দোল বা হোলির সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক

দোল বা হোলির সাথে সঙ্গীতের সম্পর্ক

বসন্তবাহারের অসামান্য ফুলকারি সুষমায় ছেয়ে গেছে মধুমাস। ‘রং রসিয়া’ আবেগে ভরে উঠেছে মার্চ মাস। এই মধুমাস যতক্ষণ থাকে, মনে আর বনে তখন ফাগুয়ার রৌণক। কে যেন কানের কাছটিতে প্রবল উচ্ছ্বাসে জানিয়ে দিল—‘থোরি সি মস্তি...থোরি সি প্যায়ার’।

প্রকৃতির কুঞ্জবনে এখন অশোক, শিমুল, পলাশ, বকুল, পিয়াল শাখায় ভ্রমরের নিরন্তর ওড়াউড়ি। নতুন কচি বোলে ছেয়ে আছে আম্রকানন। ফাগে আর রঙের মাতনে মন গেয়ে উঠছে,-

আজ বঁধু সারা বেলা, হবে শুধু হোলিখেলা,

ভুবনে এসেছে আজ মধু ফাগুয়া..

এমনি বিজনে মোরা দুজনে,

ADVERTISEMENT

শুধু রঙ ভরা পিচকারি ক্ষণে ক্ষণে ছুঁড়ে মারি,

রাঙাব তোমারও তনু ওগো বঁধুয়া…’

বৃন্দাবনের কৃষ্ণ কি এ কথা বলেছিল রাধারানীকে? বাঙালি যুবক অবশ্য সে সবের তোয়াক্কা করেনি৷ দিকে দিকে রঙের ভেলকি লাগলে হেমন্ত মুখোপধ্যায়ের কণ্ঠ থেকে এ সুর তুলে নিয়ে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে একমুঠো আবির৷ বলেছে, -

‘কোনও বাধা নাহি মানি, রাঙাব বসনখানি

ভুবনে এসেছে আজ মধু ফাগুয়া’৷

রঙের উত্তরে সেদিন সখীসহ রাধারানী কী বলেছিলেন তাও আমাদের জানা নেই৷ শুধু আমাদের গানে গানে ধরা আছে সে উত্তর৷ সেই সুরের রঙ তুলে নিয়েই যুবতীরা উত্তর ছুঁড়ে দিয়ে কপট অভিমানে বলে উঠেছে,

‘ও শ্যাম যখন তখন খেলো না খেলা এমন,

ধরলে আজ তোমায় ছাড়ব না৷’

সত্যি বলতে ছবির পর্দায় রঙ থাক বা না থাক এই, ছবিতে রঙ এতটুকু কম ছিল না, -

"ললিত-রঙ্গে রস-তরঙ্গে প্রাণের সঙ্গে হোলি খেলো,

কুমকুম ফাগে রাঙা অনুরাগে অন্তর মন ভরে তোলো..."

গানের সঙ্গে হোলি খেলা ভারতীয় ছবির দীর্ঘদিনের ট্র্যাডিশন৷ ‘হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়, রঙ্গমে রঙ্গ মিল যাতে হ্যায়’ - এ কথা কে আর না জানে৷ তাইতো রঙ্গ বরষে ভিগে চুনারবালিকে ডেকে যতই প্রশ্ন করুক, ‘কিনে মারি পিচকারি তোরি ভিগি অঙ্গিয়া, ও রঙ্গ রসিয়া, ও রঙ্গ রসিয়া’, ‘বলম পিচকারী’রা আজও ‘সিধিসাধি ছোড়ি’কে সরাবি করতে ঠিক ছুটে যায়৷ হাওয়ায় হাওয়ায় ভাঙ মিশিয়ে বলে ওঠে, ‘আজ না ছোড়েঙ্গে বাস হাম চোলি, খেলেঙ্গে হাম হোলি.. চাহে ভিগে তেরি চুনারিয়া, চাহে ভিগে রে চোলি, খেলেঙ্গে হাম হোলি৷’

রঙের এই পার্বণই হোলি। মুঠোভর্তি আবির, ভেষজ রং, জলীয় রঙে দোলের দামালপনা। সংস্কৃত শব্দ ‘হোলক্কা’ থেকেই হোলি শব্দটি এসেছে বলেই মনে করা হয়। প্রিয়দর্শিকা, রত্নাবলী, কুমারসম্ভব, সবেতেই হোলির বর্ণনা আছে। এছাড়াও ভারবি, মাধ ইত্যাদি সংস্কৃত কবিরা বসন্ত তথা ফাগুন উৎসবের জয়গান করেছেন নিজেদের রচনায়। মহাকবি কালিদাস যেমন ‘ঋতুসংহার’ কাব্যের একটা সর্গ লিখেছেন বসন্তোৎসব নিয়ে। কালিদাস লিখছেন, ‘‘ওই দেখো প্রিয়ে, বসন্তকাল সমাগত। প্রবল যোদ্ধার মতো রতিলালস কামিনীগণের হৃদয় বিদ্ধ করিবার জন্যই বসন্ত।’’

বাৎসায়নের কামসূত্রে বসন্ত বর্ণনা আছে প্রবলভাবেই। টীকাকার যার ব্যাখ্যা করেছেন—ফাগুন পূর্ণিমার রাতে নরনারী উভয়েই, শৃঙ্গারের পূর্বে একে অন্যের শরীরে সুগন্ধ চূর্ণ লেপন করেন। সুরদাস এই রং উৎসব নিয়ে অনেকগুলি পদ লিখে গেছেন। আবার পঞ্চদশ শতকে বিদ্যাপতি ‘বসন্তোদয়’ কাব্যে লেখেন

“আএল ঋতুপতি রাজ বসন্ত।

ধাওল অলিকুল মাধবি-পন্থ

দিনকর-কিরণ ভেল পৌগণ্ড। 

কেসর-কুসুম ধএল হেম দণ্ড।

দোল বা হোলি নামের মাহাত্ম্যের সাথে আবার অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত এক যুগাবতারের নাম। সকলের প্রিয়, সকলের আরাধ্য নন্দদুলাল শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের হাত ধরেই ভারতভূমিতে হোলির সূত্রপাত বলে মেনে নেয় লোকগাথা। শ্রীকৃষ্ণকে কেন্দ্র করেই হোলির সূত্রপাত, একথা মানলেও মহাকাব্য থেকে লোকগাথায় দোল শুরুর কারণে বৈচিত্র্যের অভাব নেই। কত যে কাহিনি মহাকাব্য থেকে লোকমুখে ঘোরে তা শুনলে অবাক হয়ে যেতে হয়। কথিত আছে, বসন্তের প্রথম পূর্ণিমায় ‘কেশি’ নামে এক অত্যাচারী অসুরকে বধ করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। বসন্ত পূর্ণিমায় আসুরিক শক্তির বিনাশের আনন্দে শ্রীকৃষ্ণ দানবের রক্ত ছিটিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন। সেই আনন্দে সামিল হন ব্রজবাসীও। তার হাত ধরেই সূচনা হয় হোলি উৎসবের। আবার আর এক মতে, ‘অরিষ্টাসুর’ নামের এক অসুর বধের আনন্দেই নাকি শ্রীকৃষ্ণের সাথে মৃত দৈত্যের রক্ত নিয়ে উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিলেন ব্রজধামের বাসিন্দারা। সেই রক্তরাঙ্গা রঙের উৎসব থেকেই প্রবর্তন হয় দোল বা হোলি মহোৎসবের। দোল বা হোলি, যে নামেই তাকে ডাকা হোক, ফাগের মিষ্টি সুবাসে তা চিরন্তন প্রেমের দোলা দিয়ে যায় মনে। সেই প্রেম কখনও মননের, কখনও বা শরীরী। সেই প্রেম আদি অনন্ত। গোপিনী শ্রেষ্ঠা রাই ও গোপ শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের অনুরাগের রঙে সেই প্রেম দ্বাপরে ধারণ করেছিল মনোহর কায়া। রাধা ও কৃষ্ণের যুগললীলায় দোল আজ পেয়েছে এক বিশ্বজনীন রূপ। কথিত আছে, একবার বৃন্দাবনে রাধা তাঁর সখিসকাশে খেলায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। সেইসময় রাধার বস্ত্র তাঁর অঙ্গ থেকে খসে পড়ে যায়। ফলে ভারী বিড়ম্বনার মধ্যে পড়তে হয় তাঁকে। ঘটনাচক্রে সেই সময় ওখানে উপস্থিত ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। রাধার লাজ অক্ষুণ্ণ রাখতে কৃষ্ণের মাথায় একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে যায়। কোথা থেকে রঙ যোগাড় করে শ্রীকৃষ্ণ রাধা ও তাঁর সখীদের সঙ্গে হঠাৎ রঙের খেলায় মেতে ওঠেন। খেলার ছলে তিনি রঙের আচ্ছাদনে ঢেকে দেন রাধার শরীরের অনাবৃত অংশ। মান রক্ষা হয় রাধার। তারপর থেকেই ব্রজধামে শুরু হয় হোলি উৎসব। এমন নানা কথিত কাহিনি এখনও ঘুরে বেড়ায় মানুষের মুখে মুখে। রাধা-কৃষ্ণের হাত ধরে দোল উৎসব প্রচলনের আরও অনেক বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। সেই ব্যাখ্যায় কোথাও মেলে রাধার অবর্ণনীয় রূপের প্রতি ঘনশ্যামের ঈর্ষার গন্ধ। রাধার কোমলকান্তি শরীরের মাখনের মত রং নিয়ে নাকি মনে মনে ভারী হিংসা করতেন কৃষ্ণঘন শ্যামসুন্দর। তাই রাধাকে কুৎসিত দেখাতে একবার তিনি নানা রঙে ব্রজগোপিনীদের ভূত করে তোলার ফন্দি আঁটেন। বসন্ত পূর্ণিমার দিন রঙের ঝর্ণায় সবান্ধবে কৃষ্ণ রাঙিয়ে তোলেন রাধাসহ বাকি গোপিনীদের। কিন্তু কি আশ্চর্য! বিভিন্ন রঙের মিশেলে রাধার রূপের ঘনঘটা তো কমলই না। উল্টে তা যেন আরও শতগুণে খোলতাই হয়ে উঠল। রাধার সেই অপরূপ মনোগ্রাহী রূপ ফিরে ফিরে দেখার আশায় তারপর থেকে প্রতিবছর ব্রজভূমিতে রং খেলার উৎসবে মেতে উঠলেন ব্রজের দুলাল। প্রচলিত হল হোলি। দোল প্রবর্তনের আরেক তত্ত্ব আবার বলে অন্য কথা। একবার বৃন্দাবনের কুঞ্জবনে দেখা হয় রাধা কৃষ্ণের। কৃষ্ণের সাথে কথা বলতে বলতে রাধার খেয়াল হয়, তাঁর গায়ে ফুলের পাপড়ি ঝরে ঝরে পড়ছে। অথচ মাথার উপরে তো কোনও ফুলের গাছ নেই! তাহলে এমন অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে কি করে?

শ্রীকৃষ্ণ তখন স্মিত হেসে রাধাকে জানান, দেবতারা নাকি স্বর্গে রঙের উৎসব পালন করছেন। সেকথা শুনে শ্রীরাধাও রঙ খেলতে শ্রীকৃষ্ণের কাছে আবদার জানালেন। রাধার আবদার মেটাতে ফাল্গুনি পূর্ণিমার দিনেই আয়োজন করা হল দোলের। সেখান থেকে মহাসমারোহে দোল পালিত হতে লাগল ব্রজের মাটিতে।

দেউলের বা দোলের প্রথম দিন গোন্ধু নামে পরিচিত। বলা হয়, সন্ধ্যায়, ভগবান কৃষ্ণ, ভগবান বিষ্ণুর অবতার, কৃষ্ণের স্ত্রী ঘুনুচের স্থান এর উদ্দেশে রওনা দেন। তাই তাঁর অনুগামীরা কীর্তন-ঘরের সামনে একটি অগ্ন্যুত্সব এর আয়োজন করেন (যাকে আমরা ন্যাড়াপোড়া বলে জানি ) এবং বৈষ্ণবীরা ঢোল, করতাল বাজিয়ে কীর্তন করেন। হরিবোল রবে চারিদিক মেতে ওঠে। সাধারণ মানুষরা ওই দিন ন্যাড়াপোড়া ও হরির লুটের আয়োজন করেন এবং ভাবেন ওই ন্যাড়াপোড়ার মধ্য দিনে সকাল অশুভ শক্তিকে তারা শেষ করে দিচ্ছেন। দেউলের দ্বিতীয় দিন ভোর-দেউল নামে পরিচিত–যার প্রধান অর্থ দোল । ভোর দেউল চৈত্রমাসে একদিনের জন্য এবং ফাল্গুন মাসে তিনদিনের জন্য পালিত হয়।

দোল উৎসবের শেষ ও চতুর্থ দিনটি সুরি নামে পরিচিত। সেই দিন, ভগবান কৃষ্ণ ঘুনুচের ঘর থেকে মা লক্ষ্মীর ঘরে ফিরে যান।কৃষ্ণের অনুগামীরা তাকে বা তার মূর্তিকে ওই দিন একটি পালকি বা দোলা করে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। বৈষ্ণবেরা খোল করতাল বাজিয়ে কীর্তন করেন , আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে দেন বিভিন্ন রঙের আবির। বলা হয় , যখন কৃষ্ণকে নিয়ে অনুগামীদের মিছিল মা লক্ষ্মীর দুয়ারে পৌঁছায় , মা লক্ষ্মী বাঁশ নিয়ে গেট রুখে দাঁড়ান , কারণ তিনি স্বামী , কৃষ্ণের ওপর রাগান্বিত হয়েছিলেন, কারণ তিনি এই দিনগুলোতে ঘুনুছের স্থানে অবস্থান করেছিলেন।কিন্তু মা লক্ষীর শত চেষ্টা ব্যর্থ করে , শ্রী কৃষ্ণ ভেতরে প্রবেশ করেন এবং কীর্তন ঘরের সাত বার পরিক্রমণ করেন। এরপর সাথে আনা মনি মুক্ত সম্পদ দিয়ে মা লক্ষীর মান ভাঙান। এই দি শেষ হয় দেউল বা দোল উৎসব।

প্রাচীনকালে দোলপূর্ণিমার রাতে বিবাহিতা মহিলারা পূর্ণচন্দ্রের পুজো করতেন। পরিবারের সুখ ও সমৃদ্ধির কামনায়। এই উৎসবকে ‘কাম মহোৎসব’ বলা হত। দক্ষিণ ভারতেও হোলির দিন কামদেবের পুজো হয়। জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস— সকলেই হোলির কৃষ্ণপ্রেমে শরীরকে চিহ্নিত করেছেন। রঙের জৌলুস জীবন থেকে সবটুকু রঙের নির্যাস জড়ো হয় প্রাণে-মনে। হোলি উৎসবের একটি অংশ তাই মহামিলনের। এ হল রাধাকৃষ্ণের নিরন্তর কামক্রীড়া অথবা প্রেমের খেলা। ‘‘না যো রমণ না হয় রমণী, দুহুঁ মন মনোভাব পেষল জানি।’’ রাইবিনোদিনী ও শ্যামের হোরিখেলা নিয়ে ভারতের শেষ মোঘল সম্রাট বাহাদুর শা জাফর-এর সেই বিখ্যাত শায়েরি—‘‘কিঁউ মো পে রং মারি পিচকারি। দেখো কুঁবরজি দুস্তগি ম্যয় গড়ি।।

নন্দগাঁয়ের কানহাইয়ালাল মা যশোদাকে অনুযোগ করছেন রাধার দিব্যি লাবণ্য ও গৌরবর্ণ অথচ আমি কেন এমন কালো? মা যশোদার কাছে এই অন্যায় বর্ণবৈষম্যের নজির তুলে বালগোপাল আক্ষেপ করছেন—‘‘যশোমতী মাইয়া সে পুঁছে নন্দলালা রাধা কিঁউ গোরি, ম্যয় কিঁউ কালা।।’’

মা যশোদা স্নেহের বশেই কৃষ্ণের সমস্যার চটজলদি সমাধান করে বলেন, ‘‘না হয় একদিন রাইকিশোরীর গা ইচ্ছেমতো যে কোনও রঙে রাঙিয়ে দিতে পারো। ব্যস! নটঘট নন্দলালার মা যশোদার দেওয়া এই আইডিয়াটা মনে ধরে গেল দারুণ ভাবে। ফাল্গুন পূর্ণিমার দিন চুপিসারে দুষ্টু বুদ্ধি মগজে নিয়ে শ্রীরাধা ও অন্য গোপবালাদের গায়ে রং মাখাতে শুরু করে দিল। কানহাইয়ার কাছ থেকে সাময়িক পরিত্রাণ পেতে গোপবালাদের ভিড়ে রাধা নিজেকে আড়াল করে কৃষ্ণকে একটু কনফিউজ করার জন্য বললেন, তিনি এক সাধারণ ব্রজবালা। কৃষ্ণ যাকে চাইছেন সেই রাধা তিনি নন।

‘‘ও মোহে ছেরো না

ও মোহে ছেরো না নন্দ কে লালা

কি ম্যয় হি ব্রিজবালা

নহি ম্যয় রাধা তেরি

মোহে ছেরো না নন্দ কে লালা।’’

হিন্দি সিনেমাতে সেই সাদা কালো যুগ থেকেই হোলির হল্লা৷ ১৯৫৭ সালের সিনেমা ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে নৌসাদজির সুরে সামসদ বেগম গেয়েছিলেন, ‘হোলি আয়ি রে কানহাই’৷ ছয়ের দশকে ‘কোহিনূর’ ছবিতে দিলীপকুমার, মীনাকুমারীর দিকে রঙ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিলেন ‘তন রঙ্গ লো জি’৷ নৌসাদজির সুরেই এ গান গেয়েছিলেন মহম্মদ রফি ও লতা মঙ্গেশকর৷ সাদা-কালো পর্দাতেই জমেছিল কল্পনার রঙ৷  রাজেশ খান্না ‘কাটি পতঙ্গ’ ছবিতে হোলির সেলিব্রেশনে মেতেছিলেন, নেপথ্যে কিশোরকুমার গেয়েছিলেন, ‘আজ না ছোড়েঙ্গে বাস হাম চোলি, খেলেঙ্গে হাম হোলি৷’  ‘গাইড’ ছবির(১৯৬৫) বিখ্যাত গান ‘পিয়া তোসে নয়না লাগে রে’-তেও এসেছিল হোলির অনুসঙ্গ৷ এরপর সবথেকে উল্লেখ্য যে গান এলো ‘শোলে’ ছবিতে৷ ধর্মেন্দ্র-হেমামালিনী আপামর দেশবাসীকে শুনিয়ে দিলেন ‘হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়’৷ ১৯৭৫-এর পর থেকে এ গান ছাড়া হোলিপালন সারাই হয় না৷ আর ১৯৮১ তে অমিতাভ বচ্চন ‘সিলসিলা’ ছবিতে নিজে নেচে-গেয়ে ‘রং বরষে’-কে প্রায় হোলি সেলিব্রেশনের জাতীয় সঙ্গীত বানিয়ে দিলেন৷ বিগ বি অবশ্য আবারও হোলির গান গেয়েছিলেন ‘বাগবান’ ছবিতে- ‘হেলি খেলে রঘুবীরা’৷  ১৯৯৩-এর ‘ডর’ ছবিতে পাওয়া গিয়েছিল ‘অঙ্গসে অঙ্গ লাগানা’র মতো হোলির গান৷ বলিউডও বারবার হোলিকে চুটিয়ে সেলিব্রেট করেছে৷ ‘মোহব্বতেঁ’ থেকে ‘ওয়াক্ত’, শাহরুখ থেকে অক্ষয়কুমার, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ারা এসে বাজিমাত করে দিয়ে গেছেন হোলির দৃশ্যে-গানে৷ আবার ‘দামিনী’ ছবিতে এই হোলির দিনেই নায়িকা মীনাক্ষি শেষাদ্রি দেখেন তাঁর বাড়ির পরিচারিকার উপর অত্যাচার করছে তাঁরই বাড়ির লোক৷ হোলির এও এক বাস্তবতা যা, সিনেমার চোখ এড়ায়নি৷ একেবারে এই প্রজন্মের  পরিচালকদের কাজেও হোলির ট্র্যাডিশন সমানে চলছে৷ অয়ন মুখোপাধ্যায়ের ছবি ‘ইয়ে যওয়ানি হ্যায় দিওয়ানি’র ‘বলম পিচকারী’ গানটিতো প্রায় জেন ওয়াইয়ের হোলি সেলিব্রেশনের রিংটোন৷এই তো সেদিন পদ্মাবত-এ দীপিকা পাড়ুকোণের লিপে জেগে উঠল “হোলি আয়ি রে পিয়া জী রে দেশ রে”।

বাংলা ছবিতে দোলকে দারুণভাবে সেলিব্রেট করেছেন তরুণ মজুমদার৷ তাঁর ‘বালিকা বধূ’তেই গানে গানে লেগেছিল রঙের ভেলকি৷ ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর ‘দাদার কীর্তি’ ছবির ‘সাতসুরোকি বাঁধ পায়েলিয়া’ বাঙালির দোলের গানের সিগনেচার টিউন হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ মান্না দে’র গাওয়া ‘রঙ শুধু দিয়েই গেলে’ দোলের আর এক জনপ্রিয় গান৷ দীনেন গুপ্ত পরিচালিত ‘তিলোত্তমা’ ছবিতে ছিল এ গান৷  মহানায়ক উত্তমকুমারকেও ‘বন্দি’ ছবিতে দোলের দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল৷ নেপথ্যে কিশোরকুমার আশা ভোঁসলে গেয়েছিলেন ‘মনে না রঙ লাগলে তবে হোলি কেমন হোলি..’ ৷তবে বাঙালির দোল পালনের সবথেকে উপযুক্ত ও সর্বজানগ্রাহ্য গান বোধহয় ‘খেলব হোলি রঙ দেব না, তাই কখনও হয়..’৷ ১৯৮৭ সালে মুক্তি পাওয়া ‘একান্ত আপন’ ছবিতে ছিল এ গান৷ দোলের দৃশ্যে দেখা গিয়েছিল অপর্ণা সেন, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় ও শকুন্তলা বড়ুয়াকে৷ ছবির দুই বন্ধু চরিত্রের জন্য রাহুলদেব বর্মনের সুরে এ গান গেয়েছিলেন আশা ভোঁসলে ও কবিতা কৃষ্ণমূর্তি৷ এর পরও বাংলা ছবিতে ঘুরেফিরেই দোলের দৃশ্য এসেছে৷ ‘দেবাঞ্জলি’ ছবিতে রানি মুখোপাধ্যায়কে দেখা গিয়েছিল দোল খেলতে, ‘জনতার আদালত’, ‘লক্ষ্যভেদ’ ইত্যাদি ছবিতেও দোল এসেছে তবে দোলের গানে আগের মতো আমেজ আর খুঁজে পায়নি বাঙালি দর্শক৷ সাম্প্রতিক অতীতে ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ ছবিতেও দোল এসেছিল বটে, তবে সোখানে গান ছিল ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’৷ একেবারে হাল আমলের জাতীয় পুরস্কার পাওয়া ছবি ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’ ছবিতে বাংলার দোলের সেই আমেজকে আবার পুরোমাত্রায় ফিরিয়ে দিয়েছেন পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্য৷

ব্রজধাম, মথুরা, বৃন্দাবন, বরসানা, নন্দগাঁও—এই সব অঞ্চলের স্থানীয় মানুষ রাধেমোহনের প্রেমময় আতিশয্য আখ্যান খুবই উপভোগ করেন। ব্রজভূমিতে হোলির সময় নন্দগাঁওয়ের পুরুষরা, আর বরসানার মহিলারা যে আক্রমণাত্মক হোলি খেলে, তাতে যতটা রোম্যান্স ততটাই আদিরস। বৃন্দাবন, বরসানা, নন্দগাঁও জুড়ে বহমান ঐতিহ্যের হোলি উৎসব। রাধামাধবের মন্দিরে, মূর্তিকে ফুলমালায় সাজিয়ে পুজো-অর্চনা প্রচলিত এসব অঞ্চলে। যে লোকগান গাওয়া হয়, তার আনুষ্ঠানিক নাম ‘হোরি’। রামলীলার অনুষ্ঠানে পাত্রপাত্রীরা রাধাকৃষ্ণ সেজে নাট্যবিনোদন করে। ভাগবতের দশম স্কন্ধে রামলীলা আখ্যায়িত হয়েছে। সেখানে লেখা আছে, গোপিনীরা কী ভাবে কৃষ্ণপ্রেমে মজে আছেন। ভাগবতকার সেখানে বলছেন, দেহ কিংবা গেহ ভুলে গোপীরা রাসলীলায় মেতে আছে। হোলির দিনে দলে দলে গোপীদের তুমুল হুল্লোড়ের ভেতর এক সময় আবিষ্কৃত হয়, কৃষ্ণ উধাও।

খোঁজ খোঁজ খোঁজ। ভাগবতকার লিখছেন, হস্তিনীদের ভেতর যূথপতি গজেন্দ্রকে না দেখতে পেলে যেমন অবস্থা হয়, কৃষ্ণকে আগেপিছে দেখতে না পেয়ে গোপিনীদেরও সেই দশা। কৃষ্ণকে আঁতিপাঁতি খুঁজতে গিয়ে তারা এও আবিষ্কার করে, রামমণ্ডল থেকে তাদের প্রিয় গোপীও কখন যেন উধাও। কৃষ্ণ তার প্রিয়তমাকে নিয়ে অন্যান্য গোপীদের চোখে ধুলো দিয়ে বৃন্দাবনে পৌঁছে গেছেন।

আমাদের বাংলায় ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে ‘দোলযাত্রা’ তথা দোলপূর্ণিমা পালিত হয়। উৎসবপ্রিয় বাঙালির কাছে এই দোলেরই আরেক নাম বসন্তোৎসব। এই পবিত্র পূর্ণিমা তিথিতে চৈতন্যমহাপ্রভুর মর্তধামে আগমন হয়। যার জন্য বাংলা ও ওড়িশায় এই দিনকে গৌরপূর্ণিমা বলা হয়। সেদিন ভোরভোর রাধামাধবের বিগ্রহকে স্নান করিয়ে ফুল-চন্দন-মালায় ও দোলায় সাজিয়ে, কীর্তন-ভক্তিগানের মাধ্যমে, আবির ছড়িয়ে শোভাযাত্রা সহকারে পাড়ায় পাড়ায় বেরিয়ে পড়েন ভক্তরা। আবির আর ফাগের জৌলুসই তো দোল। ভারতে প্রধান হিন্দু উৎসব চারটি—দশেরা, দীপাবলি, রক্ষাবন্ধন ও হোলি। বসন্তের আবাহনসূচক রাগ-রঙের জনমোহিনী উৎসবটিই হোলি। চৈতালি হাওয়ায় বসন্তের আমেজ মেশানো রঙের উৎসব ধার্মিক নিষ্ঠা, সামাজিক একতা ও মনোরঞ্জনের উৎসব। এই উৎসব যুগে যুগে নানান পর্বের ভেতর থেকে এসে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রসারিত হয়েছে।

হোলির আগে ‘হোলিকাদহন’ নামে আরও একটা রীতি অনুষ্ঠানের রেওয়াজ আছে। বাঙালি কাব্য করে বলে, “আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে বল হরি বোল”। নতুন কোনও কথা নয়। বহু কাল ধরে দোলের সময় এই শব্দ বন্ধনী প্রজন্মের পর প্রজন্মের মুখে মুখে ছন্দে তালে ফিরে ফিরে আসে। দোলের আগের দিন সন্ধে নামতেই শুরু হয় নেড়া পোড়া। হোলিকা দহনকে প্রচলিত শব্দে নেড়া পোড়ানো বলা হয়। ত্রিকোণ করে লম্বা বাঁশের খাঁচা তৈরি করে তা ভরিয়ে ফেলা হয় ঘুঁটে, প্যাঁকাটি, খড়কুটো, পুরনো বস্ত্র সহ নানা ফেলে দেওয়ার মত বস্তুতে। তারপর তাতে অগ্নি সংযোগ করা হয়। আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠলে তার চারপাশ ঘিরে শুরু হয় নাচ, আনন্দ। নেড়া পোড়ার মধ্যে দিয়েই আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় দোল বা হোলির।

সেটাই আবার বাংলার কোনও কোনও অঞ্চলে ‘চাঁচড় উৎসব’ নামে প্রসিদ্ধ। হোলিকাদহনের রীতিটির পেছনে রয়েছে পুরাণের এক কাহিনি। স্কন্দপুরাণে বর্ণিত আছে, মহর্ষি কাশ্যপ ও দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপু ও কন্যা হোলিকা। হরি-ভক্ত প্রহ্লাদকে মেরে ফেলার সব ষ়ড়যন্ত্র যখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ তখন হিরণ্যকশিপু অন্য একটি নিশ্চিত অস্ত্র ব্যবহার করতে চাইলেন। তার বোন হোলিকা প্রতিদিন অগ্নিস্নান করতেন। অগ্নিদেবের আশীর্বাদ হেতু অগ্নিতে তার কোনও রূপ অনিষ্ট হত না। প্রহ্লাদকে কোলের ওপর বসিয়ে হোলিকা আগুনে প্রবেশ করে। কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর মায়ার প্রভাবে প্রহ্লাদের কোনও অনিষ্ট হয় না। অথচ হোলিকাই অগ্নিতে ভস্মীভূত হয়ে যায়। পরে ভগবান বিষ্ণু নরসিংহ অবতার রূপে হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন। দোলপূর্ণিমার আগের রাতে হোলিকাদহনের অর্থ হল, অনিষ্টের বিনাশ ও মঙ্গলের জয়। হোলিকাদহন শেষে সেই ছাই পরস্পরের কপালে ছুঁইয়ে সুস্থতা ও সমৃদ্ধি কামনা করা হয়। এছাড়া পুরাণে বলে, সতীর দেহত্যাগের পর মহাদেব নাকি এক কঠিন পণ করেছিলেন। তিনি জীবনে আর কোনও নারীর পাণিগ্রহণ করবেন না। তাহলে মহাদেবের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া দেবী পার্বতীর কি হবে। হর পার্বতীর মিলন নাহলে তো কার্তিকের জন্ম হবেনা। তাহলে কার্তিকের হাতে তারকাসুরের নিধনও হবে না।

দেবলোক ও মর্ত্যলোককে বাঁচাতে অতঃপর ডাক পড়ল মদনের। মহাদেবের মনে পার্বতীর জন্য প্রেমের ভাব জাগানোর কঠিন দায়িত্ব পড়ল কামদেবের ঘাড়ে। পত্নী রতিকে নিয়ে কাজে নেমে পড়লেন মদন। তাঁর জোরাল রিপুবাণ গিয়ে বিদ্ধ করল কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন মহাদেবকে। চোখ খুলতেই হল মহেশ্বরকে। পার্বতীর সাথে শুভদৃষ্টি হল তাঁর। আবার প্রেমে পড়লেন শিব।

কিন্তু তপস্যা ভঙ্গ হয়েছে। ফলে ক্রোধে জ্বলে উঠল তাঁর তৃতীয় নয়ন। সেখান থেকে বার হল প্রচণ্ড অগ্নিবাণ। সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন মদন। রতির হাহাকারে আকুল হয়ে উঠল কৈলাসের আকাশ বাতাস। প্রেমী হৃদয়ের সেই হাহাকার এসে পৌঁছল মানবভূমিতেও। কাম ও রতির বিরহের সেই স্মৃতিতে তাই আজও হোলিকা নয়, কামদহন দিয়েই শুরু হয় তামিলনাড়ুর হোলি। অন্ধ্রপ্রদেশ বা তেলেঙ্গানাতেও তামিলনাড়ুর মতই হোলির আগে একইভাবে কামদহনের পরেই শুরু হয় মূল উৎসবের।

এ এক কাহিনি। এমন নানা কাহিনি হোলিকা দহন নিয়ে প্রচলিত। মানুষের মুখে মুখে সেসব কাহিনি ঘুরে বেড়ায়। নানা জায়গায় নানা প্রচলিত কাহিনিকে সঙ্গী করে নেড়া পোড়া চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। আজও রীতি মেনেই হোলির আগের রাতে জ্বলে ওঠে হোলিকা। মানুষ উল্লাসের সঙ্গে সেই নেড়া পোড়ার আনন্দ উপভোগ করেন। তার চারপাশ ঘিরে নাচ, হুল্লোড়ে মেতে ওঠেন।

ফাল্গুন মাসেই দোল উৎসবের এই যে রেওয়াজ তারও একটা জৈবিক উপযোগিতা আছে, এমনই মনে করেন পরিবেশবিদরা। প্রকৃতির ঋতুচক্রে এই সময় শীতঋতু শেষ হয়ে বসন্তঋতুর আগমন ঘটে। জলবায়ু ও আবহাওয়ার রদবদল ঘটে। শীতের পাতাঝরা গাছের ডালে ডালে নতুন কচি পাতা, মুকুল আসে। আকস্মিক ঋতু পরিবর্তনের জন্য মানবশরীর ভারসাম্যে অভ্যস্ত হওয়ার আগেই জ্বর, সর্দি, কাশি, গা ব্যথা, গলা খুসখুস-জনিত ভাইরাল ইনফেকশনে আক্রান্ত হতে থাকে। দোলের রং খেলার অছিলায় এই সময় কচি নিমপল্লব, বিল্ব, অশোক, শিরীষ, আম ও বকুলের মুকুল, পলাশ, কুমকুম, কাঁচা হলুদ, পিয়াল ফুলের রেণু, চন্দন চূর্ণ ইত্যাদি আয়ুর্বেদিক তথা ভেষজ গাছগাছালি, কুসুম, গুল্ম থেকে সনাতনী প্রথায় রং নিংড়ে গায়ে লেপন করলে ভাল ফল পাওয়া যায়। এগুলো সব বসন্তরোগ প্রতিরোধক। উত্তুরে হাওয়ার শীতলতার পরপরই ‘দখিনা বাতাস’ আপাত ভাল লাগলেও ঋতুবৈচিত্রের কারণে মানবশরীরকে অসুখের মোকাবিলায় কিছুটা সাবধানতা নিতে হয়। আর মাত্র ক’দিন পরই দোল। আমাদের এতকালের চেনা ‘দোল-হোলি- ফাগুয়া কিংবা বসন্তোৎসব। বসন্ত আসা মানেই উৎসবের আতিশয্যে মাতোয়ারা বাঙালির কর্ণকুহরে ফাগুনপূর্ণিমার ঢাকে কাঠি পড়া। সেই অনাবিল আনন্দে সকলেই ব্যস্ত বাসন্তিক রঙের আভায় নিজেদের রাঙিয়ে তুলতে। সময় পালটাচ্ছে। দোলখেলা মানেই রক্ষণশীলতার বাতাবরণ কিছুটা আলগা করে নারী-পুরুষ, নবীন-প্রবীণ, চেনা-অচেনার আপাত মিলনোৎসব। আবির-রাঙা মনটারও তখন স্বাভাবিক ছন্দ যেন বড্ড বেশি রঙিন লাগে। দোল তো আসলে জীবনের উৎসব। যৌবনের উৎসব। হোলির ঠমক মেশানো বসন্ত ফুটছে গায়ে-গায়ে। তখন রঙের কোরাস সর্বাঙ্গে।

প্রাচীন বাংলায় দোল উৎসব এক বিশেষ সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল, যা কিনা সর্বসাধারণের মিলনোৎসব হিসাবে ক্রমশ পরিণত হয়ে উঠেছিল। ‘দোল’আর ‘হোলি’-র মধ্যে পার্থক্য যে ঠিক কী, তা আজও বুঝে ওঠা হয়নি। দোল মানে কেবল বাঙালিদের রঙের মাতন, আর হোলি মানে সর্বভারতীয় রং খেলা। ক্যালেন্ডারের পাতায় কেবল একদিন আগে বা একদিন পরের পার্থক্য নয়। এই পার্থক্যের মধ্যে থেকে গেছে আরও অনেক কিছুই। ‘দোল’ কখনও ‘হোলি’ হয়ে উপচে ওঠেনি সে সময়ের মধ্যবিত্ত বঙ্গজন পরিসরে। অনেক বাড়িতেই দোলপূর্ণিমায় সত্যনারায়ণের সিন্নি দেওয়া হয়। একটা সংস্কার ও শুদ্ধি থাকে প্রতিটি উৎসব পালনের মধ্যে। এই সংস্কার দেশজ। বাঙালির দোলের অনুষঙ্গে চলে আসে দোলনা কথাটা। সেখানে কৃষ্ণ প্রিয় সখি শ্রীমতীর সঙ্গে দোলারোহণ করেন। সালঙ্কারা ও লাজুক রাধার সঙ্গে গোপীবল্লভ কৃষ্ণের যুগলমূর্তি কল্পনা করে দোলযাত্রার সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে থাকে প্রকৃতি, স্থানীয় মানুষ, বসন্তের ভাবাবেগ, হট্ট ও কোলাহল, আবির-গুলাল, ভাঙ, তাসখেলা, কিছুটা লালসা, উদ্দাম নাচ-গান এবং শেষমেশ কিছুটা ধর্মের আরোপ। হোরি খেলায় আমোদ-উল্লাস, সামান্য ছেরছার, গালিগালাজ ও নিজস্ব লিবিডো চরিতার্থ করতে খুল্লমখুল্লা ছুঁই ছুঁই খেলা।

গোবলয়ের রমণীকুলও হোলির দিন কিছু কম যান না। রাধা-ললিতা-বিশাখার মতো কোমলস্বভাবারাও সেদিন দাপটের সাথে ধুন্ধুমার হোলির ধামাকায় মেতে থাকেন। মাতোয়ারা মথুরা, বৃন্দাবন, বরসানাও। হোলির দিন কৃষ্ণের জন্মস্থান নন্দগাঁও থেকে রাধার জন্মস্থান বরসানা গ্রাম মেতে ওঠে তামাশা-মস্করা-চটুলতায়।  ফাগ উড়ছে...ফাগ উড়ছে....  দোল মানে রাধাকৃষ্ণের দোলায় আরোহণ। দোল মানে দোলমঞ্চ, মঠ মন্দির। দোলনায় আসীন রাধাকৃষ্ণের শ্রীঅঙ্গে আবির-কুমকুমের প্রলেপ লাগিয়ে ‘জয় গোপামুখাম্ভোজ-মধুপান-মধুব্রত,’ মন্ত্র তিনবার উচ্চারণ। কিংবা গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর জন্মতিথি পালনপর্ব—এসব বাঙালি মাত্রই আমরা জানি। জানি মানে ওই এতদিনের সংস্কার, উৎসব, ছুটি, ধর্ম—এসবই জেনে এসেছি। বড় বয়সে ভাঙ মেশানো শরবতও খেয়েছি, বাদামবাটা কেশর সহযোগে। খুব উপাদেয় পানীয়।

বাংলার হোলির ইতিহাসে মিশে আছে সম্প্রীতির রং। বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাসের রচনায় তার নানা উল্লেখ মেলে। ‘‘খেলত ফাগু বৃন্দাবন-চান্দ।। ঋতুপতি মনমথ মনমথ ছান্দ। সুন্দরীগণ কর মণ্ডলি মাঝ। রঙ্গিনি প্রেম তরঙ্গিনী সাজ।। আগু ফাগু দেই নাগরি-নয়নে। অবসরে নাগর চুম্বয়ে বয়নে।।’’ তবে শুধু দেবতাকে রাঙিয়ে তোলা নয়, দোল উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে জীবনের নানা রং। দোল উৎসবে যেমন মিশে আছে উদযাপনের বৈচিত্র, তেমনই বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে দেখা যায় এই উপলক্ষে মেলাও।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় বগড়ী কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণরায়জীউ-র দোল আজও সাড়ম্বরে পালিত হয়। কৃষ্ণরায়জীউ-র মন্দিরটি ১৮৫৫-এ নির্মিত। শোনা যায় আগে রাধিকা মূর্তিটি ছিল না, পরে সেটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন থেকেই প্রতি বছর দোলের সময় উৎসব ও মেলা হয়। আগের দিন হয় চাঁচড়। সেই উপলক্ষে বাজি পোড়ানো হয়। পূর্ণিমার দিন হয় মূল উৎসব।

দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুরে মহা সমারোহে পালিত হয় দোল উৎসব। এখানে রয়েছে কিছু ব্যতিক্রমী আচার অনুষ্ঠান। এর মধ্যে ‘দোল ফোঁড়াফুঁড়ি’ উল্লেখ্য। এতে যুবকরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে যান। এক দল রাধার পক্ষে, আর এক দল কৃষ্ণের পক্ষে। পূজাস্থলে একটি পুরনো সিংহদরজা রয়েছে। এক দল সেই দরজার সামনে দাঁড়ান, আর এক দল তাঁদের বাধা অতিক্রম করে দরজা পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। যে দল যে বার জয়ী হন তাদের বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আজও এটি দেখতে বহু মানুষ ভিড় করেন।

নদিয়া জেলার শান্তিপুরে বিভিন্ন গোস্বামী বাড়িতে এবং শ্যামচাঁদ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দোলযাত্রা। দোল উপলক্ষে এখনও পথে হরিনাম সংকীর্তনের মিছিল বের হয়। উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায় দোলের দিন নয়, পঞ্চম দোলের দিন মধ্য ভাটপাড়া অঞ্চলে অমরকৃষ্ণ পাঠশালার কাছে বসে পঞ্চম দোলের মেলা। আজও দাঁড়িয়ে অতীতের দোল মঞ্চটি।

তেমনই কাছেই নারায়ণপুরে দোলের ঠিক সাত দিন বাদে হয় জয়চণ্ডীর সপ্তম দোলের বহু প্রাচীন মেলাটি। কিংবদন্তি অনুসারে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময় ভবানী পাঠক উত্তরবঙ্গ থেকে নারায়ণপুরে এসে কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন। এক দিন সন্ধ্যায় তিনি দেখেছিলেন বহুমূল্য অলঙ্কারে সজ্জিতা এক নারী তাঁর সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছেন পুকুরের দিকে। ভবানী তাঁকে দাঁড়াতে বললেও তিনি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলেন। এমনই এক সময় ভবানী পাঠক তাঁর তলোয়ার দিয়ে সেই নারীর উপর প্রহার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী সামনের পুকুরের মধ্যে মিলিয়ে গেলেন। ভবানী পাঠকও তাঁকে ধরার জন্য সঙ্গে সঙ্গে জলে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু সেই নারীর কোনও সন্ধান পেলেন না। বরং হাতে পেলেন একটি ছোট শিলাখণ্ড আর একটি ছোট দেবীর বিগ্রহ। সেই উপলক্ষেই  মেলা বসে।

যেমন কল্যাণীর ঘোষপাড়ার সতীমায়ের মেলাটি। মেলাটি মূলত কর্তাভজা সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত। কল্যাণীর ঘোষপাড়া স্টেশনে নেমে জনস্রোতের পিছু পিছু পৌঁছে যাওয়া যায় সতীমার মেলায়। ‘জয় সতীমা-র জয়’ ধ্বনি-মুখরিত মেলা প্রাঙ্গণ আবিরে রাঙা। চারদিক থেকে এলোমেলো ভাবে ওড়ানো হয় ফাগ। মেলার বিভিন্ন জায়গায় আউল, বাউল, ফকির, কিংবা সন্ন্যাসীদের আখড়া। তাঁরা গেয়ে চলেছেন ‘ভাবের গান’। এ মেলা যেন বৈরাগ্য আর আনন্দের এক মিলনক্ষেত্র।

অপর একটি কিংবদন্তি অনুসারে, উলা বীরনগরের মহাদেব বারুইয়ের পানের বরজে একটি শিশুকে পাওয়া যায়। শিশুটির নাম হয় পূর্ণচন্দ্র। পরে সাধনায় সিদ্ধিলাভের পরে পূর্ণচন্দ্রের নাম হয় আউলচাঁদ। নানা স্থানে ধর্ম প্রচার ও অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ করে তিনি এসেছিলেন এই ঘোষপাড়ায়। বহু মানুষের বিশ্বাস আউলচাঁদই নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য। বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপে তাঁকে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। ইনি কর্তাভজাদের কর্তা। সতীমার গর্ভে জন্ম নেন দুলালচাঁদ। লোকবিশ্বাসে এই দুলালচাঁদই হয়ে ওঠেন নবদ্বীপের নিমাইচাঁদের অবতার। তাঁর সময়ই মেলা ও কর্তাভজা সম্প্রদায় ব্যাপক প্রসার ঘটে।

ভক্তরা ডালিমতলায় মানত করেন, হিমসাগরের জলে স্নান করে পুণ্যার্জন করেন, সতী মায়ের সমাধিতে সিঁদুর আর নোয়া দেন। আর মনস্কামনা পূর্ণ হলে দণ্ডি কেটে কিংবা ভাবের গান গেয়ে জানিয়ে যান কৃতজ্ঞতা। ডালিমতলার চারপাশে অসংখ্য ডালার দোকান। পুজোর উপকরণ বলতে মাটির সরায় খই-বাতাসা কিংবা মট। এই হল পুজোর ডালি। পুজো দিয়ে ভক্তেরা এই মহার্ঘ্য প্রসাদটুকু নিয়েই ঘরে ফিরে যায়। দোলের আগের দিন থেকে দোলের পরে পাঁচ দিন পর্যন্ত চলে উৎসব। তবে মেলা চলে দু’সপ্তাহ। মেলায় এক দিকে যেমন রয়েছে সার্কাস, বিদ্যুত্চালিত নাগরদোলা, কিংবা ছোটদের মনোরঞ্জনের হরেক উপকরণ, তেমনই অন্য দিকে পাওয়া যায় পিতলের বাসনপত্র, বেতের ধামা, সাজি থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় নানা জিনিস।

তবে শুধু হিন্দুরা নন, দোলের রঙে বহু যুগ ধরে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলে আনন্দ উপভোগ করেছেন। শোনা যায় মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগর চুক্তি সেরে তড়িঘড়ি মুর্শিদাবাদ ফিরে গিয়েছিলেন হোলি উৎসবের জন্য। নবাবের প্রিয় হিরাঝিল প্রাসাদে মহা সমারোহে হোলি উৎসব পালন করা হত। তেমনই ঢাকার নবাব নওয়াজিস মহম্মদ খান পটনা থেকে আগত শওকত জঙ্গের সঙ্গে সাত দিন ধরে মুর্শিদাবাদের মোতিঝিল প্রাসাদে হোলি উৎসব পালন করেছিলেন। তবে শুধু নবাবরা নন, সেই প্রাচীন কাল থেকেই হোলি উৎসবে মুসলমানরাও যোগ দিতেন।

মরাঠা দেশে যখন প্রবাসী জীবন, তখন এখানকার ‘সিমগোৎসব’সম্বন্ধে সামান্য কিছু বলে নেওয়া যাক। হোলি পূর্ণিমাকে স্থানীয় কোঙ্কনি ভাষায় ‘সিমগা’বলে। কাছাকাছি ফাঁকা স্থানে কাঠকুটো জড়ো করে হোলিকাদহন রীতি এখানেও প্রচলিত। মহারাষ্ট্রে দোলপূর্ণিমার পরবর্তী পঞ্চমী তিথিতে হোলিখেলা হয়। সেজন্য দোল উৎসবকে এখানে ‘রাগপঞ্চমী’ ও বলা হয়। ‘সিমগা’ হল শুভাশুভের প্রতীক। প্রতিটি মরাঠি গৃহেই ‘পুরনপলি’ মিষ্টান্ন প্রস্তুত করা হয়। অগ্নিদেবতাকে স্মরণ করে এই মিষ্টি অর্পণ করা হয়। মহিলা ও শিশুরা সমস্বরে বলতে থাকে ‘হোলি রে হোলি, পুরানচা পোলি’।

দোল উৎসব যেমন প্রাচীন, তেমনই প্রধান একটি উৎসব হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে। হিন্দু অধ্যুষিত যেকোনো স্থানেই বড় পরিসরে রঙ খেলা হয়ে থাকে। তাই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এর হরেক নাম লক্ষ্য করা যায়। যেমন- গুজরাটে ধুলেতি, উত্তর প্রদেশে লাঠ মার হোলি, উত্তরখণ্ডে কুমায়নি হোলি, বিহারে ফাগুয়া, ওড়িশায় দোলা, গোয়ায় শিগমো, মণিপুরে ইয়াওসাং, কেরালায় উক্কুলি এবং নেপালে ফাগু।

প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও দোল বা হোলির তাৎপর্য লক্ষ্যণীয়। লিঙ্গ ও ধর্ম নির্বিশেষে সব মানুষই সামিল হতে পারে এই আনন্দঘন উৎসবে। যে কাউকেই রঙ খেলার মতো অন্যতম উৎসবটি আকৃষ্ট করবে। তাই এই সময়ে দেখা যায় প্রচুর মানুষের সমাগম হয়। যেকোনো প্রকার বৈষম্য ভুলে নিরপেক্ষভাবে রঙে, গানে, নতুনে মেতে ওঠে সকলে।

বাস্তবিকভাবে শীতের রিক্ত শুষ্ক জীর্ণতা জ্বালিয়ে নবীন বসন্তকে আহ্বান এই হোলি বা দোলযাত্রা, ভারতীয় বোনফায়ার। ফিরে আসুক আপনার-আমার-সবার জীবনে রঙের উৎসব। রঙিন হয়ে ডাক পাঠাই –

দিওনা রঙ, দিওনা রঙ, এভাবে কাছেতে এসে,
লাগলে চোখে দেখব যাকে ফেলব তাকে ভালোবেসে

 

 

ছবি - ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait