শরীরী সাক্ষাতে নয়, বেঁচে থাকি হৃদয়ের লাবডুবে

শরীরী সাক্ষাতে নয়, বেঁচে থাকি হৃদয়ের লাবডুবে

বিচ্ছিন্নতায় ভয়?

বিচ্ছিন্ন তো সেই দিনই হয়েছি যে দিন পাড়ার একমাত্র খেলার মাঠের ধারে ভোরবেলা ভিড় করেছিল জনা দশেক। দিনে দিনে ওদের তত্ত্বাবধানে সবুজ মাঠে গড়ে উঠেছিল বহুতল। আমরা এতটাই নিজেকে নিয়ে মত্ত ছিলাম যে মোটেই বুঝিনি তলে তলে মাঠটা কবে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। বহুতলটায় যখন লোক বসত শুরু হল, তখন বেশ মালুম হল, আমার মধ্যবিত্ত পাড়ার বহুতলের বাসিন্দারা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন। ওরা দিনে – দুপুরে আমাদের মতো নাইটির ওপর গামছা জড়িয়ে মুদিখানা দোকান থেকে শি‌শি করে সরষের তেল কেনেন না। ওরা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে তেলের ব্যারেল আনেন ফি মাসে।

বিচ্ছিন্ন সে দিন হয়েছিলাম যে শীতের রাতে সামনের মোড়ের বান্ধবীর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়েও আমি দোর খুলিনি। আশৈশবের বান্ধবীর পাশে দাঁড়ায়নি শীতের অজুহাতে। আমি কিন্তু ওই মধ্যবিত্ত পাড়ারই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের লোক, ফ্ল্যাট সংস্কৃতি ইজ় নট মাই কাপ অফ টি। প্রতিবেশীর থেকে দূরে সে দিনই চলে গিয়েছিলাম, যে দিন ‌আমার আর তার বাড়ির কমন পাঁচিলের ওপাশে থাকা প্রতিবেশীর আম গাছের পাতা আমার নর্দমায় পড়ার অজুহাতে আমি তাকে সবুজ- ফলন্ত গাছটা কাটতে বাধ্য করেছিলাম। দূরে সে দিন চলে গিয়েছিলাম যে দিন পাশের বাড়ির ঠাকুমার শকশকানো নোলার ভয়ে মুড়ি ঘন্ট রাঁধতে রাঁধতে রান্নাঘরের জানলা আটকেছিলাম। আর এখন তো চিমনী লাগিয়ে নিয়েছি! পাশের বাড়ি কি… আমার ড্রয়িং রুম পর্যন্তই রান্নার গন্ধ সেধায় না।

ADVERTISEMENT



দূরে সেদিন গিয়েছিলাম যে দিন সামনের বাড়ির বৌদি তার প্রতিবেশীর কাছ থেকে এক কাপ চিনি চাইতে গেলে সে বাড়ির দাদা স্ত্রীর অসাক্ষাতে বৌটিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করেছিলেন। সে দিনের পর থেকেই প্রতিবেশী বৌদির চিনি মিষ্টি মন নিম তিতা হয়ে উঠতে বিলম্ব হয়নি। দূরত্ব সে দিন বেড়েছিল যে দিন দেখেছিলাম পাড়ার দুর্গাপুজোর জন্য এক দল লোকের চাঁদা তোলার তেমন দরকার পড়ে না। কর্পোরেট বিজ্ঞাপনেই খাড়া হয় আমাদের ঝা চকচকে থিমের প্যান্ডেল।

বিচ্ছিন্ন হয়েছি যে দিন থেকে কাদা প্যাচপ্যাচে বাজারকে, বাজারের আঁশটানি গন্ধটাকে অপছন্দ করায় অন লাইনে ফ্রেশ সব্জির মোহ আমাকে টেনেছে, হাতে লেখা চিঠির আতর বদলে গেছে ইমোটিকনের স্মার্টনেসে, চেনা মানুষের সঙ্গে দেখা হলে ‘কেমন আছ? ভালো তো গো?’ যে দিন ‘হাই’ হয়েছে সে দিন থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছি আমরা।

 প্রশ্ন হল, এতটাই যদি স্বয়ংক্রিয় আমরা। তাহলে আজ কেন সেল্ফ আইসোলেশনকে এত ভয়? আসলে আমরা এতদিন ধরে যে ভাবে নিজেদের সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করে এসেছি তা ছিল একান্তই মর্জি মাফিক। আজকের এ মহামারীর দিনে দাঁড়িয়ে আমাদের বহু অভ্যস্ত সেই আইসোলেশনই যখন স্বাভাবিক তখনই আমরা একাকীত্বকে আরও বেশি করে অনুভব করছি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির রঙিন জামা – কাপড় মেলা ছাদটা আর দেখতে পাবো না! ভাবলেই মনটা আনচান করছে। পাড়ার দস্যিটার গলা শুনতে পাওয়াটা যখন অভ্যেসে দাঁড়িয়ে যায় তখন হঠাৎ এমন আতঙ্ক দিন এলে ভয় করে বই কি! আমরা বোধহয় বুঝতে পারছি এতদিন যে ধরণের কোয়ারেন্টাইনে আমরা জীবনযাপন করতাম সেটা কতোটা বেকুবের সিদ্ধান্ত ছিল। ব্যান্ডেল লোকালের সহযাত্রীটিকে আসলে আমার চাই, তার সঙ্গে দুটো কথা না হোক তার উপস্থিতিটা আমি উপভোগই করি, বাড়ি ফেরার পথে পাড়ার কাকুর হাসি মুখে ‘কি রে ফিরলি’ র মতো নিতান্তই বোকাসোকা প্রশ্নটা আমাকে আনন্দই দেয়, স্টেশন বাজারে ‘ও দিদি কচি থোড় আছে… ন্যান না!’ আব্দারটা যে আমার ভালো লাগে তা এতদিন বুঝিনি। এবার বুঝছি ।  আমার চার পাশটা কতটা দামি তা একদিন না বুঝতেই হতো। আজকের সেল্ফ আইসোলেশন সে দিনটাই এনে দিল। চেনা-আধা চেনা – অচেনারা কেমন আছেন জানতে ইচ্ছে করছে, খুব ইচ্ছে করছে… উপায় নেই।



তবে মনে ভরসা আছে। আমাদের আজকের এই একলা ঘরের দেশই আমাদের বাঁচিয়ে দেবে। বিষাক্ততাকে সংক্রমিত করা থেকে আপাতত বিরত থাকতে পারলেই কিন্তু আবার সহযাত্রীর সঙ্গে দেখা হবে, পাড়ার মোড়ের চেনা ভিড়টা দেখতে পাবো, টাটকা সব্জীর খোঁজে আবার ফেলে আসা বাজারে পৌঁছনো যাবে। বিচ্ছিন্নতা যে আমাদের মোটেই কাঙ্খিত নয়, আজ ঘরে আটকা পড়ার পর তা বুঝতে পারছি সকলেই। কটা দিন একটু চেপেচুপে থাকলেই ওপাড়ে কিন্তু একঝাঁক দারুণ দিন অপেক্ষমান। চেনা চেনা হাসিমুখগুলো দেখার জন্যেই না হয় ‘ওরে আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে’ ! সক্কলে ভালো থাকি!  শরীরী সাক্ষাতে নয়, হৃদয়ের লাবডুবে বেঁচে থাকি এ ক’দিন!

 

 

 

 

❤

 

 

 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait