“কে জানে কালী কেমন, ষড়দর্শনে পায় না দর্শন”।।
ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে এক ভক্ত প্রশ্ন করছেন, মন্দিরের ওই ছোট্ট মা কালী কি করে জগতের মা হতে পারেন? ঠাকুর বলছেন, সূর্য তো অত ছোট, তাহলে এই বিশ্বচরাচরকে আলো দিচ্ছেন কি করে? ভক্তটি বলছেন, সূর্য আসলে অনেক বড়, দূর থেকে দেখছি বলে অত ছোট লাগছে। ঠাকুরও বলছেন, মাকেও দূর থেকে দেখি বলে অত ছোট লাগে। তাঁকে জানতে হলে তাঁর কাছে আসতে হবে, তাঁকে আপন করে নিতে হবে, তখনই দেখব ওই ছোট্ট কালীমূর্তির ভিতর জগতজননীর মহামহিমময় বিকাশ। আকাশকে দূর থেকে দেখি বলে নীল মনে হয়, যত কাছে যাব দেখব বর্ণহীন। কালীর স্তব করতে গেলে প্রথমেই বলতে হয়,
"প্রসূতে সংসারং জননী ভবতী পালয়তি চ সমস্তং ক্ষিত্যাদি প্রলয়সময়ে সংহরতি চ। সকলমপিস্তং কিং স্তৌমি ভবতীম্"।।
অর্থাৎ, হে জননী, তুমিই এই সংসারকে সৃষ্টি করেছ ও পালন করে চলেছ,আবার প্রলয় কালে তুমিই সংহার মূর্তি ধারণ করে এই সৃষ্টিকে গ্রাস করবে, অজ্ঞ আমি তোমাকে কিভাবে স্তব করব?
ADVERTISEMENT
এই দেবীই হলেন সেই আদ্যা শক্তি জগতজননী। এক রূপে তিনি দেবী মহামায়া, ঘোরকৃষ্ণা, করালবদনী, মুণ্ডমালায় শোভিতা, শ্মশানচারিণী, বিভূতিবিভূষিতা, হুহুঙ্কার শব্দে তিনি জীবের মধ্যেকার আসুরিক প্রবৃত্তিকে বিনষ্ট করে থাকেন। অন্যদিকে তিনিই জীবের অন্তিম সময়ে তার ইহজগতের বন্ধনমুক্তি ঘটিয়ে থাকেন। যাঁর ক্রোধ কে শান্ত করতে স্বয়ং মহাকাল নিজে শব হয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়েন, তিনিই মহাকালী। ভীষণ উগ্ররূপিনী এই মহাদেবী যুগে যুগে কোটি কোটি সাধকের সাধনার ধন। যখন পাপ ও অন্যায় সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন এই মহাদেবী নিজের স্বরূপে আবির্ভূতা হয়ে দুষ্ট অসুরের দমন করেন।
এই দেবী অপর রূপে মহালক্ষ্মী। তিনি ত্রিগুণাতীতা। তিনি এই বিশ্বসৃষ্টির আধার। তাই তাঁকে স্তব করা হয়েছে এইভাবে, “আধারভূতা জগতস্তমেকা, মহীস্বরূপেণ যতহস্থিতাসি।” তিনি নিত্যা। কিন্ত জীবের দুঃখহরণার্থে তিনি বার বার আবির্ভূতা হন। এবারে এলেন দুই রূপে। দক্ষিণেশ্বরে মা ভবতারিনী রূপে। আর তাঁর সন্তান শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস আর শ্রীমা সারদাদেবীর মধ্যে তাঁর নরলীলার প্রকাশে উদ্ভাসিতা হলেন। যুগে যুগে ভিন্ন ভিন্ন রূপে ধর্মসংস্থাপণহেতু তাঁর আবির্ভাব হয়। সেইরকমই দক্ষিণেশ্বর মন্দির কে কেন্দ্র করে এবং ঠাকুরের শরীরকে তাঁর সাধনযন্ত্র করে সনাতন ধর্মকে রক্ষা করার জন্য আবার মৃন্ময়ী মূর্তিতে চিন্ময়ী রূপে প্রকাশিতা হলেন। দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুর কতই না লীলা করলেন। তার মধ্যে কয়েকটি এখানে বর্ণিত হল।
দক্ষিণেশ্বরে মা-কালীর মন্দিরের দরজায় ঠাকুর বসে আছেন। একজন ভদ্রলোক মায়ের মূর্তি দর্শনে প্রীত হয়ে ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হ্যাঁগা, এ মূর্তিটি কি পাথরের, না অষ্টধাতুর, না কাঠের?” ঠাকুর কোনো জবাব দিলেন না। ভদ্রলোক দু-তিন বার জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু কোনো জবাব নেই। ঠাকুর নিঃশব্দে উঠে মন্দিরের ভেতরে গেলেন ও বেদিতে দাঁড়িয়ে মায়ের হাতে হাত বোলাতে লাগলেন। বোলাতে বোলাতে কব্জির কাছে একটু টিপে দেখলেন তাঁর আঙুল মায়ের কোমল অঙ্গে যেন বসে যাচ্ছে। তা-ই দেখিয়ে বললেন, “দেখ দেখি, মায়ের এমন কোমল অঙ্গ, আর ও বলে কিনা মায়ের শরীর হচ্ছে পাষাণ বা ধাতু নির্মিত”। ভদ্রলোকটি দেখে অবাক! – স্বামী অম্বিকানন্দ (প্রাচীন সাধুদের কথা – দ্বিতীয় খণ্ড)।। খানিকটা এই একইরকম দর্শন হয়েছিল রানী রাসমনির জামাতা মথুরবাবুরও। তিনি দেখেছিলেন, রামকৃষ্ণদেবের পূজায় মন্দিরের পাষানী মা দিনদিন চিন্ময়ী হয়ে উঠছেন, রামকৃষ্ণদেবের সাথে কথা বলছেন এমনকি তাঁর নিশ্বাস পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে। কখনো কখনো সেই মাতৃমূর্তি ঘেমে উঠছেন, ঠাকুর তাঁকে বাতাস করে শান্ত করছেন। মথুরবাবু চমকে উঠলেন। বুঝলেন মৃন্ময়ী মা এবার চিন্ময়ী রূপে ধরা দেবেন। মিলেছেন সেই ওস্তাদ জাদুকর (পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ: অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত)। হলও তাই। দক্ষিণেশ্বরের মন্দির এবং বরিষ্ঠ অবতার রামকৃষ্ণদেবের নেতৃত্বে পৃথিবীব্যাপী এক আধ্যাত্মিক প্লাবন বয়ে গেল।
ঠাকুর নিজে বারবার বলেছেন যে তাঁর দেহকে নিয়ে মা কাজ করিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু মহাকাল ও মহাকালীর প্রকাশ তো এক ও অভিন্ন। সে তো অর্ধনারীশ্বর রূপ।তাই এযুগেও তাঁরা দুটি দেহ ধারন করে লীলা করতে এলেন। আমরা ঠাকুরের সাথে পেলাম জননী সারদাদেবীকে। ঠাকুর যদি মাকে চিনিয়ে না দেন আমাদের সাধ্য কি তাঁকে চিনি? তাই ঠাকুর ফলহারিণী কালীপুজোর দিন মাকে ষোড়শী রূপে পূজা করে তাঁকে বিশ্বমাতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে গেলেন। ঠাকুর ভক্তদের উদ্দেশ্যে বলতেন,”মন্দিরের মা ভবতারিনী আর তোদের মা অভেদ”। ওদিকে ঠাকুরের গলরোগের সময় মা এর এক অদ্ভুত দর্শন হল। এক অত্যুজ্বল আলোর মধ্যে এক কৃষ্ণবর্ণ দেবীমূর্তি, যাঁকে দেখতে মন্দিরের ভবতারিনী মায়ের মতই, তিনি ঠাকুরের মতই ঘাড় বেঁকিয়ে বসে আছেন মায়ের পাশে। মা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তাঁর ঘাড়টি ওরকম বেঁকে আছে কেন? সেই দেবীমূর্তি ইশারা করে ঠাকুরের ঘরের দিকে অঙ্গুলিসংকেত করলেন। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিলেন তিনিও যা, ঠাকুরও তাই।
স্বামী ব্রহ্মানন্দ বলতেন, ঠাকুর মাকে ঠিকঠিক চিনতেন,আর স্বামীজী কিছুটা। আর চিনতেন তাঁরা যাঁদের কৃপা করে মা তাঁর নিজরূপে দর্শন দিয়েছেন। যেমন তেলোভেলোর মাঠে সেই ডাকাত ও তার স্ত্রী। যারা মাকে সামান্য স্ত্রী ভেবেছিল। কিন্তু মায়ের মধ্যে তারা তাদের আরাধ্য কালীকেই দর্শন করেছিল আর মায়ের পাদপদ্মে শরণ নিয়েছিল।
একবার স্বামী ব্রহ্মানন্দ এক অদ্ভুত দর্শন করেছিলেন। তিনি তখন স্বামী ব্রহ্মানন্দ হননি। তখন তিনি রাখাল। ঠাকুর তাঁকে একদিন বলেন ঠাকুরের পা দুটি যদি রাখাল একটু টিপে দেন। রাখাল ইতস্তত করছেন। হঠাৎ দেখলেন একটি ছোট্ট চার পাঁচ বছরের কালোবরণ মেয়ে কোথা থেকে ছুটতে ছুটতে এসে ঠাকুরের শরীরে মিলিয়ে গেল। ঠাকুর বুঝিয়ে দিলেন তাঁর মধ্যেই স্বয়ং মা কালী লীলা করছেন। রাখাল নিঃসংশয় হলেন। এরকম বহু দর্শন ঠাকুরের উচ্চকোটির ভক্তদের হয়েছে। সাধক রামপ্রসাদেরও একবার এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তিনি তাঁর জমির চতুর্দিকে বেড়া দিচ্ছিলেন। তাঁকে হাতে দড়ি ধরিয়ে দিয়ে সমানে এক ছোট মেয়ে সাহায্য করে চলেছে। তিনি ভাবছেন তাঁর নিজের কন্যা তাঁকে সাহায্য করছে। পরে জানতে পারলেন যে মেয়ে ওইসময় তাঁর ধারেকাছে ছিল না। বুঝলেন এ কীর্তি মহামায়ার। তাঁর বিশ্বাস দৃঢ় হল। তিনি সাধকে রূপান্তরিত হলেন এবং অজস্র শ্যামাসঙ্গীত রচনা করলেন। এখনও লোকের মুখে মুখে সেসব গান ফেরে। এরকম আরও বহু উদাহরণ আছে।
তবে একথা সত্য যে মহাকালের সাথে যিনি নিত্য লীলা করে চলেন তিনিই মহাকালী। তাঁর মহিমা অপার। বিশ্বাসীদের কাছ থেকেও কাছে আর অবিশ্বাসীদের থেকে বহু দূরে তাঁর স্থিতি। ঠাকুর কালিকাপুরাণের তত্ত্বই সহজ করে বলেছেন। প্রলয়ের দেবতাটির নাম “কাল”। প্রলয়ের পর আবার সৃষ্টি। সৃষ্টির পিছনে আছে বিরাট এক পুরুষের সৃজনেচ্ছা। তিনি ব্রহ্মা। জ্ঞানস্বরূপ প্রভু পরম ব্রহ্ম। ব্রহ্মা একা কিছু করতে পারেন না। মা প্রলয় কালে সৃষ্টির বীজসকল সংগ্রহ করে রাখেন। ইনি হলেন সেই ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃতি। এই প্রকৃতি হলেন মায়া। পরমেশ্বর ইচ্ছার সাহায্যে পুরুষ সৃষ্টি করলেন। প্রকৃতি আর পুরুষ। শুরু হলো মায়ার খেলা। এই মহামায়ার লীলার প্রভাবে জীব মোহরূপ গর্তে , মমতারূপ আবর্তে নিক্ষিপ্ত হয়। এই শক্তি , জগতের সকল জীবকে মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছেন। তিনি অন্ধকার, তিনি আলো। তিনি জ্ঞান , তিনি অজ্ঞান। তিনি বন্ধন , তিনি মুক্তি। তিনি জীবন , তিনিই মৃত্যু। এই আদ্যাশক্তি মহামায়াকে যিনি নিত্য প্রত্যক্ষ করে চলেছেন,তাঁর শ্রীমুখ থেকে কেশবচন্দ্র সেন শুনছেন মায়ের কথা। ঠাকুর বলছেনঃ “একই সত্ত্বা, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় — সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না তখন তাঁকে নির্গুণ ব্রহ্ম বলি। সগুণ অবস্থায় যখন তিনি এই সব কার্য করেন , তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই সত্ত্বা, শুধু নাম-রূপভেদ।”
প্রত্যেকটি নারীর মধ্যেই সেই মহাশক্তির বিকাশ। কারো মধ্যে সুপ্ত, কারো মধ্যে জাগ্রত। স্নেহে-শাসনে, ধৈর্যে-ক্ষমায়, প্রেমে-বিরহে, ত্যাগে-প্রাপ্তিতে সেই নারী কখনো উগ্রা কখনো ভীষণা। কখনো আবার আশ্চর্য রকমের শান্ত। কখনো মাতৃমূর্তিতে আবার কখনো বা করাল রূপে প্রকাশিতা। কিন্তু সেই রূপ অত্যুজ্বল। তাই তো সাধক লিখলেন, ‘কালো মেয়ের পায়ের তলায় দেখে যা আলোর নাচন’। দীপাবলীর এই শুভ মুহূর্তে সেই আলো সমাজের সর্বস্তরে জাগ্রত হয়ে সব অন্ধকার বিনাশ করুক, মহামায়ার কাছে এটুকুই শুধু প্রার্থনা।
0 comments