সর্দার উধম
পরিচালক: সুজিত সরকার
অভিনয়: ভিকি কৌশল, আমল পরাসর, বনীতা সান্ধু, স্টিফেন হোগান, এন্ড্রু হেভিল এবং আরো অনেকে।
আমাজন প্রাইম অরিজিনাল
কাট ওয়ান: 1919 সালের 13 এপ্রিলের সেই রাত। পাঞ্জাব প্রদেশের শয়ে শয়ে মানুষ অমৃতসর নামক শহরের জালিয়াওয়ালাবাগে শান্তিপূর্ণ মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। নারী-পুরুষ-শিশু-বয়স্ক মানুষ- গর্ভবতী মহিলারা সেই সভায় গিয়েছিলেন নিছকই হয়ত একটু বিনোদনের জন্যই। কিন্তু তাঁরা জানতেন না কতবড় বিপদ ওৎ পেতে বসে আছে তাঁদের জন্য। তাঁরা ভাবতেও পারেন নি যে 'সুসভ্য' ইংরেজ জাতির কিছু প্রতিনিধি বিনা কারণে বিনা নোটিসে তাঁদের শরীরগুলোকে বুলেটের অবিরল ধারায় মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে ঝাঁঝরা করে চলে যেতে পারে। এ ভাষায় প্রকাশ করার মত বিষয় নয়। দেখার বিষয়, যা সুজিত সরকার তাঁর নতুন মুভিটির মাধ্যমে আমাদের দেখিয়েছেন।
ADVERTISEMENT
কাট টু: পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসরে সেই রাতে কারোর ঘরেই লোকজন নেই বিশেষ। সবাই মিলে তাঁরা জালিয়াওয়ালাবাগের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছেন। একটা বাড়িতে একজন যাননি শুধু। তাঁর নাম উধম। কুড়ি বছর বয়স, খেটেখুটে ক্লান্ত তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ কে যেন ঘরে এল? আরে, এ তো তাঁর বন্ধু! সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর। উধম জানলেন সব। এরপর পাগলের মত ওই শ্মশানভূমির উদ্দেশ্যে ছুটলেন। সারারাত একটা ঠ্যালাগাড়ি করে যতজনকে জীবিত পেলেন, তুলে নিয়ে এলেন স্থানীয় ডাক্তারখানায়, দেশীয় ডাক্তারের কাছে। তাঁদের কেউ বাঁচল, অনেকেই মারা গেল। কিন্তু এই ঘটনা জন্ম দিল অনেক হীরের টুকরো ছেলের, তাঁদের মধ্যে দুজনের নাম সর্দার ভগৎ সিং এবং সর্দার উধম সিং। এই নৃশংস নারকীয় হত্যালীলার নায়ক জেনারেল ও'ডয়ার কে যে সিংহশাবক উধম সিং বিলেতের মাটিতে কুকুরের মত গুলি করে মারবেন।
কাট থ্রি: বিলেতের মাটিতে উধম সিংয়ের পা রাখার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ওই নৃশংস খুনি ও'ডয়ার কে হত্যা করা, যা খুব সহজ ছিল না। ভগৎ সিংদের শহীদ হওয়ার পর উধম দেশের পাট চুকিয়ে বিলেতে চলে আসেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন কাজের সাথে যুক্ত হন, এমনকি ও'ডয়ার এর বাড়িতে কাজের লোক হিসাবেও যোগদান করেন। উদ্দেশ্য ছিল ও'ডয়ারকে সর্বদা চোখে চোখে রাখা। সেই কাজে তিনি সফলও হন। বিলেতে আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়, তিনি অস্ত্রও সংগ্ৰহ করেন আইরিশদের প্রচেষ্টায়। অবশেষে সেই বহু প্রতিক্ষিত দিনটি আসে, যেদিন উধম খোদ বিলেতের বুকে অত্যাচারী ও'ডয়ারকে চরম দন্ড দেবেন। তাও এক হল ভর্তি লোকের সামনে, বুক চিতিয়ে।
এর পরের কাহিনীটুকু বলার নয়। কি অসম্ভব অত্যাচার তাঁর ওপর ব্রিটিশ পুলিশ করেছিল, তা দেখলে গা গুলিয়ে উঠতে বাধ্য। ওই ব্রিটিশ জাতটার প্রতি রাগ, ঘৃণা, ক্ষোভ---সব মিলিয়ে একটা মিশ্র অনুভূতি হবেই হবে। আরো একটা অনুভূতি হবে। তা হল গর্বের অনুভূতি। উধম সিংদের আত্মবলিদান প্রত্যক্ষ করলে ভারতবাসী হিসাবে বুকের ছাতি চওড়া হবেই।
ভিকি কৌশল উধম সিংয়ের চরিত্রের জন্য যথাযথ। চরিত্রাভিনেতা হিসাবে তাঁর তুলনা হয় না। এছাড়াও ভগৎ সিংয়ের ভূমিকায় আমল পরাসরকে খুবই ভাল মানিয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশের ভূমিকায় স্টিফেন হোগান দাগ কেটেছেন। গোটা মুভিটি সিপিয়ায় বানানো বলে পরাধীন ভারতবর্ষের ছবিটা খুব সুন্দর ধরা পড়েছে। আবহসংগীত দাগ কাটার মত না হলেও খারাপ নয়। কিন্তু ছবিটির সবথেকে বড় সম্পদ হল শেষের দিকে উধমের নিজের ভাষায় জালিয়াওয়ালাবাগের সেই রাতের বর্ণনা, যা ভিজ্যুয়াল এর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সেই নারকীয় হত্যালীলা দেখতে দেখতে সর্বাঙ্গ রি রি করে জ্বলে উঠতে বাধ্য। এত বিশদে এবং এত স্পষ্ট করে ওই হত্যালীলা দর্শকের সামনে তুলে ধরার জন্য পরিচালককে ধন্যবাদ। কিন্ত সব সত্ত্বেও একটা কথা না বললেই নয় যে মুভিটির দুর্বল জায়গা হল দীর্ঘায়ন। প্রায় পৌনে তিন ঘন্টা সময় নিয়ে মুভিটি তৈরী, যা কিছু ক্ষেত্রে একটু হলেও একঘেয়ে লাগে। এই সামান্য ত্রুটিটুকু ছাড়া বাকিটা খুবই ভাল এবং নতুন প্রজন্মের সাথে পুরোনোকে মেলানোর এক সার্থক প্রয়াস। দেশের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী বহন করে নিয়ে চলে এই নতুন মুভিটি। উধম সিংয়ের আত্মবলিদানের ঘটনার সাথে আমরা পরিচিত হই, যা ভারতবর্ষের বিপ্লববাদের অজানা ইতিহাসের নানা দিক খুলে দেয়। এ ইতিহাস জানা দরকার, বিশেষত নবীন প্রজন্মের জন্য তো বটেই।
মুভিটি দেখে চোখ জ্বালা করে অদ্ভুত এক ক্ষোভে, যা প্রশমিত হতে সময় লাগে। এই রাগ, এই ঘৃণা আমাদের দিয়েছে গর্ব করার মত ইতিহাস, উধম সিং যাঁদের একজন। ভারতবাসী হিসাবে আমরা গর্বিত এঁদেরই জন্য।
মুভিটির রিভিউ দেওয়া সাধ্যের বাইরে, কেননা এই ধরণের মুভি শুধুমাত্র শ্রদ্ধাই অর্জন করতে পারে। পাঠকদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, সপরিবারে মুভিটি দেখুন এবং বিশেষ করে বাড়ির শিশুদের দেখান। ওরা জানুক, কত কষ্টে, কত বিপ্লবীর আত্মবলিদানে, কত রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতা পেয়েছি। এ স্বাধীনতা যেন বৃথা না যায়। সেই অমর ক্রান্তিকারীদের স্বপ্ন, যা বাস্তবায়িত হয়নি বললেই চলে, তা যেন আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম করে দেখাতে পারে। ওদের মধ্যে থেকেই আসুন ভগৎ-উধম-বিনয়-বাদল-দীনেশ-প্রদ্যোত-সুশীল। ঐরকম ছেলেদের আজকের ভারতবর্ষে সত্যিই খুব দরকার। যাঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপরে উঠে সোনার ভারতবর্ষ গড়ে তুলবেন। এই স্বার্থপরতা, দৈন্য, হানাহানির সমাপ্তি ঘটাবেন। পথ চেয়ে থাকব আমরা নির্নিমেষ।
বন্দে ভারত।
0 comments