দ্য ফ্যামিলি ম্যান ২
আমাজন প্রাইম অরিজিনাল
অভিনয়: মনোজ বাজপেয়ি(শ্রীকান্ত তিওয়ারি), প্রিয়দর্শীনি(সূচি তিওয়ারি), সারিব হাসমি(জে কে), সানি হিন্দুজা(মিলিন্দ), দর্শন কুমার(পাকিস্তানি উগ্রপন্থী), শরদ কেলকার(অরবিন্দ ), সাহাব আলি(পাকিস্তানি উগ্রপন্থী), মহেক ঠাকুর(ধৃতি), ভেদান্ত সিনহা(অথর্ব), সমান্থা রুথ প্রভু(রাজি, তামিল উগ্রপন্থী), আসিফ বসরা(মনোবিদ), সীমা বিশ্বাস (পি.এম) এবং আরো অনেকে।
নির্দেশক: রাজ, ডি.কে.
দ্য ফ্যামিলি ম্যানের প্রথম সিরিজটি মনে অতটা দাগ কাটে নি। ভারতবিদ্বেষী এবং সেনাবিদ্বেষী সংলাপ এবং উগ্রপন্থীদের সমালোচনা না করে সমবেদনা জানানো হয়েছিল সেই সিরিজটিতে (ওয়েবসিরিজ 'তান্ডব' এর পর বোধহয় আমাজন কর্তারা একটু দায়িত্বশীল হয়েছেন সংলাপের প্রতি)। শুধু দাগ কেটেছিল বিভিন্ন অভিনেতার অভিনয়। সেই লোভেই দ্বিতীয় সিরিজটি দেখা। এবং অবিশ্বাস্য রকম থ্রিলিং সিরিজ।
ADVERTISEMENT
শ্রীকান্ত তিওয়ারি একজন আন্ডারকভার এজেন্ট, যিনি আগের মিশন এর ব্যর্থতার পর 'টাস্ক' ছেড়ে দিয়ে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি জয়েন করেন। তাঁর ফ্যামিলি লাইফ খুব একটা সুখের নয়। স্ত্রী অন্য জীবনের প্রতি অনুরক্ত, তাঁর একজন বিশেষ বন্ধু আছেন। শ্রীকান্ত আর সূচির মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হয় যার প্রভাব টিনএজার মেয়ে ধৃতি আর ছেলে অথর্ব এর ওপর পড়ে। এই দুটি ছেলেমেয়ে মারাত্মক রকমের পাকা, বয়সের তুলনায়। মেয়েটি তো বাবামায়ের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাই জানে না। ছেলেটি বাবা মাকে ভালোবাসে, কিন্তু তার বয়সের সরলতা তার মধ্যে নেই। সে তার বাবাকে সর্বক্ষণ 'এটা দাও সেটা দাও, নাহলে এই বলে দেব সেই বলে দেব, তোমার গাড়ি টা পুরোনো মডেলের, ভালো বাড়ি নিতে পারছো না কেনো', এইসব কথা শোনায় আর ব্ল্যাকমেল করে। ভারতবর্ষে এরা ছাড়াও অনেক বাচ্চা আছে যারা দেশের নাম উজ্জ্বল করছে। কিন্তু এদের মধ্যে দিয়ে সামাজিক অবক্ষয় টা খুব ভালো দেখানো হয়েছে যা দেখে অভিভাবকরা সতর্ক হতে পারেন। এদের পর্দায় দেখলে মাথা অত্যাধিক গরম হয়ে যায়, কিন্তু এই ভূমিকা ফুটিয়ে তোলা সহজ কাজ নয়। এই দুই ছোট বয়সের শিল্পীকে প্রথমেই অভিনন্দন।
গল্প এগোয় শ্রীলংকায় বসবাসকারী তামিল জঙ্গিদের সেই দেশে থাকার অধিকার ফিরে পাওয়ার আন্দোলন নিয়ে। তামিল জঙ্গিরা কিভাবে তামিলনাডুর সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থেকে অধিকার ফিরে পাওয়ার নাম করে দেশের ক্ষতি করতে চাইছে সেটাই এই সিরিজের মূল উপজীব্য বিষয়। এখানে দেখানো হয়েছে শ্রীলংকার রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সখ্যতার কারণে জঙ্গিরা তাঁদের মেরে ফেলতে চায়। সেই প্ল্যান কিকরে শ্রীকান্ত এবং তাঁর টিম ব্যর্থ করে দেয়, সেই নিয়েই সিরিজ। বাকিটা জানতে গেলে দেখতে হবে সিরিজটি।
অভিনয়ের ব্যাপারে কিছু বলার নেই। মনোজ বাজপেয়ী অনবদ্য। বাকিরা প্রত্যেকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে নিজেদের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। টাস্ক এ এজেন্ট হিসাবে চাকরি করে, অনবরত উগ্রপন্থীদের প্ল্যান ভেস্তে দিয়ে চলেন শ্রীকান্ত। তার পরেও নিজের হাজার সমস্যায় ঘিরে থাকা পরিবারকে তিনি ঠান্ডা মাথায় সামলান। সেইজন্যই সিরিজটির নাম ফ্যামিলি ম্যান। পুরুষরা একটু তাঁকে দেখে শিখতে পারেন যে কর্মক্ষেত্র এবং পরিবার কিভাবে সামলে চলতে হয়। স্ত্রী অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত হচ্ছেন জেনেও তিনি চেষ্টা করেন ব্যাপারটা সহজ করে নিতে। তাঁর স্ত্রীর বোঝা উচিৎ যে সব সমস্যার সমাধান মনোবিদ করতে পারেন না। অনেক সময় স্বামী স্ত্রী কথা বললেও জলের মত সহজ হয়ে যায় সবকিছু, অনেক সমস্যার সমাধান মিলে যায়। এই মনোবিদের ভূমিকায় আসিফ বসরা আছেন, তাঁকে আমরা আর পাবো না। তিনি এখন পরলোকে। শ্রীকান্ত বুঝতে পারেন ছেলেমেয়ে ভুল রাস্তায় যাচ্ছে, কিন্তু অযথা তাদের শাসন না করে তাদের সাথে কথা বলে ঠিক ভুল বোঝানোর চেষ্টা করেন। এটা খুব দরকার। বজ্র আটুনি অনেক সময় ফস্কা গেড়ো হতে পারে, তিনি সেটা বোঝেন। জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অনবরত লড়ে চলেন শ্রীকান্ত তাঁর টিম নিয়ে, কোনো লাভের আশায় নয়, দেশের সেবা করার জন্য।
দু'জায়গায় মনোজকে অতুলনীয় লেগেছে। প্রথমবার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া চলার সময় স্ত্রী একটি ইংরাজি শব্দ ব্যবহার করেন, শ্রীকান্ত ঝগড়া করতে করতে মোবাইল ডিকশানারিতে তার মানেটা চট করে দেখে নেন। এইসময় তাঁর মুখ চোখের ভঙ্গি অনবদ্য। দ্বিতীয়বার তিনি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সদা বিরক্ত এবং খিটখিটে বস কে কষিয়ে চারটে থাপ্পড় মারেন। সেই বস তাঁর থেকে অনেক ছোট এবং সবসময় জ্ঞান দেন। বলেন, 'শ্রীকান্ত, ডোন্ট বি আ মিনিমাম গাই।' শ্রীকান্ত একদিন সেই বস কে রীতিমত শিক্ষা দিয়ে চাকরি ছাড়েন এবং আবার টাস্ক জয়েন করেন। তিনি বুঝতে পারেন কর্পোরেট জগতের ইঁদুর দৌড় তাঁর জন্য নয়। তিনি টাস্কেই স্বছন্দ। তামিল জঙ্গীদের ভূমিকায় রাজি অনবদ্য। সে কথা বেশি বলে না, চোখ দিয়ে অভিনয় করে যায়। ইন্ট্রো চমৎকার, তামিলনাদুর বিভিন্ন জায়গায় শুটিং হয়েছে। সেখানকার অভিনেতারাও ভীষণ সুন্দর মিশে গেছেন তাঁদের চরিত্রগুলির সাথে। শ্রীকান্ত এর সবসময়ের সঙ্গী জে. কে. র রসিকতাবোধ, একটু বোকা বোকা কথাবার্তা কমিক রিলিফ এনে দেয়। দুঃখ লাগে যখন একজন সিভিলিয়ান কে বাঁচানোর জন্য বা একটা উগ্রপন্থীকে ধরার জন্য কত পুলিশ বা এজেন্ট শহীদ হন।
এই সিরিজের নেতিবাচক দিকগুলি একটু আলোয় আনা যাক। একজন দেশভক্ত এজেন্ট যখন উগ্রপন্থীদের কার্যকলাপ কে 'বিপ্লব' আখ্যা দেন, তখন বোঝাই যায় এই ৱ্যাডিক্যাল সংলাপ তাঁর ঠোঁটে বসানো হয়েছে। বিপ্লবীরা সাধারণ মানুষকে খুন করতেন না, তাঁদের আন্দোলন ছিল পরাধীন দেশকে স্বাধীন করার জন্য। নিজের পাওনা পাওয়ার জন্য তাঁরা কোনোকিছু দাবী করেন নি, অকাতরে দিয়ে গেছেন। যারা বিস্ফোরক ভর্তি উড়োজাহাজ নিয়ে দেশের অগণিত মানুষকে মারতে চায়, তাঁদের সাথে ওই মহান বিপ্লবীদের পার্থক্য এখানেই। ভারতীয় বিপ্লববাদের সাধকদের প্রণাম। তাঁরা সঠিক অর্থে বিপ্লবী। এখানে যাদের দেখানো হয়েছে তারা উগ্রপন্থী। পাকিস্তানি উগ্রপন্থীরা কিভাবে তামিল জঙ্গিদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে উপমহাদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদকে বাড়িয়ে চলেছে, সেই সূত্র আমরা এই সিরিজটি থেকে পাবো। পাকিস্তানি উগ্রপন্থীর ভূমিকায় দর্শন কুমারের তুলনা হয় না, চরিত্রের প্রয়োজনে তিনি নিজের চেহারা বদলে ফেলেছেন।
যখন উগ্রপন্থীদের সাথে লড়াই হয়, কোনো জায়গায় কোনো পুলিশ বা এজেন্টকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট বা মাথায় হেলমেট পড়ে দেখা গেলো না। ধারণা ছিল আই বি এজেন্টরা উগ্রপন্থীদের প্ল্যানের গোপন খবর দেন, আর কম্যান্ডো বাহিনী অপারেশন এ যায়। এখানে দেখা গেলো যাঁরা এজেন্ট তাঁরাই সব অপারেশন এ যাচ্ছেন এবং শহীদ হচ্ছেন। সিক্রেট অপারেশন মুলতুবি রেখে ব্যক্তিগত কাজে ঘরে ফিরছেন। এক মারাত্মক উগ্রপন্থীকে শুট না করে তাকে বাবা বাছা করছেন, নিজেদের বিপদ হতে পারে জেনেও তাকে থানার মত অরক্ষিত জায়গায় রেখেছেন, যেখানে খুব সহজেই অ্যাটাক হতে পারে। পুলিশ অফিসার, যিনি দিনরাত মর্গে যাচ্ছেন তিনি ফর্মালিন এর গন্ধ চেনেন না। সর্বোপরি এতো তামিল সংলাপ যে অনেক কিছুই অধরা রয়ে গেল, যেমন উগ্রপন্থীদের প্ল্যান ইত্যাদি। এতো তামিল সংলাপ কেন? সাবটাইটল থাকলেও তা পড়ার বিশেষ সময় পাওয়া যায় না। এগুলো খুব চোখে লেগেছে। এই বিষয়গুলোয় চোখ রাখলে পরের সিজন অনেক সমৃদ্ধ হবে।
শেষে শ্রীকান্তরা যখন সাহসিকতার জন্য পুরস্কার পাচ্ছেন, তা দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। তাও তাঁর মুখ হাঁড়ি! কেনো, বোঝা গেল না। ইচ্ছাকৃত? হবেও বা। সিক্রেট এজেন্টদের পুরস্কার প্রধানমন্ত্রী দেন, জানা গেলো। যাইহোক প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন তিনি শ্রীকান্তের জন্য কিছু করতে চান, শ্রীকান্ত তাঁর বসকে বলেন ইন্টারেস্ট ফ্রি হোম লোনের ব্যবস্থা তিনি চান। এটা ভালো লেগেছে। যাঁরা নিজেদের প্রাণের তোয়াক্কা না করে দেশকে বাঁচালেন, তাঁদের পুরস্কারের অর্থ থেকেও টি. ডি. এস. কাটা হলো, যা খুবই বেদনাদায়ক।
পরের সিজনটি সম্ভবত কোলকাতা কেন্দ্রিক। এবং কোরোনা ভাইরাসের যোগ থাকলেও থাকতে পারে। ট্রেলারে বোঝা যায় আরো ভালো একটি সিরিজ অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। অপেক্ষায় রইলাম।
ছবি সৌজন্য : ইন্টারনেট
0 comments