আমাজন প্রাইম অরিজিনাল
অভিনয়: কুলভূষণ খারবান্দা(বাউজি), পঙ্কজ ত্রিপাঠি(কালিন ভাইয়া), দিব্যেন্দু শর্মা (মুন্না), আলি ফজল(গুড্ডু), ভিক্রান্ত মেসি(বাবলু), রসিকা দুগ্গল(বীনা), অঞ্জুম শর্মা(শরদ), শ্বেতা ত্রিপাঠি(গোলু), হর্ষিতা গৌর(ডিম্পি), শ্রিয়া পিলগাওকর(সুইটি), রাজেশ তৈলঙ(রমাকান্ত), শাজি চৌধুরী(মকবুল), অমিত সিয়াল(ইন্সপেক্টর মৌরীয়া), লিলিপুট (দাদ্দা), বিজয় ভর্মা(শত্রুঘ্ন), প্রিয়াংশু পেনুলে(রবিন), দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য(ডক্টর) এবং আরো আরো আরো অনেকে।
নির্দেশক : করণ অংশুমান ও গুরমিত সিং।
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত অনর্গল দুই সিরিজের ১৯ টা পর্ব ধরে অনুভব করার মত সিরিজ হলো মির্জাপুর। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত, প্রথম সিরিজের প্রথম পর্ব থেকে বোঝা যায় যে মির্জাপুরে থাকতে গেলে ছোট থেকে কি কি শুনে ও বুঝে দিনপাত করতে হয়। এ এক এমন অন্ধকার বৃত্ত, যেখানে ঢুকে পড়লে ফেরার পথ শেষ হয় শ্মশানে বা কবরে। এখানে এমন এক জমাট অন্ধকার, যেখানে বুলেটের আলোর ঝলকানিতে বুঝে নিতে হয় পথ কোথায় চলেছে। সম্পর্কের মূল্য চোকাতে গিয়ে গলে পরে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। মধ্যবিত্ত মানুষের উচ্চাকাঙ্খা তাকে নিয়ে চলে এমন এক প্রাসাদে যেখানে প্রত্যেকটি ইঁট গাঁথা হয়েছে হয়ত রক্ত আর মাংস দিয়ে। একটা জীবন, যেকোনো মুহূর্তে শেষ হয়ে যেতে পারে।
ADVERTISEMENT
এখানে মধ্যবিত্ত বাবা রমাকান্ত চান ছেলেমেয়ে গুড্ডু, বাবলু আর ডিম্পি সম্মানের জীবন বাচুঁক, তা হোক না ডাল রুটি খেয়ে, আর মা চান নিত্যনৈমিত্তিক অপমানের জীবন থেকে তাঁর বাহুবলি ছেলে মুক্তি দিক বুলেটের নিশানা সমাজের দিকে তাক করে। এখানে বাহুবলি বাবা অখণ্ডানন্দ ওরফে কালিনের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলে মুন্না বন্দুকের ট্রিগারে গোটা মির্জাপুরকে দাবিয়ে রাখতে চায়, বাবাকে শত্রু ভেবে বিশ্বস্ত বন্ধু সুবোধকে পাঠায় বাবাকে খুন করতে। কালিনের পঙ্গু বৃদ্ধ বাবা ছেলের দ্বিতীয় পক্ষের বৌমার অবৈধ সম্পর্কের কথা জানতে পেরে বৌমাকে শিক্ষা দেয় তাকে ইচ্ছেমত ভোগ করে, আর চাকরের যৌনাঙ্গ ওই বৌমার হাত দিয়েই কেটে ফেলতে বলে, এখানে আই পি এস পুলিশ অফিসার মৌর্যর জেদ ও সততাকে জোর করে ন্যুব্জ করে দেওয়া হয় বন্দুকের নিশানায়, এখানে গ্যাংস্টার এর ছেলে শরদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন স্তব্ধ হয়ে যায় বাবার বুলেটবিদ্ধ মাথার সামনে, এখানে কলেজ টপার গোলু গ্যাংস্টার হয়ে যায় দিদির হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য, এখানে বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেশিনগান হাতে মকবুল, এখানে মুখ্যমন্ত্রীর ভাই নিজের দাদাকে সরিয়ে দিয়ে গদিতে বসতে চায়, আর তার ভাইঝি কাকাকে সরিয়ে দেয়।
এখানে প্রতিশোধপরায়ণতা কে বুদ্ধির সাথে নিয়ন্ত্রণ করে কাজ উদ্ধার করে নেওয়া যায়, এই চরিত্রে রশিকা দুগ্গল কে ভোলা যায় না। এখানে দদ্দা সবরকমের বেআইনি কাজ করেন, কিন্তু নেশার দ্রব্যের লেনদেনে তাঁর বেজায় আপত্তি, তিনি মাদককে ঘৃণা করেন, সেই কাজ তাঁর অনুমতি না নিয়ে করার জন্য তিনি নিজের শ্যালক ও ছোট ছেলেকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতেও দ্বিধা করেন না। এখানে লক্ষ লক্ষ টাকা হাওয়ায় ওড়ে, কিন্তু দশ টাকার পকোড়া খেয়ে দোকানে কাজ করা ছোট্ট ছেলেটাকে সে টাকা না দিয়ে গাল টিপে দিয়ে অনায়াসে বাইকে ধোঁয়া উড়িয়ে চলে আসা যায়। এখানে বাড়িতে ভোজের নিমন্ত্রণ করে বন্ধ ঘরে বন্দুকের গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের, কখনো নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে দেখা যায় নিরীহ সংসারী বাবা মায়ের শরীরের ওপর ছোট মেয়ের ভয়ার্ত কান্না। যা দেখে গ্যাংস্টারের চোখও জলে ভরে আসে। এখানে বেইমানির একমাত্র শাস্তি মৃত্যু।
শরীর এখানে সহজলভ্য, মুখের ভাষা নর্দমার জলের সাথে বয়ে যায়। সরকারি আইনরক্ষক দের বুলেটের হিসেব দিতে হয়, আর রেশমের কারখানায় তৈরি হয় বুলেট, যার কোনো হিসেব লাগে না। বিয়েবাড়ি, জলসা, ডাক্তারখানা, হাসপাতাল, যত্রতত্র শুধু লাশ আর রক্ত। মুহূর্তে বদলে যায় সম্পর্কের সমীকরণ। আর এইসব ঘটনা ঘটতে থাকে জমাট অন্ধকারের জমাট বুননে, বোঝা যায় না কি হতে চলেছে, বোঝা যায় না কেনো এমন হলো। এই হলো মির্জাপুর।
অভিনয়ের কথা কিছু বলার নেই। কাস্ট ডিরেক্টর অভিষেক ব্যানার্জি আবারো প্রমান করলেন, তিনি একইসাথে তাঁর কাজ ও অভিনয়(সুবোধ), দুটোতেই অসামান্য। প্রত্যেকে নিজের চরিত্রের সাথে যেন মিলেমিশে এক। কালিন ভাইয়ার ঠান্ডা চাহনি হিমস্রোত বইয়ে দেয়, গুড্ডুর আত্মসম্মানের তিতিক্ষাকে মুন্না হিংসার চোখে দেখে, বাবলুর বুদ্ধির তারিফ করে বাহুবলি নিজে। নির্দেশকদ্বয় অনবদ্য। ইন্ট্রো তে বোঝা যায় যে সিরিজ কতোটা ভয়ঙ্কর হতে চলেছে।
কোনো কোনো সময় অত্যধিক রক্ত ও খুনখারাপি দেখতে দেখতে গা গুলিয়ে ওঠে। তবু ছাড়া যায় না। প্রথম সিরিজের ৯ টি পর্ব জমজমাট, দ্বিতীয় সিরিজের ১০ টি পর্বের কোনো কোনো জায়গা একটু দীর্ঘায়িত লেগেছে, চরিত্রের প্রয়োজনে কিছু আবেগ মেশানো হয়েছে, এতটা না হলেও চলত। বিশেষত শবনম ও গুড্ডুর সম্পর্কটি মনে হয়েছে জোর করে নিয়ে আসা। দ্বিতীয় সিরিজে যে নতুন চরিত্রগুলি আসে তাদের মধ্যে রবিন আর দদ্দার ছেলে বড়ে ও ছোটের চরিত্রগুলি খুব প্রয়োজনীয়। তবে একটা বড় প্রশ্ন রয়ে গেলো, পুলিশের মেয়ে হয়েও গোলু কেনো বন্দুক চালাতে জানে না? নাকি সেটা চালাতে জানলে দ্বিতীয় সিরিজটা তৈরিই হত না! এই প্রশ্নটা কেনো উঠলো তা দর্শকরা সিরিজদুটি দেখলেই বুঝতে পারবেন।
সিনেমাটোগ্রাফি অসাধারণ। মির্জাপুর অঞ্চলটি পাহাড়ঘেরা। এবড়োখেবড়ো রাস্তা দেখানো হয়েছে। ক্ষমতা আর অর্থের কাছে মাথা নত করার স্বাভাবিক প্রবণতা প্রত্যেকের মধ্যে কমবেশি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা সফল। সংলাপ সংক্ষেপিত কিন্তু গভীর। আলোর বাহুল্য কোথাও নেই। অন্ধকার জগতের প্রতিচ্ছবি সর্বত্র। ইন্ট্রোতে রক্তের দাগ এবং হাড়হিম করা মিউজিক বুঝিয়ে দেয় কি দেখতে চলেছি। মোদ্দা কথা হলো অনেককিছু শেখায় এই সিরিজ।
সিরিজটি দেখুন, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আপনি ১৯ টি পর্ব শেষ করে তবেই অন্য কাজে হাত দেবেন।
Image Courtesy : Amazon Prime
0 comments