুণে হয়েচে।’ আরও লিখেছেন, “…তার মধ্যে হেমলতা প্রায় সেরে উঠেচেন— কিন্তু সুকেশীর জন্য ভাবনার কারণ আছে। কিন্তু ছেলেদের মধ্যে একটিরও ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়নি। আমার বিশ্বাস, তার কারণ, আমি ওদের বরাবর পঞ্চতিক্ত পাঁচন খাইয়ে আসচি।”
রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের মেয়ে সীতা দেবীর ‘পুণ্য স্মৃতি’ থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথ নিজে রোজ ঘুরে ঘুরে প্রত্যেক অসুস্থ ছাত্রছাত্রীকে দেখতে যেতেন। তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিতেন। এমনকি চিকিৎসাও করতেন। সীতা দেবী লিখছেন, “সে বার তিনি একটি ভেষজ প্রতিষেধক তৈরি করলেন। সেই প্রতিষেধকটির নাম ‘পঞ্চতিক্ত পাঁচন’।”
জলধর সেনের তথ্য অনুযায়ী সেই সময় [1918-19] রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – পৌষ - ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে। মাঘ – মোদের যেমন খেলা। ফাল্গুন – মোদের পাকবে না চুল। ‘স্বর্গ-মর্ত্ত’। ব্রহ্মসংগীত - ভোরের বেলা কখন এসে। ঐ - আমার কন্ঠ তাঁরে ডাকে। ঐ – ভুবনজোড়া আসনখানি। ঐ – দাঁড়িয়ে আছ তুমি আমার। আনন্দ সঙ্গীত – আমাদের ভয় কাহারে।
২০২০-২১ যেন মিলিয়ে দিচ্ছে ১৯১১-২১ এর ঘটনাগুলি
এছাড়া ‘ক্যাশবই’তে ‘‘অকসিজেন গ্যাসের জন্য’’ খরচের কথা উল্লেখ করেছেন রবিজীবনীকার। হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী ‘নিরালা’ (১৮৯৬-১৯৬১) তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, গঙ্গা নদী লাশে থিকথিক করছিল। কারণটা অতি সরল: অত মড়া পোড়ানোর কাঠ ছিল না। ১৯১১-১৯২১ পর্বে ভারতের জনসংখ্যা-বৃদ্ধিহার নেমে আসে ১.২ শতাংশে, যা ব্রিটিশ ভারতের ইতিহাসে ন্যূনতম।
বসন্ত ভাইরাস কেড়ে নেয় ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের অধ্যাপক - সতীশচন্দ্র রায়কে
রবীন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন – “ভারতবর্ষ যে ওলাউঠা রোগের জন্মভূমি, এ সম্বন্ধে সন্দেহ অতি অল্পই আছে। ১৮১৭ খৃস্টাব্দে এই ভীষণ মড়ক বঙ্গদেশ হইতে দিগ্বিজয় করিতে বাহির হইয়া সিন্ধু, য়ুফ্রাটিস, নীল, দানিয়ুব, ভল্গা, অবশেষে আমেরিকার সেন্টলরেন্স এবং মিসিসিপি নদী পার হইয়া দেশবিদেশে হাহাকার ধ্বনি উত্থিত করিয়াছিল”।
একসময় এই বসন্ত রোগকে বলা হতো ‘গুটিবসন্ত’ বা ‘ওলাউঠা’। গ্রামের পর গ্রাম জনশূন্য হয়ে যেত গুটিবসন্ত বা ওলা ওঠা রোগে। ভারতবর্ষে একবার বসন্ত রোগের মারাত্মক প্রকোপ দেখেই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহ, ১২ ফাল্গুন, ১৩০১ [23 Feb 1894] লিখেছিলেন—
কোথা ব্রজবালা! কোথা বনমালা! কোথা বনমালী হরি!
কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।
এই গুটিবসন্ত রোগেরভাবনা চিন্তা রবীন্দ্রনাথের মনে অনেক আগে থেকেই ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ আশ্বিন ১৩০৬ [বৃহ 5 Oct, 1899] রচিত হল ‘অভিসার’। সেখানে কবি বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতার মূল কাহিনীকে অনেক পরিবর্তন করেছিলেন।
রবিজীবনী প্রশান্তকুমার পালের বর্ণনা অনুযায়ী - বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা অন্তর্গত ৭২-সংখ্যক কাহিনী ‘উপগুপ্ত অবদান’ অবলম্বনে এর মূল কাহিনীটি হল: উপগুপ্তের পিতা মথুরার গুপ্ত ইচ্ছা করেছিলেন যে তিনি যেন শোনবাসীর শিষ্য হন। শোনবাসীর প্রতি উপগুপ্তের গভীর শ্রদ্ধা ছিল। বারবণিতা বাসবদত্তা উপগুপ্তের সৌন্দর্য দেখে তাঁকে কামনা করে আহ্বান জানাল। উপগুপ্ত বললেন, “বারবণিতার কাছে যাওয়ার এখন উপযুক্ত সময় নয়। সময় হলেই আমি যাব”। কিছুদিন পরে বাসবদত্তা তার এক প্রণয়ীর প্ররোচনায় অপর এক প্রণয়ীকে বিষপ্রয়োগ করল। তার শাস্তি হল যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু। ঘাতক তার নাক, কান ও চুল কেটে দিল ও বস্ত্রাদি খুলে নিল। একজন বারবণিতার কাছে যাওয়ার উপযুক্ত সময় হয়েছে, ভেবে উপগুপ্ত বাসবদত্তার সম্মুখে উপস্থিত হলেন এবং নিজের ধর্ম্ম সম্পর্কে তাকে উপদেশ দিলেন, যা তাকে গভীর সান্ত্বনা দিল।
রবীন্দ্রনাথ এই কাহিনীকে বিষপ্রয়োগে হত্যা ও নাক-কান কাটা শাস্তির বিভৎসতা থেকে মুক্ত করে বর্ষাভিসার ও বসন্তাভিসারের বৈপরিত্যে নাটকীয় রূপ দান করেছেন।
এই রোগেও রবীন্দ্রনাথ হারালেন সতীশচন্দ্র রায়কে [অধ্যাপক, ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়] ১ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ [১৮ মাঘ ১৩১০ বঙ্গাব্দ] খ্রিষ্টাব্দ, সোমবার, মাঘী পূর্ণিমার দিনে। বসন্ত রোগে। তাঁর বসন্ত রোগটি গুটিবসন্ত বলে জানা যায়। ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ে মাত্র এক বছর শিক্ষকতার পর মৃত্যুবরণ করেন সতীশচন্দ্র রায়। এই শিক্ষকটি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। তাঁর মানুষটির জন্য অত্যন্ত শোক অনুভব করেন। সেই চিঠির এক জায়গায় তিনি বলেন: “সতীশের মৃত্যুতে আমার জীবন ও কর্মের মধ্যে আর খানিকটা শূন্যতা বৃদ্ধি হইল?
অপর এক চিঠিতে অজিতকুমার চক্রবর্তীকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন “সতীশের জীবনটুকু আমাদের বিদ্যালয় এবং আমাদের সাধনার সঙ্গে জড়িত হয়ে গেছে।সে আমাদের বিদ্যালয়কে শক্তিও দিয়েছে, সৌন্দর্যও দিয়েছে... তার সেই জীবনের দানটি ক্রমেই আমাদের কাছে সত্য হয়ে উঠতে থাকবে। .. তার নির্মল জীবনের তীর্থসলিল একেবারে নিঃশেষ ঢেলে দিয়ে সে আমাদের বিদ্যালয়ের অভিষেক করে গেছে”।
সতীশ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ আরও বলেছিলেন: সতীশ প্রতিদিনের ধূলিভস্মের অন্তরালে, কর্মচেষ্টার সহস্র দীনতার মধ্যে শিবের শিবমূর্তি দেখিতে পাইত, তাহার সেই তৃতীয় নেত্র ছিল”।
সেই সময় 1904 - রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – ধর্মপ্রচার। নৌকাডুবি। মনুষ্যত্ব। আমার এ ঘরে আপনার করে। জীবনে আমার যত আনন্দ।
ম্যালেরিয়া: শান্তিনিকেতনবাসী আক্রান্ত হয়েছিলেন অনেকে তবে মৃত্যুর খবর নেই;
প্লেগ যখন শহর খালি করছে তখন গোটা বাংলাতেই দাঁত নখ বের করেছে ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর। ম্যালেরিয়ার শুরুয়াত অবশ্য আনুমানিক ১৮৬১তে। এই রোগ মারীর আক্রমণ করে ১৮৮০ সালে। লেডি ক্যানিং ১৮৬৬ সালে দার্জিলিং যাওয়ার সময় এই জ্বরের প্রকোপে পড়েন। জীবদ্দশায় তাঁর জ্বর সারেনি। শান্তিনিকেতন বাসী অনেকেই ম্যালেরিয়ার কোপে পড়েন। পরবর্তীতে এক অ্যাণ্টি-ম্যালেরিয়া সোসাইটি তৈরি হয় এবং রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা হল, “গাঁয়ে না গেলে বুঝতে পারবেন না ম্যালেরিয়া কী ভীষণ প্রভাব বিস্তার করেছে। অনেকের যকৃৎ-পিলেতে পেট ভর্তি হয়ে আছে, সুতরাং ম্যালেরিয়া দূর করতে হবে-- বেশি করে বুঝবার দরকার নাই। আমরা অনেকে জানি ম্যালেরিয়া কিরকম গোপনে ধীরে ধীরে মানুষকে জীবন্মৃত করে রাখে। এ দেশে অনেক জিনিস হয় না; অনেক জিনিস আরম্ভ করি, শেষ হতে চায় না; অনেক কাজেই দুর্বলতা দেখতে পাই-- পরীক্ষা করলে দেখা যায় ম্যালেরিয়া শরীরের মধ্য থেকে তেজ কেড়ে নিয়েছে”।
সেই বক্তব্যের কথা কবি চিঠিতে রানুকে জানিয়েছেন [১২ ফাল্গুন ১৩৩০]; “ম্যালেরিয়া সভায় বক্তৃতা করে এসেচি’ যে, ম্যালেরিয়া রোগটা ভাল জিনিষ নয়— ওর সঙ্গে প্রেমের সম্বন্ধ পাতিয়ে শ্ৰীমতী ম্যালেরিয়াকে অদ্ধাঙ্গিনী করবার চেষ্টা করলে ও দেখতে দেখতে সৰ্ব্বাঙ্গিনী হয়ে ওঠে। সাধারণত প্রেয়সীরা হৎকমলে স্থান গ্রহণ করে থাকেন কিন্তু শ্ৰীমতী ম্যালেরিয়া হচ্চেন যকৃৎবাসিনী, প্লীহাবিনোদিনী। কবিরা বলে থাকেন প্রেয়সীর আবির্ভাবে হৃদয়ে ঘন ঘন স্পন্দন উপজাত হয়, কিন্তু ম্যালেরিয়ার আবির্ভাবে সৰ্ব্বাঙ্গ মুহুর্মুহু স্পন্দিত হতে থাকে। অবশেষে অত্যন্ত তিক্ত উপায়ে তার বিচ্ছেদ ঘটাতে হয়। কিন্তু তার সঙ্গে একবার মিলন হলে বারে বারে সে ফিরে ফিরে আসে”।
সেই সময় [1923 – 24] - রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য – অ্যান্টি ম্যালেরিয়া সোসাইটির অভিভাষণ। যে কেবল পালিয়ে বেড়ায়। এবার অবগুন্ঠন খোলো। ‘উৎসবের বাঁশি’। মাঘের বুকে সকৌতুকে কে আজি এল। আমার শেষ পারাণির কড়ি। ‘ভাঙা মন্দির’।
যক্ষা ভাইরাস এক এক করে কেড়ে নিল রেনুকা, মাধুরীলতা এবং নীতিন্দ্রকে (নীতু)
এই মুহুর্তে টিবির প্রাদুর্ভাব সাব-সাহারান-আফ্রিকায় সবচেয়ে বেশি এবং ভারত এর মতো এশীয় দেশগুলিতেও তুলনামূলকভাবে বেশি । বিশ্বের বর্তমান জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মাইকোব্যাকটেরিয়াম যক্ষায় সংক্রামিত হচ্ছে এবং নতুন সংক্রমণ প্রতি সেকেন্ডে একই হারে ঘটছে। গবেষকদের গবেষণা অনুযায়ী করোনা মহামারীর সাইডএফেক্ট হিসেবে যক্ষা রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। প্রথমত বর্তমান পরিস্থিতিতে করোনা রোগের কারণে অন্যান্য চিকিৎসা স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। যা ভবিষ্যতে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি করবে বিশ্বে। আর সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হল এই ভাইরাসের সংক্রমণে রবীন্দ্রনাথকে হারাতে হয়েছিল দুই মেয়ে ও এক নাতিকে।
এই রকম এক পরিস্থিতির মধ্যে ১০ কার্ত্তিক ১৩০৯ [27 Oct 1902] – রবীন্দ্রনাথ মনোরঞ্জন বন্দোপাধ্যায়কে লিখছেন – “আমি এখানে রোগতাপ লইয়া অত্যন্ত উন্মনা আছি । আমার স্ত্রীর রোগ এখনো সারিবার দিকে গিয়াছে বলা যায় না ।। রেণুকার এখনো sore throat চলিতেছে— মীরা কাল জ্বরে পড়িয়াছে। কেবল শমী সম্প্রতি ভাল আছে”।
রেণুকার এই sore throat যক্ষারোগেরই পূর্বাভাষ – রোগের প্রকৃতিটি চিনে নিতে দেরি হয়েছে; আর যথাসময়ে ধরা পড়লেও খুব লাভ ছিল না, এই ব্যধির মহৌষধ অ্যান্টিবায়োটিক আবিস্কার হতে তখনও অনেক দেরি।
প্রথমদিকে sore throat ও জ্বরের সাধারণ চিকিৎসার পর হাওয়া বদলের জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় মধুপুর ও হাজারিবাগে – তারপরে নিয়ে যাওয়া হয় আলমোড়া - কিন্তু কোনভাবেই রোগের উপসম না হওয়ায় ১২ ভাদ্র [শনি 29 Aug 1903] রবীন্দ্রনাথ সদলবলে কলকাতায় ফিরে আসেন এবং অবশেষে ২৮ ভাদ্র [সোম 14 Sept] জোড়াসাঁকোর লাল বাড়িতে রেনুকার মৃত্যু হয়।
সেই সময় [1903 – 04] - রবীন্দ্রনাথের রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: মরণ – চিরকাল একি লীলা গো। নৈবেদ্য - প্রতিদিন তব গাথা। জীবনদেবতা – আজ মনে হয় সকলেরি মাঝে।
রবীন্দ্রনাথের বড় মেয়ে মাধুরীলতা যক্ষা রোগের কবলে পড়েন তা প্রথম জানা যায় রবীন্দ্রনাথের এক চিঠি থেকে। ১০ আষাঢ় [রবি 24 Jun 1917] তিনি কাদম্বিনী দত্তকে লেখেন, “আমার বড় মেয়ে মাধুরীলতাকে ক্ষয় রোগে ধরিয়াছে। সেইজন্যে উদ্বিগ্ন আছি। বোধকরি কিছুকাল কলকাতায় থাকিতে হইবে অথবা বায়ুপরিবর্তনের জন্য তাহাকে লইয়া অন্যত্র যাওয়ার প্রয়োজন হইবে”।
প্রশান্তকুমার পাল লিখছেন ২ জ্যৈষ্ঠ [বৃহ 16 May 1918] রবীন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ কন্যা মাধুরীলতার মৃত্যু হল। তিনি ক্ষয়রোগে পীড়িত ছিলেন, তখনকার চিকিৎসা শাস্ত্রে এই রোগের প্রতিকার ছিল না। তাই রবীন্দ্রনাথ তাঁর কন্যার মৃত্যুর জন্য মানসিক দিক দিয়ে প্রস্তুত ছিলেন।
সেই সময় [1918] - রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য রচনা: রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন পলাতকা কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা ‘শেষ প্রতিষ্ঠা’-র সঙ্গে মাধুরীলতার মৃত্যুর ঘনিষ্ট যোগাযোগ আছে।
রবীন্দ্রনাথ মীরাদেবীর পুত্র নীতিন্দ্রনাথকে জার্মানি পাঠান মুদ্রাযন্ত্র ও প্রকাশন শিল্প বিষয়ে অধ্যয়ণ করার জন্য। ‘বিশ্বভারতী নিয়ুজ’-এর সেপ্টেম্বর ১৯৩২ সংখ্যায় লেখা আছে, তিনি ১৯৩১ খৃষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে জার্মানী যান। তারপর জুন মাসে ধরা পড়ে নীতীন্দ্র যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। বছর কাটলেও সুস্থ হলেন না। বাধ্য হয়ে মীরা গেলেন জার্মানি। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই, মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা গেলেন নীতীন্দ্রনাথ। দিনটা ছিল ১৯৩২-এর ৭ অগস্ট, ১৩৩৯ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ। কলকাতায় বসে শোকাতুর কবি চিঠিতে মেয়েকে লিখেছিলেন, “নীতুকে খুব ভালোবাসতুম...আমার শোকের দায় আমিই নেব— বাইরের লোকে কি বুঝবে তার ঠিক মানেটা”।
এর ন’বছর বাদে প্রয়াত হন কবি। আর এক বাইশে শ্রাবণে।
সেই সময় [1932] - রবীন্দ্রনাথের উল্লেখযোগ্য রচনা: রবীন্দ্রজীবনীকার লিখেছেন সেইদিন ‘মাতা’ [বীথিকা] কবিতাটি লিখলেন। তারপর শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে লিখলেন ‘বিশ্বশোক’ [পুনশ্চ]; ‘দুঃখের দিনে লেখনিকে বলি লজ্জ দিয়ো না’।
ঋণঃ- রবীন্দ্রজীবনী – প্রশান্তকুমারপাল। রবীন্দ্রজীবনকথা – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্ররচনাবলী। ইন্টারনেট
Enter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments