আমার কৈফিয়ত (সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ)

আমার কৈফিয়ত (সর্বহারা কাব্যগ্রন্থ)

বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুজে তাই সই সবি !
কেহ বলে, ‘তুমি ভবিষ্যতে যে
ঠাঁই পাবে কবি ভবীর সাথে হে !
যেমন বেরোয় রবির হাতে সে চিরকেলে –বাণী কই, কবি ?’
দুষিছে সবাই, আমি তবু গাই শুধু প্রভাতের ভৈরবী !
কবি বন্ধুরা হতাশ হইয়া মোর লেখা প’ড়ে শ্বাস ফেলে ।
বলে, কেজো ক্রমে হচ্ছে অকেজো পলিটিক্সের পাঁশ ঠেলে ।
পড়েনাক’ বই, ব’য়ে গেছে ওটা ।
কেহ বলে, বৌ-এ গিলিয়াছে গোটা ।
কেহ বলে, মাটি হ’ল হ’য়ে মোটা জেলে ব’সে শুধু তাস খেলে ।
কেহ বলে, তুই জেলে ছিলি ভালো, ফের যেন তুই যা’স জেলে ।
গুরু ক’ন, তুই করেছিস শুরু তলোয়ার দিয়ে দাড়ি চাঁচা ।
প্রতি শনিবারই চিঠিতে প্রেয়সী গালি দেন, ‘তুমি হাঁড়িচাঁচা !’
আমি বলি, ‘প্রিয়ে, হাটে ভাঙি হাঁড়ি-‌’
অমনি বন্ধ চিঠি তাড়াতাড়ি।
সব ছেড়ে দিয়ে করিলাম বিয়ে, হিন্দুরা ক’ন, আড়ি চাচা !
যবন না আমি কাফের ভাবিয়া খুঁজি টিকি দাড়ি, নাড়ি কাছা !
মৌ-লোভী যত মৌলভী আর 'মোল-লারা' ক'ন হাত নেড়ে,
'দেব-দেবী নাম মুখে আনে, সবে দাও পাজিটার জাত মেরে !'
ফতোয়া দিলাম কাফের কাজী ও,
যদিও শহীদ হইতে রাজী ও !
'আম পারা'-পড়া হাম-বড়া মোরা এখনো বেড়াই ভাত মেরে !'
হিন্দুরা ভাবে, 'পার্শী-শব্দে কবিতা লেখে, ও পা'ত-নেড়ে !
আনকোরা যত ননভায়োলেন্ট নন্-কো'র দলও নন্ খুশী ।
'ভায়োলেন্সের ভায়োলিন' নাকি আমি, বিপ্লবী -মন তুষি ।
'এটা অহিংস', বিপ্লবী ভাবে,
'নয় চরকরা গান কেন গা'বে ?'
গোঁড়া-রাম ভাবে নাস্তিক আমি, পাতি-রাম ভাবে কনফুসি !
স্বরাজীরা ভাবে নারাজী, নারাজীরা ভাবে তাহাদের অঙ্কুশি !
নর ভাবে , আমি বড় নারী -ঘেঁষা ! নারী ভাবে, নারী বিদ্বেষী ।
'বিলেত ফেরনী ?' প্রবাসী বন্ধু ক'ন, এই তব বিদ্যে ছি !
ভক্তরা বলে, 'নবযুগ-রবি !'-
যুগের না হই, হুজুগের কবি
বটি তো রে দাদা , আমি মনে ভাবি, আর ক'ষে কষি হৃদ- পেশী,
দু'কানে চশমা আঁটিয়া ঘুমানু, দিব্যি হ'তেছে নিদ্ বেশী !
কি যে লিখি ছাই মাথা ও মুন্ডু, আমিই কি বুঝি তার কিছু ?
হাত উঁচু আর হ'ল না তো ভাই, তাই লিখি ক'রে ঘাড় নীচু !
বন্ধু ! তোমরা দিলেনাক' দান,
রাজ-সরকার রেখেছেন মান !
যাহা কিছু লিখি অমূল্য ব'লে অ-মূল্যে নেন ! আর কিছু
শুনেছ কি, হুঁ হুঁ, ফিরেছে রাজার প্রহরী সদাই কার পিছু ?
বন্ধু ! তুমিতো দেখেছ আমায় আমার মনের মন্দিরে,
হাড় কালি হল, শাসাতে নারিনু তবু পোড়া মন-বন্দীরে !
যতবার বাঁধি ছেঁড়ে সে শিকল,
মেরে মেরে তারে করিল বিকল,
তবু যদি কথা শুনে সে পাগল ! মানিল না রবি-গান্ধীরে !
হঠাৎ জাগিয়া বাঘ খুঁজে ফেরে নিশার আঁধারে বন চিরে !
আমি বলি, ওরে কথা শোন ক্ষ্যাপা, দিব্যি আছিস খোশহালে !
প্রায় 'হাফ' নেতা হয়ে উঠেছিস, এবার এ দাঁও ফসকালে
'ফুল'-নেতা আর হবিনে যে হায় !
বক্তৃতা দিয়া কাঁদিতে সভায়
গুঁড়ায়ে লঙ্কা পকেটেতে বোকা এই বেলা ঢোকা ! সেই তালে
নিস্ তোর ফুটো ঘরটাও ছেয়ে, নয় পস্তাবি শেষকালে ।
বোঝেনাক' সে যে চারণের বেশে ফেরে দেশে দেশে গান গেয়ে
গান শুনে সবে ভাবে, ভাবনা কি ! দিন যাবে এবে পান খেয়ে ।
রবেনাক' ম্যালেরিয়া মহামারী,
স্বরাজ আসিছে চ'ড়ে জুড়ি-গাড়ী,
চাঁদা চাই, তারা ক্ষুধার অন্ন এনে দেয়, কাঁদে ছেলে-মেয়ে ।
মাতা কয়, ওরে চুপ্ হতভাগা, স্বরাজ আসে যে, দেখ্ চেয়ে !
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত , একটু নুন,
বেলা ব'য়ে যায়, খায়নিক' বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন ।
কেঁদে ছুটে আসি পাগলের প্রায়,
স্বরাজের নেশা কোথা ছুটে যায় !
কেঁদে বলি, ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি ? কালি ও চুন
কেন ওঠেনাক' তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন ?
আমরা তো জানি, স্বরাজ আনিতে পোড়া বার্তাকু এনেছি খাস ।
কত শত কোটী ক্ষুধিত শিশুর ক্ষুধা নিঙাড়িয়া কাড়িয়া গ্রাস
এল কোটী টাকা, এল না স্বরাজ !
টাকা দিতে নারে ভুখারি সমাজ ।
মা'র বুক হতে ছেলে কেড়ে খায়, মোরা বলি, বাঘ, খাও হে ঘাস !
হেরিনু, জননী মাগিছে ভিক্ষা ঢেকে রেখে ঘরে ছেলের লাশ !
বন্ধু গো, আর বলিতে পারি না, বড় বিষ-জ্বালা এই বুকে,
দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি, তাই যাহা আসে কই মুখে,
রক্ত ঝরাতে পারি না তো একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত-লেখা,
বড় কথা বড় ভাব আসেনাক' মাথায়, বন্ধু, বড় দুখে !
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছ সুখে !
পরোয়া করি না, বাঁচি বা না-বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে ।
প্রার্থনা ক'রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটী মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ ।  

ADVERTISEMENT

বিজলী' পত্রিকার ১৩৯২-এর 'আশ্বিন' সংখ্যায়

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait