চৈতী হাওয়া (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

চৈতী হাওয়া (ছায়ানট কাব্যগ্রন্থ)

হারিয়ে গেছ অন্ধকারে-পাইনি খুঁজে আর,
আজ্কে তোমার আমার মাঝে সপ্ত পারাবার !
আজ্কে তোমার জন্মদিন-
স্মরণ-বেলায় নিদ্রাহীন
হাত্ড়ে ফিরি হারিয়ে-যাওয়ার অকূল অন্ধকার !
এই -সে হেথাই হারিয়ে গেছে কুড়িয়ে-পাওয়া হার !

শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল,
কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল ?
আঁধার দীঘির রাঙলে মুখ,
নিটোল ঢেউ-এর ভাঙলে বুক,-
কোন্‌ পূজারী নিল ছিঁড়ে? ছিন্ন তোমার দল
ঢেকেছে আজ কোন্‌ দেবতার কোন্‌ সে পাষাণ-তল ?

অস্ত-খেয়ার হারামাণিক-বোঝাই-করা না’
আস্‌ছে নিতুই ফিরিয়ে দেওয়ার উদয়-পারের গাঁ
ঘাটে আমি রই ব’সে
আমার মাণিক কই গো সে ?
পারাবারের ঢেউ-দোলানী হানছে বুকে ঘা !
আমি খুঁজি ভিড়ের মাঝে চেনা কমল-পা !

বইছে আবার চৈতী হাওয়া গুম্রে ওঠে মন,
পেয়েছিলাম এম্‌নি হাওয়ায় তোমার পরশন।
তেম্‌নি আবার মহুয়া-মউ
মৌমাছিদের কৃষ্ণ-বউ
পান ক’রে ওই ঢুল্‌ছে নেশায়, দুলছে মহুল বন,
ফুল-সৌখিন্‌ দখিন হাওয়ায় কানন উচাটন !

ADVERTISEMENT

প’ড়ছে মনে টগর চাঁপা বেল চামেলি যুঁই,
মধুপ দেখে যাদের শাখা আপ্‌নি যেত নুই।
হাস্‌তে তুমি দুলিয়ে ডাল,
গোলাপ হ’য়ে ফুটতো গাল
থর্‌কমলী আঁউরে যেত তপ্ত ও-গাল ছুঁই !
বকুল শাখা-ব্যকুল হ’ত টলমলাত ভুঁই !

চৈতী রাতের গাইত’ গজল বুলবুলিয়ার রব,
দুপুর বেলায় চবুতরায় কাঁদত কবুতর !
ভুঁই- তারকা সুন্দরী
সজনে ফুলের দল ঝরি’
থোপা থোপা লা ছড়াত দোলন-খোঁপার’ পর।
ঝাজাল হাওয়ায় বাজত উদাস মাছরাঙার স্বর !

পিয়ালবনায় পলাশ ফুলের গেলাস-ভরা মউ !
খেত বঁধুর জড়িয়ে গলা সাঁওতালিয়া বউ !
লুকিয়ে তুমি দেখতে তাই,
বলতে, ‘আমি অমনি চাই !
খোঁপায় দিতাম চাঁপা গুঁজে, ঠোঁটে দিতাম মউ !
হিজল শাখায় ডাকত পাখি “ বউ গো কথা কউ”

ডাকত ডাহুক জল- পায়রা নাচত ভরা বিল,
জোড়া ভুর” ওড়া যেন আসমানে গাঙচিল
হঠাৎ জলে রাখতে পা,
কাজলা দীঘির শিউরে গা-
কাঁটা দিয়ে উঠত মৃণাল ফুটত কমল-ঝিল !
ডাগর চোখে লাগত তোমার সাগর দীঘির নীল !

উদাস দুপুর কখন গেছে এখন বিকেল যায়,
ঘুম জড়ানো ঘুমতী নদীর ঘুমুর পরা পায় !
শঙ্খ বাজে মন্দিরে,
সন্ধ্যা আসে বন ঘিরে,
ঝাউ-এর শাখায় ভেজা আঁধার কে পিঁজেছে হায় !
মাঠের বাঁশী বন্‌-উদাসী ভীম্‌পলাশী গায়অ

বাউল আজি বাউল হ’ল আমরা তফাতে !
আম-মুকুলের গুঁজি-কাঠি দাও কি খোঁপাতে ?
ডাবের শীতল জল দিয়ে
মুখ মাজ’কি আর প্রিয়ে ?
প্রজাপতির ডাক-ঝরা সোনার টোপাতে
ভাঙা ভুর” দাও কি জোড়া রাতুল শোভাতে ?

বউল ঝ’রে ফ’লেছ আজ থোলো থোলো আম,
রসের পীড়ায় টস্‌টসে বুক ঝুরছে গোপাবজাম !
কামরাঙারা রাঙল ফের
পীড়ন পেতে ঐ মুখের,
স্মরণ ক’রে চিবুক তোমার, বুকের তোমার ঠাম-
জামর”লে রস ফেটে পড়ে, হায়, কে দেবে দাম !

ক’রেছিলাম চাউনি চয়ন নয়ন হ’তে তোর,
ভেবেছিলুম গাঁথ্‌ব মালা পাইনে খুঁজে ডোর !
সেই চাহনি নীল-কমল
ভ’রল আমার মানস-জল,
কমল-কাঁটার ঘা লেগেছে মর্মমূলে মোর !
বক্ষে আমার দুলে আঁখির সাতনরী-হার লোর !

তরী আমার কোন্‌ কিনারায় পাইনে খুঁজে কুল,
স্মরণ-পারের গন্ধ পাঠায় কমলা নেবুর ফুল !
পাহাড়তলীর শালবনায়
বিষের মত নীল ঘনায় !
সাঁঝ প’রেছে ঐ দ্বিতীয়ার-চাঁদ-ইহুদী-দুল !
হায় গো, আমার ভিন্‌ গাঁয়ে আজ পথ হ’য়েছে ভুল !

কোথায় তুমি কোথায় আমি চৈতে দেখা সেই,
কেঁদে ফিরে যায় যে চৈত-তোমার দেখা নেই  !
কন্ঠে কাঁদে একটি স্বর-
কোথায় তুমি বাঁধলে ঘর ?
তেমনি ক’রে জাগছে কি রাত আমার আশাতেই ?
কুড়িয়ে পাওয়া বেলায় খুঁজি হারিয়ে যাওয়া খেই !

পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’,
এই তরীতে হয়ত তোমার প’ড়বে রাঙা পা !
আবার তোমার সুখ-ছোঁওয়ায়
আকুল দোলা লাগবে না’য়,
এক তরীতে যাব মোরা আর-না-হারা গাঁ
পারাপারের ঘাটে প্রিয় রইনু বেঁধে না’।।

 প্রকাশকাল ১৯২২ সাল

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait