এক কবি ও রাজার গল্প

এক কবি ও রাজার গল্প

সময়টা ১৮৮৩ সাল। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য তাঁর প্রিয় মহিষী ভানুমতীর মৃত্যুতে শোকাকুল। বৃন্দাবনে গিয়ে তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে সবে আগরতলায় ফিরে এসেছেন। প্রিয়াবিরহে কাতর মহারাজের মন ভাল নেই। রাজমহিষীর মৃত্যুর পর থেকে সমস্ত রকম প্রমদানুষ্ঠানের ওপর যবনিকাপাত হয়েছে।

তবে, অনেক দিন পর আজ একটা ব্যতিক্রমী দিন বলে মনে হচ্ছে। আজ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মহারাজা উঠে এসেছেন সভায়। ভানুমতির মৃত্যুতে বিকেলে ফুর্তির সব আয়োজন প্রাণহীন পাষাণে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, আজ তাতে মহারাজার কল্যাণে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল।

মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য চন্দ্রবংশীয় শাসনের একশ পচাত্তরতম উত্তরাধিকারী। কিংবদন্তী অনুসারে তিনি মহাভারতের যযাতির বংশধর। ভোগ-বাসনায় অতৃপ্ত যযাতি তাঁর পুত্রদের কাছে যৌবন ধার চেয়েছিলেন। যে কজন পুত্র তাঁদের পিতার এই উদ্ভট খেয়ালের বিরোধীতা করেছিলেন তাদেরকে যযাতি নির্বাসনে পাঠান। সেই নির্বাসিত পুত্রদের একজন ছিলেন দ্রুহ্য, তিনি আর্যাবর্ত ত্যাগ করে অনেক দূরে এসে – উত্তরপূর্ব ভারতের সীমানায় কীরাট রাজ্যের স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করে ত্রিপুরা রাজ্য গড়েন।

ADVERTISEMENT

আর ভানুমতি হলেন মহারাজার জ্যেষ্ঠা রানী। মহারাজের প্রায় সমবয়েসী। তাদের বিবাহের সময় দু’জনেই ছিলেন বালক-বালিকা। অর্ধাঙ্গিনী হবার আগে ভানুমতী ছিলেন বীরচন্দ্রের খেলার সঙ্গিনী। তাঁর মৃত্যুর পর যখন মহারাজা বীরচন্দ্র খুব ভেঙে পড়েন তখন রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পড়ে তাঁর মন কিছুটা শান্ত হয়।

রবিঠাকুরের কবিতা পড়ে এতটাই মোহিত হন যে, তিনি তাঁর সচিব রাধারমণ ঘোষকে কলকাতায় পাঠান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য একটি মানপত্র, একজোড়া ধুতি, একটি উত্তরীয়, একটি শাল, হাতির দাঁতের তৈরি দুটি পুতুল আর একটি মখমলের পাউচে পাঁচটি মোহর পাঠান সম্মানী হিসেবে।

পরবর্তীতে, রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লেখেন: “মনে আছে এই লেখা বাহির হইবার কিছুকাল পরে কলিকাতায় ত্রিপুরার স্বর্গীয় মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের মন্ত্রী আমার সহিত দেখা করিতে আসেন। কাব্যটি মহারাজের ভালো লাগিয়াছে, এবং কবির সাহিত্য সাধনার সফলতা সম্বন্ধে তিনি উচ্চ আশা পোষণ করেন, কেবল এই কথাটি জানাইবার জন্যই তিনি তাঁহার অমাত্যকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন”।

অন্য এক অনুষ্ঠানেও কবি বলেছিলেন, “জীবনে যে যশ আমি পাচ্ছি, পৃথিবীর মধ্যে তিনিই তার প্রথম সূচনা করে দিয়েছিলেন, তাঁর অভিনন্দনের দ্বারা। তিনি আমার অপরিণত আরম্ভের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েই তখনই আমাকে কবি সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলেন। যিনি উপরের শিখরে থাকেন, তিনি যেমন যা সহজে চোখে পড়ে না তাকেও দেখতে পান, বীরচন্দ্রও তেমনি সেদিন আমার মধ্যে অস্পষ্টকে দেখেছিলেন”।

যাই হোক, আজ মহারাজা হাতির দাঁতের সিংহাসনে না বসে সোজা নেমে এসে জাজিম বিছানো মেঝেতে রাধারমণ ঘোষ আর মদন মিত্রের মুখোমুখি বসলেন। ভানুমতির মৃত্যুর পরে যে কবিতাগুলি পড়ে এতদিন মহারাজার বিরহ যন্ত্রণায় প্রলেপ পড়েছিল আজ রাধারমণকে দিলেন সেই কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা পাঠ করতে।

রাধারমণ কবিতা পাঠ করার শুরুতেই হোঁচট খেলেন। এই কবিতার বইটি তিনি আগে কখনও দেখেননি, কি সুরে কি ছন্দে পড়বেন তাও জানা নেই। আগে থেকে তিনি রেওয়াজ বা রপ্ত করেও আসেননি। মহারাজা রাধারমণের অস্বস্তির কারণটুকু ধরতে পারলেন। বীরচন্দ্র ক্ষমাসুন্দর হাসি হেসে বললেন, ঠিক আছে। আমিই পড়ছি। গলা কেশে ভরাট কন্ঠে বীরচন্দ্র দীর্ঘলয়ে কবিতা পড়তে শুরু করলেন।

হয়ত জান না, দেবি, অদৃশ্য বাঁধন দিয়া

নিয়মিত পথে এক ফিরাইছ মোর হিয়া।

গেছি দূরে, গেছি কাছে,   সেই আকর্ষণ আছে,

পথভ্রষ্ট হই নাক তাহারি অটল বলে।

কবিতাপাঠ বন্ধ রেখে বীরচন্দ্র উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যেন কতদূরে চলে গেছেন নিজেই জানেন না। প্রয়াতা স্ত্রী ভানুমতির স্মৃতি তাকে আবেশে আবৃত করে রেখেছে। কান্নাপ্লুত কন্ঠে কবিতাপাঠে আবার মগ্ন হয়ে পড়লেন।

স্নেহের অরুণালোকে খুলিয়া হৃদয় প্রাণ

 পারে দাঁড়ায়ে, দেবি, গাহিনু যে শেষ গান

তোমারি মনের ছায়   সে গান আশ্রয় চায়--

একটি নয়নজল তাহারে করিও দান।

পাঠ শেষ করে বীরচন্দ্র ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। স্ত্রী বিয়োগজনিত ভগ্ন হৃদয়ের জ্বালাকে স্নিগ্ধতার প্রলেপ দিয়ে জুড়িয়ে দিয়েছে কবিতা। তারপর কবিতার নম্রতাকে ছুটি দিয়ে কন্ঠস্বরে রাজকীয় সহজাত স্বভাব ফিরিয়ে এনে বললেন, “রাধারমণ, তোমার উপর একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। এই কবিতার বইয়ের কবিকে তুমি আমার রাজসভায় নিয়ে আসবে বুঝেছো”?

রাধারমণ ঘোষের হাতে কবিতার বইটি তুলে দিয়ে বীরচন্দ্র বললেন: “আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, কোনো কথা জানতে চাইনা। আমি চাই আমার রাজসভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির দ্বারা অলংকৃত হউক”।

বীরচন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর আপনমনে নিজেই বলতে লাগলেন, ‘ভগ্নহৃদয়’ পড়ে আমার মনে হচ্ছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী বা নিকট আত্মীয় কেউ মারা গিয়েছেন। ‘ভগ্নহৃদয়’ হল আমার জন্য, আমার সমস্ত শোকসন্তপ্ত হৃদয় জুড়াবার গাঁথা।

 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দোতলার একটি কোণের ঘরে একজন তরুণ যুবা গলা সাধছিলেন। সাধছিলেন বলার চেয়ে বরং বলা ভালো একটি গানে সুর আরোপ করছিলেন। গানের প্রথম লাইনটিতে ঘুরে ফিরে সুর দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছিলেন তিনি – “আমায়   বোলো না গাহিতে বোলো না। এ কি  শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা”?

সুর সাধনার সময়ে সেই ঘরে এসে ঢুকলেন রাধারমণ ঘোষ। রাধারমণ ঘোষের আবির্ভাবে সংগীতের রেওয়াজে বিঘ্ন ঘটলেও গায়ক তা গায়ে মাখলেন না, শুধু জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। রাধারমণ কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, আমি শ্রীযুক্ত বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তরুণ যুবা সলজ্জ হেসে বললেন: আমি শ্রীযুক্ত বাবু নই। নিতান্তই রবি।

রাধারমণ প্রসন্নচিত্তে বিনীতভাবে বললেন, “আমি এসেছি আগরতলা থেকে। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি তার প্রাইভেট সেক্রেটারী। মহারাজার পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আমি। একটি ব্যাপারে আপনার সম্মতি আদায় করতে পাঠানো হয়েছে আমাকে”।

রবিবাবু অবাক হলেন। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রস্তাব, সম্মতি – কিছুর সঙ্গে কিছুর তিনি কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাচ্ছেন না। ভীষণ অসহায় বোধ করলেন তিনি। শেষে মরিয়া হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার বলুন তো? আমি তো আপনাদের মহারাজকে চিনি বলে মনে করতে পারছি না। তাছাড়া তিনি আমাকেই বা চেনেন কি করে”?

আজ্ঞে, সেই কথাটিই তো আমি বলতে এসেছি। আপনার ‘ভগ্নহৃদয়’ তিনি আগরতলায় বসে পড়েছেন। তাঁর দারুণ ভালো লেগেছে। যখনই তিনি আপনার কবিতা পড়েন, তখনই চোখের জলে ভেসে যান। কিছুকাল আগে তাঁর বড়মহিষীর মৃত্যু ঘটেছে, ইদানিং তাঁর নিজের শরীরও ভালো যাচ্ছে না। নতুবা তিনি নিজেই আসতেন আপনাকে বলতে যে, আপনার কবিতার তিনি গুনমুগ্ধ পাঠক। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে রাধারমণ কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। রবিবাবুর শরীর যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। একজন রাজার তাঁর মত অর্বাচীন এক কবির কবিতা ভালো লেগেছে এবং তা জানাতে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে সুদূর আগরতলা থেকে এখানে পাঠিয়েছেন যা ভাবাই যায় না, যেন এক দিবাস্বপ্ন। এই শেষ নয়, বিস্ময়ের আরও বাকী ছিল যেন।

একথা সেকথার পর রাধারমণ টুক করে আসল কথাটি পাড়লেন। বললেন, মহারাজার ইচ্ছে, আপনি আগরতলায় এসে ত্রিপুরার রাজসভাকে অলংকৃত করেন।

বিস্ময়ের পর বিস্ময়। রবিবাবু অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।

রাধারমণ হাসলেন। অর্থময় হাসি হেসে বললেন, ব্যাপারটা সোজা। ত্রিপুরার রাজসভাকে আপনি বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। যদুভট্টের মতো জ্ঞানীগুণীরা আছেন সেখানে। আপনি এলে ষোলকলা পূর্ণ হয়। মহারাজের অভিলাষ আপনি পূর্ণ করবেন, এই প্রত্যাশা নিয়ে এসেছি। আপনি হবেন সভাকবি, আপনার সান্মানিক দাক্ষিণা অন্য কারোর চেয়ে কম হবে না। সমস্তরকম সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা হবে আপনার জন্য। আপনি রাজী হলে বাকিটুকু করার দায়িত্ব আমার।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, আপনি মহারাজাকে বলবেন, আমি তাঁর প্রস্তাবে নিজেকে বিশেষ সম্মানিত বোধ করছি। ত্রিপুরার রাজসভায় সভাকবির পদ অলংকৃত করতে পারলে আমি বিশেষ খুশি হতাম। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে শিলাইদহের জমিদারিতে চলে যেতে হবে। আমি দুঃখিত।

রবিবাবু রাধারমণকে বললেন, আপনি মহারাজা বীরচন্দ্রকে বলবেন, আপনি মহারাজা বীরচন্দ্রকে বলবেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য অধীর প্রতীক্ষা নিয়ে বসে আছি। তাঁকে আমার প্রনাম জানাবেন।

তারপর, অনেকদিন বাদে মহারাজ বীরচন্দ্র এসেছেন কলকাতায়। এবার কলকাতায় আসার মূল উদ্দেশ্য হল মূলত স্বাস্থ্যদ্ধার এবং বিশ্রাম। তবে মহারাজা বীরচন্দ্র একজন কবি এবং কবিতা সম্পর্কে তাঁর দুর্বলতা রয়েছে। কলকাতায় এলে যা আরও বেড়ে যায়। মহারাজা বীরচন্দ্র কলকাতায় এসেছেন শুনলে এক ধরণের ভিন্নরুচির লোক ১নং লিটল রাসেল স্ট্রীটের ত্রিপুরার রাজবাড়িতে ভিড় জমান। আজ এখনও সবাই এসে পৌঁছাননি। তবে জোড়াসাঁকোর তরুণ কবি রবিবাবু এসেছেন। তিনি একাই একশ। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন রাধারমণ ঘোষ, মহিম ঠাকুর এবং শম্ভু মুখুজ্যে।

মহারাজা বীরচন্দ্র মধ্যমণি হয়ে আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। সারা শরীরে অসুস্থতার ছাপ সুস্পষ্ট। মহারাজার মুখে ক্লান্তির রেখা, তবু তিনি হেসে বললেন, কি রবিবাবু! নতুন কি লিখলেন, সেখান থেকে কিছু আমাদের শোনান। রবিবাবু সলজ্জ হাসলেন। বীরচন্দ্র বললেন কয়েকদিন আগে আপনার ‘সোনার তরী’ কবিতার বইটি আমার হস্তগত হয়েছে। দারুন কাব্যগ্রন্থ। আপনি যদি এক্ষুণি কোন লেখা না শোনাতে চান, তবে আমি আপনাকে ‘সোনার তরী’ থেকে আপনারই কবিতা পাঠ করে শোনাতে পারি। তারপর ধ্যানমগ্ন ঋষির মত ভরাট গলায় মন থেকে গড়গড় করে দরদের সাথে আবৃত্তি শুরু করলেন।

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা    খরপরশা।

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।...

এদিকে ডা: মহেন্দ্রলাল সরকার এসেছেন মহারাজা বীরচন্দ্রকে দেখতে। কোন ভূমিকা না করে সরাসরি মহারাজার সামনে গিয়ে বললেন, হাঁ করুন তো, হাঁ? এবার জিহ্বাটা দেখান। বীরচন্দ্র হতচকিত হয়ে বাধ্য শিশুর মতো জিহ্বা বের করে দেখালেন। তারপর চোখের পাতা টেনে উল্টে ধরে চোখের মণিটুকু দেখলেন। স্টেথো দিয়ে বুকে পিঠে লাগিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। তারপর সৌজন্যের ধারেকাছে না গিয়ে বললেন: “আপনি শক্ত অসুখ বাধিয়েছেন। আপনার দুটো কিডনিই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।

মহারাজা বিষন্ন কন্ঠে বললেন, তাহলে আমার কি করণীয় এখন?

ডাঃ সরকার বললেন, আমার পরামর্শ হল, আপনি টেনশন ফ্রী জীবনযাপন করুন। ত্রিপুরা রাজ্যের চিন্তাভাবনা অন্যের কাছে দিয়ে দিন। রাজকীয় ঝুটঝামেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনুন।

বীরচন্দ্র বললেন, দেখো ডাক্তার, তুমি কিছু ভেবো না। সব হবে। আমি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকব, তোমাকে বলছি। কয়েকদিনের মধ্যে এই রবিবাবুকে নিয়ে কার্শিয়াং-এ চেঞ্জে যাচ্ছি। ওখানে নিরিবিলিতে কাব্যসূধা পান করব।

কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলে রথীকে নিয়ে মহারাজের সাথে কার্শিয়াং চললেন। অন্যান্য দিনের মত মহারাজা বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। সকালের চেয়ে বিকেলের আড্ডাটা বেশি জমে। এ আড্ডাটি শেষ হতে কোন কোন দিন বেশ রাত হয়ে যায়। তবু আলোচনা যেন অসমাপ্ত থেকে যায়। কবিতা পাঠ, গান আর আধ্যাত্মিক আলোচনা, এসবের জন্যেই তো সংসারের কোলাহল এড়িয়ে এই নিরিবিলি কার্শিয়াং-এ আসা। এখানে এসব ছাড়া আর কিছু নেই।

দেরিতে আসার জন্য রবিবাবু সসঙ্কোচে একটা কৈফিয়ত দেবার চেষ্ঠা করতেই বীরচন্দ্র লঘু স্বরে বললেন, আগে চা খেতে আজ্ঞা হোক। তারপর রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ বরং গান হোক। আপনিই এই গানটা গেয়ে শোনান আমাদের, ‘তোমাহীন কাটে দিবস হে প্রভু’।

বীরচন্দ্র বললেন, নিন, এবার শুরু করুন। রাধারমণ ঘোষ বসলেন তবলা নিয়ে। হারমোনিয়মে হাত রাখলেন, মহিম। মহারাজা বীরচন্দ্র, কোলে তুলে নিলেন পাখোয়াজ। রবিবাবু আরষ্টতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নিচু স্বরে গলায় সুর খেলাতে শুরু করলেন। বীরচন্দ্র তাঁর বাঁ হাতটি প্রসারিত করে আঙ্গুলের মাধ্যমে সুরলহরির ঢেউ তুলে বললেন, ‘তোমাহীন কাটে দিবস হে প্রভু’ – গানটি হবে বাগেশ্রী রাগে, আড়াঠেকা।

বার-দুই গানটার কলি ধীরে ধীরে গাইবার পর রবিবাবু যখন গলাকে খাদে নামিয়ে এনেছেন প্রায়, তক্ষুনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে মহারাজা বীরচন্দ্র নিজের গলায় গানটি তুলে এনে রাগ অক্ষুন্ন রেখে নিখাদ কন্ঠে শুরু করলেন গানটির খড়ি বোলি তর্জমা ‘তুম বিন্ কৈসে কাটে দিবস হে প্রভু’। গান থামলে রবিবাবু অবাক হয়ে বললেন, আপনি এমন চমৎকার কি করে গান? এতো আমারও প্রশ্ন, বীরচন্দ্র হেসে বললেন, “আপনি এরকম চমৎকার গান লেখেন কি করে?

রবিবাবু ও বীরচন্দ্র হো হো করে দুজনেই হেসে উঠলেন। গানের পর এবার বিরতি। এই ফাঁকে চা এল। আমি চাই, আপনার কবিতা লোকের মুখে মুখে ফিরুক। আপনার বই ঘরে ঘরে শোভা পাক।

নিজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রবীন্দ্রনাথ লজ্জায় আরও ম্রিয়মান হয়ে গেলেন। রবিবাবু কুন্ঠিতভাবে বললেন, আপনি আমাকে অধিক স্নেহ করেন, তাই আমার সম্পর্কে আপনার উচ্চাশা।

দেখুন জহুরি জহর চেনে বলে একটা কথা আছে। বীরচন্দ্র প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, আমি একজন জহুরী। খাঁটি জহর চিনতে আমার ভুল হয় না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বীরচন্দ্র স্বগতোক্তির মত বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলেন রবিবাবু, ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থে আপনার একটা কবিতা আছে – ‘প্রাণ’। মৃত্যুভাবনা গ্রাস করে ফেললে আপনার কবিতাটি আমি আবৃত্তি করি।

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে

জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।

কবিতাটি পাঠ করলে মনে বল পাই। বুকে ভরসা জাগে। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছে আমার অসুখের চিকিৎসা নেই। আমার তো মনে হয় মানুষের ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে মৃত্যু পিছু হটতে বাধ্য। আপনার কবিতা পাঠ করলে ইচ্ছাশক্তি দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। বাঁচতে সাধ জাগে। ইচ্ছা করে অনেককাল বাঁচি।

আজকের আসরটি জমে উঠেও জমবার সুযোগ পেল না। বিদায় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গাত্রোত্থান করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলে বীরচন্দ্র প্রতিদিনের মত আজও তাঁকে এগিয়ে দিতে এলেন। রবিবাবু বাধা দিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শরীর ভালো নেই। আপনাকে আসতে হবে না।

আজকে যে মহারাজার কি হল কে জানে। তিনি শুধু সিড়ি ভেঙে এগিয়ে দিতে নিচেই নামলেন না, বাড়ি থেকে বের হয়ে রবিবাবুর পাশাপাশি পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেন।

আপনি চলে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাব। বীরচন্দ্র রবিবাবুকে পথটুকু এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আর যখন আমি একা থাকি, আজকাল আমার কি হয়েছে জানি না, কেবলই মৃত্যুভাবনা আমাকে তাড়া করে।

কার্শিয়াং-এর প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে মহারাজা বীরচন্দ্র আস্তে আস্তে পা ফেলে রবিবাবুকে পাহাড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন। মহারাজের পাশে এবং পেছনে রয়েছেন মহিম ও রাধারমণ ঘোষ। হঠাৎ বীরচন্দ্র বললেন, জানেন রবিবাবু, আমার প্রিয়তমা মহিষী ভানুমতির মৃত্যুর পর আমাকে বিষাদ এবং মৃত্যুভাবনা গ্রাস করে ফেলেছিল, এখনও প্রায় সেরকম অবস্থা আমার। এখন মনশ্চক্ষে ভানুমতিকে দেখতে পাই যেন। সেদিন শোকাকুল হয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, সে কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে আমার। রবিবাবু পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, আপনার সেই কবিতাটি আমার শুনতে ইচ্ছা করছে। আপনি যদি কবিতাটি শোনান তবে আমি খুব খুশি হবো। বীরচন্দ্র হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে নিজের কবিতাটির একটি অংশ আবৃত্তি শুরু করলেন।

হেথা আমি আছি পড়ে হৃদয়ের ভাঙ্গা ঘরে

গুনিতেছি সারাদিন জীবনের বেলা।

যেন রে উপলদেশে সাথীহীন একা বসে

জানিনা ফুরাবে কবে এ মরতের খেলা।

দুঃখিত গলায় রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। আপনার স্বকন্ঠে স্বরচিত কবিতা শুনতে পেলাম।

বীরচন্দ্র নিজের প্রশংসায় খুব বিব্রতবোধ করলেন। বললেন, ছি ছি। কি বলছেন আপনি। তারপর প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা রবিবাবু আপনি তো অনেক কবিতা লিখেছেন। কবিরা দুঃখীর দুঃখ, বিরহীর বেদনা উপলব্ধি করতে পারে। আমার ওই ক্ষুদ্র কবিতাটির সঙ্গে মিল আছে ওইরকম কাছাকাছি ভাবধারা নিয়ে যদি আপনার কোনও কবিতা থাকে তবে বরং সেটি আমাকে শোনান। তাহলে দারুন হবে।

রবিবাবু হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলেন। তারপর মন থেকে নিজের লেখা ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘দিনশেষে’ কবিতার প্রথমটি আবৃত্তি করলেন।

দিনশেষ হয়ে এল, আঁধারিল ধরণী,

আর বেয়ে কাজ নাই তরণী।

"হ্যাঁগো এ কাদের দেশে বিদেশী নামিনু এসে'

তাহারে শুধানু হেসে যেমনি--

অমনি কথা না বলি     ভরা ঘট ছলছলি

নতমুখে গেল চলি তরুণী।

রবীন্দ্রনাথ থামলে বীরচন্দ্র নিজে গুনগুন করতে লাগলেন “দিনশেষ হয়ে এল/ আঁধারিল ধরণী/ আর বেয়ে কাজ নাই তরণী”।

রবিবাবুকে বুকে জড়িয়ে বীরচন্দ্র বললেন, দারুণ। আপনার তুলনা নেই। আপনাকে আমি দুহাত তুলে আশীর্বাদ করি। কথাটা বলতে বলতে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাশির দমক এল। কাশতে কাশতে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। ধরাধরি করে তাঁকে সবাই আবার মহারাজার নিজের আবাসে নিয়ে গেলেন। কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। রবিবাবু বাইরের ঘরে অনেকক্ষণ বিমর্ষভাবে বসে রইলেন। শেষে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে উঠতে হল, কেননা ঘরে গিয়ে তাঁকে গোছগাছ করতে হবে। কাল সকালে কলকাতার ট্রেন।

পরদিন বীরচন্দ্রের শারীরীক অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটুকু তাঁর কাটছে না। মাঝেমধ্যে চোখ খুলে তিনি কাকে যেন খুঁজছেন। মহিম এবং রাধারমণ খুব ভেঙে পড়েছেন। স্থানীয় ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে মহারাজা বীরচন্দ্রকে এই অবস্থাতেই কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হল।

কলকাতায় এসে স্থানীয় এক চিকিৎসককে দেখানোর কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফিরলো ঠিকই কিন্তু শরীর খুব দুর্বল। কার্শিয়াং-এ থাকার সময় মহারাজ রবিবাবুকে বলেছিলেন ‘বিসর্জন নাটকটা কি ত্রিপুরায় মঞ্চস্থ করা যায়?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বপ্নে পাওয়া গল্প 'রাজর্ষি'কে ইতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ করতে রাজার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “স্বপ্ন দেখিলাম, কোন এক মন্দিরের সিঁড়ির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুন ব্যাকুলতায় তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে - বাবা, একি! এ যে রক্ত! বালিকার এই কাতরতায় বাপ অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোনমতে তার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে। জাগিয়া উঠিয়ায় মনে হইল এটি আমার স্বপনলব্ধ গল্প। এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্য এর পুনরাবৃত্ত মিশায়ে রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে বালকে বাহির করিতে লাগিলাম”। এই 'রাজর্ষি' অবলম্বনেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন 'বিসর্জন' নাটক।

কলকাতায় ফিরে রবীন্দ্রনাথ মনে করলেন, মহারাজ যখন ঠাকুর বাড়িতে আসবেন তখন ওই নাটকটি মঞ্চস্থ করতে হবে, এই হিসেবে বেশ জোরে শুরু হল মহড়া। মহারাজা কলকাতায় এলে সঙ্গীত সমাজের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। মঞ্চস্থ হয় 'বিসর্জন' নাটক। রবীন্দ্রনাথ নিজে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেন। রচনা করেছিলেন সংবর্ধনা সঙ্গীত। গান গেয়েছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ। সেই গানটি ছিল --
রাজ অধিরাজ তব ভালে জয়মালা,
ত্রিপুর-পুরলক্ষ্মী বহে তব বরণডালা।
ক্ষীণ-জন-ভয়-তারণ অভয় তব বাণী
দীনজন দুঃখহরণ নিপুণ তব পাণি।

ঠাকুরবাড়িতে আজ অনেক গণ্যমান্য মানুষ এসেছেন এই নাটকটা দেখতে। সবাই খুব সুন্দর অভিনয় করলো তাই মহারাজ বীরচন্দ্র সবাইকে একটি করে উপহার দিলেন, কিন্তু মুখটা গম্ভীর। তাঁর ভবনে ফিরে তিনি খুব মন খারাপ করলেন, ত্রিপুরায় এই নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে, শুধু কলকাতাতেই ভাল নাটক হবে, ত্রিপুরায় হবে না?

তারপর বললেন, ‘আমি এখনই ত্রিপুরা যাবো। আমার প্রাসদে একটা স্টেজ বানাবো, ‘বিসর্জন’ নাটক দিয়েই শুরু করবো। সবাইকে বুঝিয়ে দেবো ত্রিপুরা কারও চেয়ে কম নয়’। ‘বিসর্জন’ বইটা হাতে ছিল, প্রথমে বইটি খসে পড়ল হাত থেকে, তারপর তিনি ঝুপ করে পড়ে গেলেন, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, ঠোঁটের পাশে ফেনা। সতেরোদিন পর মহারাজের একটু উন্নতি হল। সবাই খুশি হলো, চিকিৎসক বলে গেলেন, এই সময়টা সাবধানে থাকতে কারণ যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে। সত্যিই অঘটন ঘটল। শত চেষ্ঠা সত্ত্বেও মহারাজা বীরচন্দ্র সবকিছুর উর্ধে চলে গেলেন। মহারাজার শেষ সময়ে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকতে পারেননি কারণ সেই সময় মৃণালিনী দেবী অসুস্থ ছিলেন। পরের দিন তিনি দ্রুত এসে পৌঁছালেন কলকাতার কেওড়াতলা শ্মশান ঘাটে। তাঁর শেষকৃত্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সাঙ্গ হল। রবীন্দ্রনাথ মহারাজার বুকের উপর একটা ফুলের তোড়া রাখলেন। তারপর শ্মশানের পাশে নীরবে বয়ে চলা আদিগঙ্গার পাড়ে অশ্রুসজল চোখে বসে রইলেন। মহারাজা বীরচন্দ্রের আর ত্রিপুরায় ফেরা হল না।  

ঋণঃ প্রথম আলো। সুনী গঙ্গোপাধ্যায়। রাজা ও কবি। অজয় দাশগুপ্ত। এবং রবীন্দ্র রচনাবলী।

সময়টা ১৮৮৩ সাল। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্য তাঁর প্রিয় মহিষী ভানুমতীর মৃত্যুতে শোকাকুল। বৃন্দাবনে গিয়ে তাঁর পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে সবে আগরতলায় ফিরে এসেছেন। প্রিয়াবিরহে কাতর মহারাজের মন ভাল নেই। রাজমহিষীর মৃত্যুর পর থেকে সমস্ত রকম প্রমদানুষ্ঠানের ওপর যবনিকাপাত হয়েছে।

তবে, অনেক দিন পর আজ একটা ব্যতিক্রমী দিন বলে মনে হচ্ছে। আজ সবাইকে অবাক করে দিয়ে মহারাজা উঠে এসেছেন সভায়। ভানুমতির মৃত্যুতে বিকেলে ফুর্তির সব আয়োজন প্রাণহীন পাষাণে পরিণত হয়ে গিয়েছিল, আজ তাতে মহারাজার কল্যাণে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হল।

মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য চন্দ্রবংশীয় শাসনের একশ পচাত্তরতম উত্তরাধিকারী। কিংবদন্তী অনুসারে তিনি মহাভারতের যযাতির বংশধর। ভোগ-বাসনায় অতৃপ্ত যযাতি তাঁর পুত্রদের কাছে যৌবন ধার চেয়েছিলেন। যে কজন পুত্র তাঁদের পিতার এই উদ্ভট খেয়ালের বিরোধীতা করেছিলেন তাদেরকে যযাতি নির্বাসনে পাঠান। সেই নির্বাসিত পুত্রদের একজন ছিলেন দ্রুহ্য, তিনি আর্যাবর্ত ত্যাগ করে অনেক দূরে এসে – উত্তরপূর্ব ভারতের সীমানায় কীরাট রাজ্যের স্থানীয় রাজাকে পরাজিত করে ত্রিপুরা রাজ্য গড়েন।

আর ভানুমতি হলেন মহারাজার জ্যেষ্ঠা রানী। মহারাজের প্রায় সমবয়েসী। তাদের বিবাহের সময় দু’জনেই ছিলেন বালক-বালিকা। অর্ধাঙ্গিনী হবার আগে ভানুমতী ছিলেন বীরচন্দ্রের খেলার সঙ্গিনী। তাঁর মৃত্যুর পর যখন মহারাজা বীরচন্দ্র খুব ভেঙে পড়েন তখন রবীন্দ্রনাথের ‘ভগ্নহৃদয়’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি পড়ে তাঁর মন কিছুটা শান্ত হয়।

রবিঠাকুরের কবিতা পড়ে এতটাই মোহিত হন যে, তিনি তাঁর সচিব রাধারমণ ঘোষকে কলকাতায় পাঠান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য একটি মানপত্র, একজোড়া ধুতি, একটি উত্তরীয়, একটি শাল, হাতির দাঁতের তৈরি দুটি পুতুল আর একটি মখমলের পাউচে পাঁচটি মোহর পাঠান সম্মানী হিসেবে।

পরবর্তীতে, রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লেখেন: “মনে আছে এই লেখা বাহির হইবার কিছুকাল পরে কলিকাতায় ত্রিপুরার স্বর্গীয় মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্যের মন্ত্রী আমার সহিত দেখা করিতে আসেন। কাব্যটি মহারাজের ভালো লাগিয়াছে, এবং কবির সাহিত্য সাধনার সফলতা সম্বন্ধে তিনি উচ্চ আশা পোষণ করেন, কেবল এই কথাটি জানাইবার জন্যই তিনি তাঁহার অমাত্যকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন”।

অন্য এক অনুষ্ঠানেও কবি বলেছিলেন, “জীবনে যে যশ আমি পাচ্ছি, পৃথিবীর মধ্যে তিনিই তার প্রথম সূচনা করে দিয়েছিলেন, তাঁর অভিনন্দনের দ্বারা। তিনি আমার অপরিণত আরম্ভের মধ্যে ভবিষ্যতের ছবি তাঁর বিচক্ষণ দৃষ্টির দ্বারা দেখতে পেয়েই তখনই আমাকে কবি সম্বোধনে সম্মানিত করেছিলেন। যিনি উপরের শিখরে থাকেন, তিনি যেমন যা সহজে চোখে পড়ে না তাকেও দেখতে পান, বীরচন্দ্রও তেমনি সেদিন আমার মধ্যে অস্পষ্টকে দেখেছিলেন”।

যাই হোক, আজ মহারাজা হাতির দাঁতের সিংহাসনে না বসে সোজা নেমে এসে জাজিম বিছানো মেঝেতে রাধারমণ ঘোষ আর মদন মিত্রের মুখোমুখি বসলেন। ভানুমতির মৃত্যুর পরে যে কবিতাগুলি পড়ে এতদিন মহারাজার বিরহ যন্ত্রণায় প্রলেপ পড়েছিল আজ রাধারমণকে দিলেন সেই কাব্যগ্রন্থ থেকে কবিতা পাঠ করতে।

রাধারমণ কবিতা পাঠ করার শুরুতেই হোঁচট খেলেন। এই কবিতার বইটি তিনি আগে কখনও দেখেননি, কি সুরে কি ছন্দে পড়বেন তাও জানা নেই। আগে থেকে তিনি রেওয়াজ বা রপ্ত করেও আসেননি। মহারাজা রাধারমণের অস্বস্তির কারণটুকু ধরতে পারলেন। বীরচন্দ্র ক্ষমাসুন্দর হাসি হেসে বললেন, ঠিক আছে। আমিই পড়ছি। গলা কেশে ভরাট কন্ঠে বীরচন্দ্র দীর্ঘলয়ে কবিতা পড়তে শুরু করলেন।

হয়ত জান না, দেবি, অদৃশ্য বাঁধন দিয়া

নিয়মিত পথে এক ফিরাইছ মোর হিয়া।

গেছি দূরে, গেছি কাছে,   সেই আকর্ষণ আছে,

পথভ্রষ্ট হই নাক তাহারি অটল বলে।

কবিতাপাঠ বন্ধ রেখে বীরচন্দ্র উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। যেন কতদূরে চলে গেছেন নিজেই জানেন না। প্রয়াতা স্ত্রী ভানুমতির স্মৃতি তাকে আবেশে আবৃত করে রেখেছে। কান্নাপ্লুত কন্ঠে কবিতাপাঠে আবার মগ্ন হয়ে পড়লেন।

স্নেহের অরুণালোকে খুলিয়া হৃদয় প্রাণ

 পারে দাঁড়ায়ে, দেবি, গাহিনু যে শেষ গান

তোমারি মনের ছায়   সে গান আশ্রয় চায়--

একটি নয়নজল তাহারে করিও দান।

পাঠ শেষ করে বীরচন্দ্র ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। স্ত্রী বিয়োগজনিত ভগ্ন হৃদয়ের জ্বালাকে স্নিগ্ধতার প্রলেপ দিয়ে জুড়িয়ে দিয়েছে কবিতা। তারপর কবিতার নম্রতাকে ছুটি দিয়ে কন্ঠস্বরে রাজকীয় সহজাত স্বভাব ফিরিয়ে এনে বললেন, “রাধারমণ, তোমার উপর একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। এই কবিতার বইয়ের কবিকে তুমি আমার রাজসভায় নিয়ে আসবে বুঝেছো”?

রাধারমণ ঘোষের হাতে কবিতার বইটি তুলে দিয়ে বীরচন্দ্র বললেন: “আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, কোনো কথা জানতে চাইনা। আমি চাই আমার রাজসভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির দ্বারা অলংকৃত হউক”।

বীরচন্দ্র কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন তারপর আপনমনে নিজেই বলতে লাগলেন, ‘ভগ্নহৃদয়’ পড়ে আমার মনে হচ্ছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী বা নিকট আত্মীয় কেউ মারা গিয়েছেন। ‘ভগ্নহৃদয়’ হল আমার জন্য, আমার সমস্ত শোকসন্তপ্ত হৃদয় জুড়াবার গাঁথা।

 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির দোতলার একটি কোণের ঘরে একজন তরুণ যুবা গলা সাধছিলেন। সাধছিলেন বলার চেয়ে বরং বলা ভালো একটি গানে সুর আরোপ করছিলেন। গানের প্রথম লাইনটিতে ঘুরে ফিরে সুর দিয়ে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করছিলেন তিনি – “আমায়   বোলো না গাহিতে বোলো না। এ কি  শুধু হাসি খেলা, প্রমোদের মেলা, শুধু মিছেকথা ছলনা”?

সুর সাধনার সময়ে সেই ঘরে এসে ঢুকলেন রাধারমণ ঘোষ। রাধারমণ ঘোষের আবির্ভাবে সংগীতের রেওয়াজে বিঘ্ন ঘটলেও গায়ক তা গায়ে মাখলেন না, শুধু জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন। রাধারমণ কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, আমি শ্রীযুক্ত বাবু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। তরুণ যুবা সলজ্জ হেসে বললেন: আমি শ্রীযুক্ত বাবু নই। নিতান্তই রবি।

রাধারমণ প্রসন্নচিত্তে বিনীতভাবে বললেন, “আমি এসেছি আগরতলা থেকে। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র আমাকে পাঠিয়েছেন। আমি তার প্রাইভেট সেক্রেটারী। মহারাজার পক্ষ থেকে একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি আমি। একটি ব্যাপারে আপনার সম্মতি আদায় করতে পাঠানো হয়েছে আমাকে”।

রবিবাবু অবাক হলেন। ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্রের প্রস্তাব, সম্মতি – কিছুর সঙ্গে কিছুর তিনি কোনো যোগাযোগ খুঁজে পাচ্ছেন না। ভীষণ অসহায় বোধ করলেন তিনি। শেষে মরিয়া হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার বলুন তো? আমি তো আপনাদের মহারাজকে চিনি বলে মনে করতে পারছি না। তাছাড়া তিনি আমাকেই বা চেনেন কি করে”?

আজ্ঞে, সেই কথাটিই তো আমি বলতে এসেছি। আপনার ‘ভগ্নহৃদয়’ তিনি আগরতলায় বসে পড়েছেন। তাঁর দারুণ ভালো লেগেছে। যখনই তিনি আপনার কবিতা পড়েন, তখনই চোখের জলে ভেসে যান। কিছুকাল আগে তাঁর বড়মহিষীর মৃত্যু ঘটেছে, ইদানিং তাঁর নিজের শরীরও ভালো যাচ্ছে না। নতুবা তিনি নিজেই আসতেন আপনাকে বলতে যে, আপনার কবিতার তিনি গুনমুগ্ধ পাঠক। একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে রাধারমণ কিছুক্ষণের জন্য থামলেন। রবিবাবুর শরীর যেন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলো। একজন রাজার তাঁর মত অর্বাচীন এক কবির কবিতা ভালো লেগেছে এবং তা জানাতে তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারীকে সুদূর আগরতলা থেকে এখানে পাঠিয়েছেন যা ভাবাই যায় না, যেন এক দিবাস্বপ্ন। এই শেষ নয়, বিস্ময়ের আরও বাকী ছিল যেন।

একথা সেকথার পর রাধারমণ টুক করে আসল কথাটি পাড়লেন। বললেন, মহারাজার ইচ্ছে, আপনি আগরতলায় এসে ত্রিপুরার রাজসভাকে অলংকৃত করেন।

বিস্ময়ের পর বিস্ময়। রবিবাবু অবাক হয়ে বললেন, ব্যাপারটা কি আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো।

রাধারমণ হাসলেন। অর্থময় হাসি হেসে বললেন, ব্যাপারটা সোজা। ত্রিপুরার রাজসভাকে আপনি বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার সঙ্গে তুলনা করতে পারেন। যদুভট্টের মতো জ্ঞানীগুণীরা আছেন সেখানে। আপনি এলে ষোলকলা পূর্ণ হয়। মহারাজের অভিলাষ আপনি পূর্ণ করবেন, এই প্রত্যাশা নিয়ে এসেছি। আপনি হবেন সভাকবি, আপনার সান্মানিক দাক্ষিণা অন্য কারোর চেয়ে কম হবে না। সমস্তরকম সুযোগসুবিধার ব্যবস্থা করা হবে আপনার জন্য। আপনি রাজী হলে বাকিটুকু করার দায়িত্ব আমার।

রবীন্দ্রনাথ বললেন, আপনি মহারাজাকে বলবেন, আমি তাঁর প্রস্তাবে নিজেকে বিশেষ সম্মানিত বোধ করছি। ত্রিপুরার রাজসভায় সভাকবির পদ অলংকৃত করতে পারলে আমি বিশেষ খুশি হতাম। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই আমাকে শিলাইদহের জমিদারিতে চলে যেতে হবে। আমি দুঃখিত।

রবিবাবু রাধারমণকে বললেন, আপনি মহারাজা বীরচন্দ্রকে বলবেন, আপনি মহারাজা বীরচন্দ্রকে বলবেন, আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য অধীর প্রতীক্ষা নিয়ে বসে আছি। তাঁকে আমার প্রনাম জানাবেন।

তারপর, অনেকদিন বাদে মহারাজ বীরচন্দ্র এসেছেন কলকাতায়। এবার কলকাতায় আসার মূল উদ্দেশ্য হল মূলত স্বাস্থ্যদ্ধার এবং বিশ্রাম। তবে মহারাজা বীরচন্দ্র একজন কবি এবং কবিতা সম্পর্কে তাঁর দুর্বলতা রয়েছে। কলকাতায় এলে যা আরও বেড়ে যায়। মহারাজা বীরচন্দ্র কলকাতায় এসেছেন শুনলে এক ধরণের ভিন্নরুচির লোক ১নং লিটল রাসেল স্ট্রীটের ত্রিপুরার রাজবাড়িতে ভিড় জমান। আজ এখনও সবাই এসে পৌঁছাননি। তবে জোড়াসাঁকোর তরুণ কবি রবিবাবু এসেছেন। তিনি একাই একশ। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত আছেন রাধারমণ ঘোষ, মহিম ঠাকুর এবং শম্ভু মুখুজ্যে।

মহারাজা বীরচন্দ্র মধ্যমণি হয়ে আরামকেদারায় শুয়ে শুয়ে আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। সারা শরীরে অসুস্থতার ছাপ সুস্পষ্ট। মহারাজার মুখে ক্লান্তির রেখা, তবু তিনি হেসে বললেন, কি রবিবাবু! নতুন কি লিখলেন, সেখান থেকে কিছু আমাদের শোনান। রবিবাবু সলজ্জ হাসলেন। বীরচন্দ্র বললেন কয়েকদিন আগে আপনার ‘সোনার তরী’ কবিতার বইটি আমার হস্তগত হয়েছে। দারুন কাব্যগ্রন্থ। আপনি যদি এক্ষুণি কোন লেখা না শোনাতে চান, তবে আমি আপনাকে ‘সোনার তরী’ থেকে আপনারই কবিতা পাঠ করে শোনাতে পারি। তারপর ধ্যানমগ্ন ঋষির মত ভরাট গলায় মন থেকে গড়গড় করে দরদের সাথে আবৃত্তি শুরু করলেন।

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা।

কূলে একা বসে আছি, নাহি ভরসা।

রাশি রাশি ভারা ভারা ধান কাটা হল সারা,

ভরা নদী ক্ষুরধারা    খরপরশা।

কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা।...

এদিকে ডা: মহেন্দ্রলাল সরকার এসেছেন মহারাজা বীরচন্দ্রকে দেখতে। কোন ভূমিকা না করে সরাসরি মহারাজার সামনে গিয়ে বললেন, হাঁ করুন তো, হাঁ? এবার জিহ্বাটা দেখান। বীরচন্দ্র হতচকিত হয়ে বাধ্য শিশুর মতো জিহ্বা বের করে দেখালেন। তারপর চোখের পাতা টেনে উল্টে ধরে চোখের মণিটুকু দেখলেন। স্টেথো দিয়ে বুকে পিঠে লাগিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। তারপর সৌজন্যের ধারেকাছে না গিয়ে বললেন: “আপনি শক্ত অসুখ বাধিয়েছেন। আপনার দুটো কিডনিই প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে।

মহারাজা বিষন্ন কন্ঠে বললেন, তাহলে আমার কি করণীয় এখন?

ডাঃ সরকার বললেন, আমার পরামর্শ হল, আপনি টেনশন ফ্রী জীবনযাপন করুন। ত্রিপুরা রাজ্যের চিন্তাভাবনা অন্যের কাছে দিয়ে দিন। রাজকীয় ঝুটঝামেলা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনুন।

বীরচন্দ্র বললেন, দেখো ডাক্তার, তুমি কিছু ভেবো না। সব হবে। আমি আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকব, তোমাকে বলছি। কয়েকদিনের মধ্যে এই রবিবাবুকে নিয়ে কার্শিয়াং-এ চেঞ্জে যাচ্ছি। ওখানে নিরিবিলিতে কাব্যসূধা পান করব।

কিছুদিন পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলে রথীকে নিয়ে মহারাজের সাথে কার্শিয়াং চললেন। অন্যান্য দিনের মত মহারাজা বীরচন্দ্র রবীন্দ্রনাথের জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। সকালের চেয়ে বিকেলের আড্ডাটা বেশি জমে। এ আড্ডাটি শেষ হতে কোন কোন দিন বেশ রাত হয়ে যায়। তবু আলোচনা যেন অসমাপ্ত থেকে যায়। কবিতা পাঠ, গান আর আধ্যাত্মিক আলোচনা, এসবের জন্যেই তো সংসারের কোলাহল এড়িয়ে এই নিরিবিলি কার্শিয়াং-এ আসা। এখানে এসব ছাড়া আর কিছু নেই।

দেরিতে আসার জন্য রবিবাবু সসঙ্কোচে একটা কৈফিয়ত দেবার চেষ্ঠা করতেই বীরচন্দ্র লঘু স্বরে বললেন, আগে চা খেতে আজ্ঞা হোক। তারপর রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, আজ বরং গান হোক। আপনিই এই গানটা গেয়ে শোনান আমাদের, ‘তোমাহীন কাটে দিবস হে প্রভু’।

বীরচন্দ্র বললেন, নিন, এবার শুরু করুন। রাধারমণ ঘোষ বসলেন তবলা নিয়ে। হারমোনিয়মে হাত রাখলেন, মহিম। মহারাজা বীরচন্দ্র, কোলে তুলে নিলেন পাখোয়াজ। রবিবাবু আরষ্টতা কাটিয়ে ওঠার জন্য নিচু স্বরে গলায় সুর খেলাতে শুরু করলেন। বীরচন্দ্র তাঁর বাঁ হাতটি প্রসারিত করে আঙ্গুলের মাধ্যমে সুরলহরির ঢেউ তুলে বললেন, ‘তোমাহীন কাটে দিবস হে প্রভু’ – গানটি হবে বাগেশ্রী রাগে, আড়াঠেকা।

বার-দুই গানটার কলি ধীরে ধীরে গাইবার পর রবিবাবু যখন গলাকে খাদে নামিয়ে এনেছেন প্রায়, তক্ষুনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে মহারাজা বীরচন্দ্র নিজের গলায় গানটি তুলে এনে রাগ অক্ষুন্ন রেখে নিখাদ কন্ঠে শুরু করলেন গানটির খড়ি বোলি তর্জমা ‘তুম বিন্ কৈসে কাটে দিবস হে প্রভু’। গান থামলে রবিবাবু অবাক হয়ে বললেন, আপনি এমন চমৎকার কি করে গান? এতো আমারও প্রশ্ন, বীরচন্দ্র হেসে বললেন, “আপনি এরকম চমৎকার গান লেখেন কি করে?

রবিবাবু ও বীরচন্দ্র হো হো করে দুজনেই হেসে উঠলেন। গানের পর এবার বিরতি। এই ফাঁকে চা এল। আমি চাই, আপনার কবিতা লোকের মুখে মুখে ফিরুক। আপনার বই ঘরে ঘরে শোভা পাক।

নিজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় রবীন্দ্রনাথ লজ্জায় আরও ম্রিয়মান হয়ে গেলেন। রবিবাবু কুন্ঠিতভাবে বললেন, আপনি আমাকে অধিক স্নেহ করেন, তাই আমার সম্পর্কে আপনার উচ্চাশা।

দেখুন জহুরি জহর চেনে বলে একটা কথা আছে। বীরচন্দ্র প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন, আমি একজন জহুরী। খাঁটি জহর চিনতে আমার ভুল হয় না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বীরচন্দ্র স্বগতোক্তির মত বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলেন রবিবাবু, ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থে আপনার একটা কবিতা আছে – ‘প্রাণ’। মৃত্যুভাবনা গ্রাস করে ফেললে আপনার কবিতাটি আমি আবৃত্তি করি।

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।

এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে

জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।

কবিতাটি পাঠ করলে মনে বল পাই। বুকে ভরসা জাগে। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছে আমার অসুখের চিকিৎসা নেই। আমার তো মনে হয় মানুষের ইচ্ছাশক্তি প্রবল হলে মৃত্যু পিছু হটতে বাধ্য। আপনার কবিতা পাঠ করলে ইচ্ছাশক্তি দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। বাঁচতে সাধ জাগে। ইচ্ছা করে অনেককাল বাঁচি।

আজকের আসরটি জমে উঠেও জমবার সুযোগ পেল না। বিদায় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গাত্রোত্থান করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলে বীরচন্দ্র প্রতিদিনের মত আজও তাঁকে এগিয়ে দিতে এলেন। রবিবাবু বাধা দিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার শরীর ভালো নেই। আপনাকে আসতে হবে না।

আজকে যে মহারাজার কি হল কে জানে। তিনি শুধু সিড়ি ভেঙে এগিয়ে দিতে নিচেই নামলেন না, বাড়ি থেকে বের হয়ে রবিবাবুর পাশাপাশি পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটতে শুরু করলেন।

আপনি চলে গেলে আমি খুব একা হয়ে যাব। বীরচন্দ্র রবিবাবুকে পথটুকু এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, আর যখন আমি একা থাকি, আজকাল আমার কি হয়েছে জানি না, কেবলই মৃত্যুভাবনা আমাকে তাড়া করে।

কার্শিয়াং-এর প্রচণ্ড শীতে খোলা আকাশের নিচে মহারাজা বীরচন্দ্র আস্তে আস্তে পা ফেলে রবিবাবুকে পাহাড়ি পথ বেয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন। মহারাজের পাশে এবং পেছনে রয়েছেন মহিম ও রাধারমণ ঘোষ। হঠাৎ বীরচন্দ্র বললেন, জানেন রবিবাবু, আমার প্রিয়তমা মহিষী ভানুমতির মৃত্যুর পর আমাকে বিষাদ এবং মৃত্যুভাবনা গ্রাস করে ফেলেছিল, এখনও প্রায় সেরকম অবস্থা আমার। এখন মনশ্চক্ষে ভানুমতিকে দেখতে পাই যেন। সেদিন শোকাকুল হয়ে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম, সে কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে আমার। রবিবাবু পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে বললেন, আপনার সেই কবিতাটি আমার শুনতে ইচ্ছা করছে। আপনি যদি কবিতাটি শোনান তবে আমি খুব খুশি হবো। বীরচন্দ্র হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে নিজের কবিতাটির একটি অংশ আবৃত্তি শুরু করলেন।

হেথা আমি আছি পড়ে হৃদয়ের ভাঙ্গা ঘরে

গুনিতেছি সারাদিন জীবনের বেলা।

যেন রে উপলদেশে সাথীহীন একা বসে

জানিনা ফুরাবে কবে এ মরতের খেলা।

দুঃখিত গলায় রবীন্দ্রনাথ বললেন, আমি নিজেকে খুবই সৌভাগ্যবান মনে করছি। আপনার স্বকন্ঠে স্বরচিত কবিতা শুনতে পেলাম।

বীরচন্দ্র নিজের প্রশংসায় খুব বিব্রতবোধ করলেন। বললেন, ছি ছি। কি বলছেন আপনি। তারপর প্রসঙ্গান্তরে যাবার জন্য তাড়াতাড়ি বললেন, আচ্ছা রবিবাবু আপনি তো অনেক কবিতা লিখেছেন। কবিরা দুঃখীর দুঃখ, বিরহীর বেদনা উপলব্ধি করতে পারে। আমার ওই ক্ষুদ্র কবিতাটির সঙ্গে মিল আছে ওইরকম কাছাকাছি ভাবধারা নিয়ে যদি আপনার কোনও কবিতা থাকে তবে বরং সেটি আমাকে শোনান। তাহলে দারুন হবে।

রবিবাবু হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে লাগলেন। তারপর মন থেকে নিজের লেখা ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘দিনশেষে’ কবিতার প্রথমটি আবৃত্তি করলেন।

দিনশেষ হয়ে এল, আঁধারিল ধরণী,

আর বেয়ে কাজ নাই তরণী।

"হ্যাঁগো এ কাদের দেশে বিদেশী নামিনু এসে'

তাহারে শুধানু হেসে যেমনি--

অমনি কথা না বলি     ভরা ঘট ছলছলি

নতমুখে গেল চলি তরুণী।

রবীন্দ্রনাথ থামলে বীরচন্দ্র নিজে গুনগুন করতে লাগলেন “দিনশেষ হয়ে এল/ আঁধারিল ধরণী/ আর বেয়ে কাজ নাই তরণী”।

রবিবাবুকে বুকে জড়িয়ে বীরচন্দ্র বললেন, দারুণ। আপনার তুলনা নেই। আপনাকে আমি দুহাত তুলে আশীর্বাদ করি। কথাটা বলতে বলতে মহারাজা বীরচন্দ্রের কাশির দমক এল। কাশতে কাশতে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। ধরাধরি করে তাঁকে সবাই আবার মহারাজার নিজের আবাসে নিয়ে গেলেন। কথা বলতে তাঁর কষ্ট হচ্ছে। রবিবাবু বাইরের ঘরে অনেকক্ষণ বিমর্ষভাবে বসে রইলেন। শেষে অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে উঠতে হল, কেননা ঘরে গিয়ে তাঁকে গোছগাছ করতে হবে। কাল সকালে কলকাতার ট্রেন।

পরদিন বীরচন্দ্রের শারীরীক অবস্থার আরও অবনতি ঘটল। তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটুকু তাঁর কাটছে না। মাঝেমধ্যে চোখ খুলে তিনি কাকে যেন খুঁজছেন। মহিম এবং রাধারমণ খুব ভেঙে পড়েছেন। স্থানীয় ডাক্তারদের পরামর্শ নিয়ে মহারাজা বীরচন্দ্রকে এই অবস্থাতেই কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হল।

কলকাতায় এসে স্থানীয় এক চিকিৎসককে দেখানোর কিছুক্ষণ পর তাঁর জ্ঞান ফিরলো ঠিকই কিন্তু শরীর খুব দুর্বল। কার্শিয়াং-এ থাকার সময় মহারাজ রবিবাবুকে বলেছিলেন ‘বিসর্জন নাটকটা কি ত্রিপুরায় মঞ্চস্থ করা যায়?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বপ্নে পাওয়া গল্প 'রাজর্ষি'কে ইতিহাসের উপাদানে সমৃদ্ধ করতে রাজার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “স্বপ্ন দেখিলাম, কোন এক মন্দিরের সিঁড়ির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুন ব্যাকুলতায় তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে - বাবা, একি! এ যে রক্ত! বালিকার এই কাতরতায় বাপ অত্যন্ত ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোনমতে তার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে। জাগিয়া উঠিয়ায় মনে হইল এটি আমার স্বপনলব্ধ গল্প। এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্য এর পুনরাবৃত্ত মিশায়ে রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে বালকে বাহির করিতে লাগিলাম”। এই 'রাজর্ষি' অবলম্বনেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন 'বিসর্জন' নাটক।

কলকাতায় ফিরে রবীন্দ্রনাথ মনে করলেন, মহারাজ যখন ঠাকুর বাড়িতে আসবেন তখন ওই নাটকটি মঞ্চস্থ করতে হবে, এই হিসেবে বেশ জোরে শুরু হল মহড়া। মহারাজা কলকাতায় এলে সঙ্গীত সমাজের পক্ষ থেকে তাঁকে সংবর্ধনা জানানো হয়। মঞ্চস্থ হয় 'বিসর্জন' নাটক। রবীন্দ্রনাথ নিজে রঘুপতির ভূমিকায় অভিনয় করেন। রচনা করেছিলেন সংবর্ধনা সঙ্গীত। গান গেয়েছিলেন নাটোরের মহারাজা জগদিন্দ্র নাথ। সেই গানটি ছিল --
রাজ অধিরাজ তব ভালে জয়মালা,
ত্রিপুর-পুরলক্ষ্মী বহে তব বরণডালা।
ক্ষীণ-জন-ভয়-তারণ অভয় তব বাণী
দীনজন দুঃখহরণ নিপুণ তব পাণি।

ঠাকুরবাড়িতে আজ অনেক গণ্যমান্য মানুষ এসেছেন এই নাটকটা দেখতে। সবাই খুব সুন্দর অভিনয় করলো তাই মহারাজ বীরচন্দ্র সবাইকে একটি করে উপহার দিলেন, কিন্তু মুখটা গম্ভীর। তাঁর ভবনে ফিরে তিনি খুব মন খারাপ করলেন, ত্রিপুরায় এই নাটক মঞ্চস্থ করতে হবে, শুধু কলকাতাতেই ভাল নাটক হবে, ত্রিপুরায় হবে না?

তারপর বললেন, ‘আমি এখনই ত্রিপুরা যাবো। আমার প্রাসদে একটা স্টেজ বানাবো, ‘বিসর্জন’ নাটক দিয়েই শুরু করবো। সবাইকে বুঝিয়ে দেবো ত্রিপুরা কারও চেয়ে কম নয়’। ‘বিসর্জন’ বইটা হাতে ছিল, প্রথমে বইটি খসে পড়ল হাত থেকে, তারপর তিনি ঝুপ করে পড়ে গেলেন, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে, ঠোঁটের পাশে ফেনা। সতেরোদিন পর মহারাজের একটু উন্নতি হল। সবাই খুশি হলো, চিকিৎসক বলে গেলেন, এই সময়টা সাবধানে থাকতে কারণ যে কোন সময় অঘটন ঘটতে পারে। সত্যিই অঘটন ঘটল। শত চেষ্ঠা সত্ত্বেও মহারাজা বীরচন্দ্র সবকিছুর উর্ধে চলে গেলেন। মহারাজার শেষ সময়ে রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত থাকতে পারেননি কারণ সেই সময় মৃণালিনী দেবী অসুস্থ ছিলেন। পরের দিন তিনি দ্রুত এসে পৌঁছালেন কলকাতার কেওড়াতলা শ্মশান ঘাটে। তাঁর শেষকৃত্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে সাঙ্গ হল। রবীন্দ্রনাথ মহারাজার বুকের উপর একটা ফুলের তোড়া রাখলেন। তারপর শ্মশানের পাশে নীরবে বয়ে চলা আদিগঙ্গার পাড়ে অশ্রুসজল চোখে বসে রইলেন। মহারাজা বীরচন্দ্রের আর ত্রিপুরায় ফেরা হল না।  

ঋণঃ প্রথম আলো। সুনী গঙ্গোপাধ্যায়। রাজা ও কবি। অজয় দাশগুপ্ত। এবং রবীন্দ্র রচনাবলী।


0 comments

Saurav Chakraborty

Saurav Chakraborty

Shared publicly - 25th Nov, 21 12:36 am

অসাধারণ একটি প্রবন্ধ।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait