অহম্ রুদ্রানী

অহম্ রুদ্রানী

“ত্বমস্তজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্বদেহিনাম/ প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তনন্নিবধনা তি ভারত/ অপ্রকাশোহপ্রবিত্তিশ্চ প্রমাদো  মোহ এব চ/ তমস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে কুরুনন্দনম॥”(শ্রীমদ্ভগবতগীতা: অধ্যায় ১৪, শ্লোক ৮ এবং ১৩ )
 অর্থাত, ভগবান শ্রী কৃষ্ণ অর্জুনকে বলছেন, “হে ভারত! তমগুণ অজ্ঞানজাত, এই কারণে ইহা সকল জীবের ভ্রান্তিজনক জানিবে। উহা জীবকে প্রমাদ,আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা আবদ্ধ করে। হে কুরুনন্দন, তমগুণ বৃদ্ধি পাইলে বিবেকভ্রংশ, অনুদ্যম, অনবধানতা ও মোহ—-এই সকল অবস্থা ঘটে!!” 


খবরের কাগজ খুললেই প্রতিনিয়ত ঘটে চলা ধর্ষণের খবরে আজকাল আর খুব একটা অবাক হই না। প্রবল তমগুণজাত এই নৃশংস কর্মটি অজ্ঞান ও অশিক্ষার বাতাবরণ থেকেই উদ্ভূত। খাওয়া-দাওয়া, জাগা, শোয়া ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক কাজের কথা যেমন কেউ ভুলতে পারেন না, তেমনই নিত্যকার এই ধর্ষণের ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা এখনও কতটা অসহায়। যে ২০১৯ সালে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিনিয়ত ধর্ম, ঈশ্বর, উপবাস, সংযম—- ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টায় মগ্ন হই, আমাদের দেশের সুমহান সংস্কৃতিকে পায়ে মাড়িয়ে চলাকেই উপযুক্ত ‘আধুনিক শিক্ষার’ বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করি, প্রতিনিয়ত শিক্ষার জন্য মা সরস্বতী, ধনের জন্য মা লক্ষ্মী আর শক্তির জন্য দেবী দুর্গা বা কালীর শরণাপন্ন হই, এবং পুরুষ নারী নির্বিশেষে সর্বোপরি সেই নারীশক্তিরই  পূজা করে থাকি ঘরে বাইরে, আবার ঘরে ফিরে মা বোন স্ত্রী কন্যার ওপর নির্যাতন করি, কন্যাভ্রূণকে মাতৃগর্ভেই হত্যা করি—-সেই দেশে ঘটবে  একের পর এক জঘন্যতম ও নৃশংস ধর্ষণের ঘটনা,এতে আশ্চর্য কি? আমরা আমাদের কন্যাদের বাঁচাতে পারিনা। প্রতিক্রিয়াহীন আমরা নির্বাক বসে থাকি, ইতিকর্তব্য কি হতে পারে বুঝতে পারিনা। সেখান থেকে আমরা রক্ত গরম করা লেখা লিখতে থাকি, অপরাধীদের নিজেদের মত করে মনে মনে শাস্তি দিতে থাকি, দিনকয়েক খুব মোমবাতি মিছিল করি, দুনিয়া তোলপাড় করে দিই। এরপর একসময় ক্লান্ত হয়ে  চুপ করে যাই। আবার পরবর্তী ঘটনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি।

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


কতগুলো প্রশ্ন স্বাভাবিক ভাবেই মনে ওঠে। এই নারী নির্যাতনের কারণ কি? মনস্তাত্বিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে আমরা নারীরা প্রায় সবাই এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাই। সেই নির্যাতন শারীরিক হতে পারে,হতে পারে মানসিক। এমন কি কোনও মহিলা আছেন যাঁকে বাড়িতে বা কর্মক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় নি ? সেই নির্যাতন হতে পারে পণের জন্য, হতে পারে কর্মক্ষেত্রে দমিয়ে রাখার চেষ্টার জন্য, আবার কখনো হতে পারে পুরুষদের মত সমান গুরুত্ব থেকে বঞ্চিত করার জন্য। একই বাড়িতে দুটি ছেলেমেয়ে। দুজনে কি আজও সমান গুরুত্ব পায় ? আজও রাতে একটা মেয়ে একা বেরোলে অভিভাবকরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন কি? আজও কোনও মেয়ের চেহারা একটু ভারীর দিকে হলে যা ইচ্ছে তাই পোশাক সে পরতে পারে কি নির্দ্বিধায়? আজও কি সমাজ নারীদের স্বাধীন মত মেনে নেয়? না, নেয় না!! নেবেও না। মহিলাদের নিজেদেরকেই সচেতন হতে হবে সমাজে। যাঁরা নারীবাদের বুলি কপচান যত্রতত্র তাঁরা কিন্তু পাশের বাড়িতে কোনও মহিলা নির্যাতিত হতে থাকলে চুপ করেই থাকবেন, পাড়ায় দুর্নাম রটবে নাহলে, ‘মুখরা’ বলবে সবাই, ছি ছি করবে লোকজন। সামাজিক গণমাধ্যম এ সে ঝুঁকি নেই!! সুতরাং সেখানে বিপ্লব করাই যায়। শূন্যগর্ভ আস্ফালন করে লেখক বা লেখিকা হিসাবে গুটিকয় পদলেহনকারীর প্রশংসা কুড়ানোই যায়!! কাজের কাজ কিছু হয় না। স্বামীজীর কথায় বলা যায়, “লেকচার করে এদেশে কিছু হবে না। বাবুভায়ারা শুনবে, ‘বেশ বেশ’ করবে, হাততালি দেবে; তারপর বাড়ী গিয়ে ভাতের সঙ্গে সব হজম করে ফেলবে।পচা পুরানো লোহার উপর হাতুড়ির ঘা মারলে কি হবে? ভেঙে গুঁড়ো হয়ে যাবে; তাকে পুড়িয়ে লাল করতে হবে; তবে হাতুড়ির ঘা মেরে একটা গড়ন করতে পারা যাবে। এদেশে জ্বলন্ত জীবন্ত উদাহরণ না দেখালে কিছুই হবে না।” তাই তো হয়ে চলেছে! একটি মেয়ে জীবন্ত দগ্ধ হয়ে গেল। সে কারো মেয়ে ছিল! কারো স্ত্রী, কারো মা হতে পারত। কি অধিকার আছে একটা মেয়ের সাথে এরকম নৃশংস অমানবিকতার? কলম জ্বলে উঠতে চায়। কিন্তু না। আজ কলম বন্ধ করে আমরা ওই জায়গায় নিজেদের রাখি। দেখব আমাদের শরীর জ্বলে উঠছে। আমরা না হয় এবার ওই জ্বলুনীটাকে সম্বল করে শরীরটাকে প্রতিরোধের উপযুক্ত করে গড়ে তুলি। আতুপুতু ন্যাকা ন্যাকা নায়িকার ইমেজ ভেঙে বেড়িয়ে এসে হয়ে উঠি মা কালী। জানি বলা সহজ। করা শক্ত। কিন্তু চেষ্টা তো করি। বিপদের আশঙ্কা থাকবেই। কেউ বাঁচাতে আসবে না। কোনও নায়ক এসে দশটা গুন্ডাকে কুপোকাত করবে না, ওসব সিনেমায় হয়। সেক্ষেত্রে আমরা নিজেদের উপস্থিত বুদ্ধির ওপর ভরসা করি একটু। যদি কোনও ইট পরে থাকে তা ছুঁড়ে মারি ওই গুন্ডা গুলোকে। বা রাস্তায় ধুলো তো থাকে, একটু ছুঁড়ে দিই না ওদের চোখে মুখে। সাময়িক সুযোগ পেয়ে ছুটতে শুরু করি! সেইমতো শরীরটাকে তৈরী করি। বলতে চাইছি সারাদিন মেকআপের পিছনে নিজেদের সুন্দর দেখাতে চাওয়ার চেষ্টার পিছনে অতটা সময় না দিয়ে একটু শরীর চর্চা করি, এই আর কি। কারণ যাদের জন্য আমরা নিজেদের সুন্দর দেখাতে চাই তাদের হয়ত আমরা সঠিক সময়ে পাশে পাব না।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

আশৈশব পারিবারিক হিংসা দেখে যেসব শিশু বড় হয় তারা কি শিখবে আর ? প্রতিনিয়ত তারা দেখে তাদের বাবারা মদ্যপান করে বাড়ি ফিরে মা কে মারধর করে, নেশার জন্য সর্বস্ব বিকিয়ে দেয়, কখনো কখনো তো সন্তানকেও বেচে দেয়। তারা শিশুর সামনেই তার মাকে হয়ত টেনে নিয়ে যায় শারীরিক সুখের জন্য। এই নেশা যে শুধু পিছিয়ে পরা বর্গের লোকজনই করেন তা নয়, বিষের মত এই বিষের নেশা ঢুকে গেছে এখন আপামর সব বাড়িতেই। গার্হষ্থ হিংসা এখন সর্বত্রই। শ্রমিক শ্রেণী সোচ্চারে  বুক ফুলিয়ে করে, আর তথাকথিত ভদ্র বাড়িতে রাতের অন্ধকারে দাঁত চেপে কলহ অশান্তি হয়। কেউ কি দেখেছে আমাদের মেয়েদের বালিশে জমাট বাঁধা চোখের জলের দাগ? এগুলোও কি নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে না? ভেবে দেখার অনুরোধ রইল। নির্যাতন করা যেতেই পারে মহিলাদের ওপর, কিন্তু তিনি নিজেকে  ‘নির্যাতিতা’ হতে দেবেন কিনা, তা অনেকটা তাঁর ওপরেই নির্ভর করছে। তাঁরা উঠে দাঁড়ান,মানসিক ও শারীরিক ভাবে নিজেদের আরও শক্তিশালী করে তুলুন। একটা কথা বুঝতে হবে, বিপদে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সাহায্য পাওয়ার আশা করাটা কষ্টকল্পনা। কেননা কারো কাছে ভূতের রাজার দেওয়া জুতো নেই যে ফোন পেলে তিনি মুহূর্তের মধ্যে উড়ে চলে আসবেন সাহায্য করতে। দশ থেকে পনের মিনিট সময় যথেষ্ঠ দুর্ঘটনা ঘটার জন্য। সুতরাং সাবধান! 
অনেকে বলছেন ভারতবর্ষ নাকি পিছনের দিকে চলেছে। মনে হয়, না!!! কারন অতীত ভারতবর্ষ ছিল সমৃদ্ধ। নারীকে সম্মান জানানোর উন্নত মানসিকতা ছিল তখন। নারীরা দেশ শাসন করতেন, বিদূষী ছিলেন এমনকি যোদ্ধাও ছিলেন। নিজেদের নিরপত্তার জন্য রাজপুত রমণীরা তাঁদের আঁচলে একটি করে ছুরি লুকিয়ে রাখতেন। নিতান্ত অপারগ হলে জহরব্রত পালন করে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতেন। এসব কথার কথা নয়, যথেষ্ঠ সাহস লাগে। আর কিছু না হোক কেউ গায়ে হাত দিতে এলে ওই ছুরি দিয়ে দুষ্কৃতকারীকে উচিত শিক্ষা দিতেন। আমরা তো নিজেদের আধুনিক বলি! এইটুকু করার মত সাহস কবে হবে আমাদের? প্রকৃত আধুনিকতা শুধু উগ্র সাজ ও মুখের বুলির ওপর নির্ভর করে না, নিজেকে চেনার ওপর নির্ভর করে। মা দুর্গা, যিনি মহাদেবের স্ত্রী এবং দুষ্কৃতকারী কে দমন করার জন্য কখনো কালী, চণ্ডী রূপেও আবির্ভূত হন, শুধু তাঁদের পূজা না করে তাঁদের দেবীত্ব কে নিজেদের মধ্যে মহিলারা জাগিয়ে তুলুন। আর মায়েরা ছেলেমেয়ে নির্বিশেষে সন্তানকে একটু ধর্মশিক্ষা দিন। মনে করুন স্বামীজীর সেই মহান বাণী,”ধর্ম হল মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বের প্রকাশ!” বিশ্বাস করুন,পরবর্তী প্রজন্ম শিক্ষিত হওয়ার সাথে সাথে বিপথে যাওয়ার থেকেও দূরে থাকবে। এক সুস্থ সমাজের স্বপ্ন তখনই বাস্তবে রূপায়িত হবে।।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait