স্বামী বিবেকানন্দ : এক অনন্ত জীবন

স্বামী বিবেকানন্দ : এক অনন্ত জীবন

 

১৮৬৩ সালের পৌষ মাসের সংক্রান্তি তিথির দিন ভোরবেলা ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব (Ramakrishna Paramahansa) বসে আছেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির চাতালে। হঠাৎ দেখলেন, বারাণসীর দিকের আকাশ থেকে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক তীব্র গতিতে কলকাতার দিকে পতিত হল। ঠাকুর হাসলেন! বুঝলেন, তিনি এসেছেন। জীবের ত্রাণহেতু, কৈলাশপতি দেবাদিদেব মহাদেব আরো একবার দেহ ধারণ করে জন্ম নিলেন কলকাতার কোনো এক স্থানে।

১২ই জানুয়ারী। মা ভুবনেশ্বরী আর বাবা বিশ্বনাথ দত্তের কোল আলো করে ভূমিষ্ঠ হলেন নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ভাবীকালের "ঘনীভূত ভারত" হয়ে ওঠার পথে প্রথম ধাপটি সম্পন্ন হল সেকালের বনেদিয়ানা এবং সুশিক্ষার মেলবন্ধনস্বরূপ বিখ্যাত দত্ত পরিবারে, যে পরিবারে নরেন্দ্রের পিতামহ নাকি জীবের মুক্তির আলো খোঁজার জন্য সন্ন্যাসী হয়েছেন অনেক আগেই। পিতা বিখ্যাত উকিল, কিন্তু সুরসাধনায় তৎকালীন কলকাতার এক বিদগ্ধ পুরুষ। মাতা, ইংরেজ রমণীর কাছে ইংরেজি শিক্ষা পেয়েছেন, কিন্তু সকাল সন্ধে তাঁর আদরের 'বিলে'কে রামায়ণ বা মহাভারতের জ্ঞান দিতে ভোলেন না। গীতায় শ্রী ভগবান বলছেন, "যোগভ্রষ্ট আত্মা উচ্চ বংশ খুঁজে নিয়ে জন্মায়। পরে সব মনে পড়ে গেলে বন্ধন মুক্তির পথে পাড়ি দেয়।" নরেন্দ্রের সাথেও যে এরকমটাই হয়েছে, তা তো ঠাকুর পরবর্তীতে সর্বসমক্ষে বলবেন। উচ্চ বংশ, পরিবারে এতটুকু অভাব নেই, পিতৃদেব অজস্র টাকা রোজগার করেন, বাড়ির চতুর্দিকে মূল্যবান আসবাবপত্র, মায়ের দামী দামী শাড়ি বিলে অকাতরে বিলিয়ে দেন গরীব ভিখারীদের মধ্যে, অসম্ভব মেধাবী নরেন্দ্র এক দৃষ্টিপাতে পড়ে ফেলেন একটি গোটা বই --সেই বংশে এক রাতের মধ্যে নেমে এল অভাবের কালো অন্ধকার। বিশ্বনাথ দত্ত হঠাৎ দেহরক্ষা করলেন। অভাবের জমাট কালো গ্রাসে নরেন্দ্রের ঘুম উড়লো।

ADVERTISEMENT

 

প্রখর যুক্তিবাদী, সেকালের বি এ পাশ নরেন্দ্র গোটা কলকাতা শহরে একটাও চাকরি খুঁজে পেলেন না যাতে করে পরিবারের ভরণপোষণ করতে পারেন। ছোট ছোট ভাইবোন খেতে পাচ্ছে না ভালো করে, মায়ের পরণের শাড়ি ছেঁড়া, নরেন্দ্র অসহায়। যদিও এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই ঠাকুরের কাছে শুরু হয়েছে তাঁর যাতায়াত। ঠাকুর অন্তর্যামী, নরেন্দ্র মুখ ফুটে কিছু না বললে কি হবে, তিনি ঠিকই বুঝেছেন নরেন্দ্র কি অবস্থায় আছেন। নরেন্দ্র যে ভাবীকালের যুগপুরুষ! তাঁর সংসারের দায়িত্ব যেন ঠাকুর নিলেন। নরেন্দ্রের অনুপস্থিতিতে, এক শিষ্যকে দিয়ে তাঁর মায়ের কাছে এক গরদের শাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। নরেন্দ্র সেকথা জানা মাত্র ঠাকুরের কাছে এসে বললেন, "আমি তো আপনাকে বলিনি যে আমার মায়ের শাড়ি নেই। আপনি এ কথা জানলেন কিকরে?"

 

ঠাকুর হাসলেন! নরেন্দ্র তখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না যে সাক্ষাৎ মা কালী ঠাকুরের সাথে সন্তানস্নেহে কথা বলেন। ঠাকুর সেই রাতে নরেন্দ্রকে মায়ের কাছে কিছু চাইতে পাঠালেন। তারপরেই ঘটলো সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। ঠাকুর বললেন, "লরেন, আজকের রাতে মা ফেরাবেন নি। যা পারিস চেয়ে নিস। মাকে বলিস, মা যেন তোর অভাব দুর্দশা সব ঘুচিয়ে দেয়।'' মন্ত্রমুগ্ধ নরেন্দ্র একবার নয়, দুইবার নয়, তিন তিনবার মায়ের কাছে গিয়ে চেয়ে বসলেন, "মা, আমার জ্ঞান দে, বিবেক দে, বৈরাগ্য দে।" মায়ের অপরূপা মাতৃমূর্তির মধ্যে তিনি কি ঠাকুরকেই প্রত্যক্ষ করলেন? কে জানে? ফিরে এসে হতাশভাবে ঠাকুরের পদপ্রান্তে বসে বললেন, "পারলাম না ঠাকুর। মায়ের কাছে নিজের সুখ, নিজের চাকরি, অর্থ কিছুই চাইতে পারলাম না।" ঠাকুর তো জানেন তাঁর নরেন কে! কিজন্য তাঁর পৃথিবীতে আগমন! তাঁর প্রাণপ্ৰিয় নরেনকে কাছে টেনে বর দিলেন, বললেন, "যা! আজ থেকে তোর পরিবারে মোটা ভাত কাপড়ের অভাব হবে নি!"

 

নরেন্দ্র ঠাকুরের কাছে নির্বিকল্প সমাধি চাইলেন। ঠাকুর বললেন, "ছি লরেন ছি! কোথায় ভাবলাম তু্ই বটগাছ হয়ে সবাইকে ছায়া দিবি! আর সেই তু্ই কিনা নিজের মুক্তি চাইছিস? তবে দাঁড়া। সে ঘর থেকে তোকে একবার ঘুরিয়ে আনি।" শিবরাত্রির মহারাত্রি। নরেনকে ঠাকুর ডাকলেন নিজের ঘরে। আলতো একটু স্পর্শ। নরেন বাহ্যিক জ্ঞান হারালেন। কেটে গেল কত মুহুর্ত! শরৎ, শশী, লাটু, বুড়ো গোপাল দাদারা ভাবছেন, নরেন বোধহয় আর নেই! সেই মুহূর্তে ঠাকুরের স্পর্শে নরেন চোখ মেলে চাইলেন। ঠাকুর বললেন, "কেমন ঘুরলি? তবে এ ঘরের চাবিকাঠি তোর হাতে নয়, এর (নিজেকে দেখিয়ে) হাতে রইল। সময় যেদিন আসবে, সেইদিন এই ঘরের চাবি আবার এ খুলে দেবে।"
 

ঠাকুরের শরীর যাওয়ার পর, নরেন তাঁর ১৫ জন গুরুভ্রাতার সাথে একসাথে নিলেন সন্ন্যাস। সবার নতুন নামকরণ হল। স্বামী বিবিদিষানন্দ নাম গ্রহণ করে, ঠাকুর ও শ্রী মায়ের অনুমতিক্রমে নরেন এবার চললেন আমেরিকা মহাদেশ। সেখানে চিকাগো মহাধর্ম সম্মেলনে হিন্দুধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে ফিরলেন দেশে। তাঁর শ্রীমুখ দিয়ে ঠাকুরই যেন বলিয়ে নিলেন সেই মহাবাণী, "বিবাদ নয়, সহায়তা। বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ। মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।"
 

দেশে ফিরলেন স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda)। ভারতবর্ষের বিবেক জাগ্রত করে, ভারতবর্ষের মূল ধরে নাড়িয়ে তিনি যেন স্বয়ং ভারতবর্ষ হয়ে ফিরলেন। সাথে নিয়ে ফিরলেন জন্মসূত্রে আইরিশ কন্যা, ভারতদুহিতা ভগিনী নিবেদিতাকে। কলেজের ছেলেরা স্বামীজীর রথের ঘোড়া খুলে দিয়ে নিজেরা সে রথ টেনে নিয়ে চলল। ভগিনীর কথায়, ভারতবর্ষকে ভালবেসে তিনি যেন নিজেই হয়ে উঠেছিলেন মূর্তিমান ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের দুঃখে এত দুঃখিত কেউ হয়নি, দেশের গৌরবে তাঁর মত গৌরব কেউ অনুভব করেনি, আবার ভারতবর্ষের দুর্দিনে তাঁর মত বিবেকের চাবুক কেউ হাতে তুলে নেয়নি।
 

তবুও, অভাগা এই দেশে যথোচিত সম্মান তিনি পান নি। আমেরিকা থেকে যখন ফিরলেন, তখন তাঁকে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সমাজের মাথারা তাঁকে নিয়ে কদর্য ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করে গেছেন আজীবন। যে মানুষ বিশ্ব কাঁপিয়ে ঘরে এলেন, বড় বড় জনসভায় ইচ্ছাকৃতভাবে তাঁকে আমন্ত্রিত করা হত না। যে মানুষটি দেশের সেবায় সর্বস্ব বিলিয়ে দিলেন, সে মানুষটিকে তাঁর দেশের মানুষই নিরন্তর ভুল বুঝেছে, দেয়নি যথোচিত সম্মান। দীন দরিদ্র অসহায় আতুরের একমাত্র আশ্রয়, জননী সারদাদেবী নিরন্তর তাঁর নরেনকে সাহস জুগিয়েছেন। সেই সাহসের তরীতে ভর করেই স্বামীজী বেলুড়ে ঠাকুরের পূত চিতাভস্মের ওপর স্থাপন করেছেন রামকৃষ্ণ আশ্রম, যা বেলুড় মঠ হিসাবে গোটা পৃথিবীর ভক্তজনকে একত্রিত করেছে এক ছাতার তলায়, ঠাকুর যেরকমটি চাইতেন।
 

তবুও ডাক এল। ঠাকুর বোধহয় স্বহস্তে সেই অখন্ডের ঘরের চাবি খুলে দিলেন তাঁর প্ৰিয় লরেনের জন্য, যা একদা তিনি নিজেই লুকিয়ে রেখেছিলেন। সেদিন, ১৯০২ সালের ৪ ঠা জুলাই। স্বামীজী জানতেন, ডাক আসবে। তিনি নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করছিলেন। সেইদিন শিষ্যদের নানা উপদেশ দিয়ে, তাঁদের নিজের হাতে খাবার পরিবেশন করে, তাঁর অনুপস্থিতিতে কিভাবে মঠ চলবে এইরকম বহু উপদেশ দিলেন। স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ প্রমুখ গুরুভাইয়েরা, ভগিনী নিজেও স্বয়ং বুঝতে পারছিলেন যে কিছু একটা ঘটতে চলেছে।
 

সেইরাতে, স্বামীজী গভীর সমাধিতে মগ্ন হলেন। বিছানায় শুয়ে একটু ডুকরে কেঁদে উঠলেন কি? যে জন্মভূমির দুর্দশা ঘোচানোর জন্য তিনি লাখবার জন্ম নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন, সেই দেশকে মাত্র উনচল্লিশ বছর আয়ুপর্বে ছেড়ে চলে যাওয়ার দুঃখ হয়তো তাঁর হৃদয়কে বিদীর্ণ করে দিচ্ছিল। কিন্তু উপায় নেই, ঠাকুরের নির্দেশ যে তাঁর লরেনকে মানতেই হবে। তিনিই তো বলেছিলেন, "ভাল বাসতে জানেন একমাত্র ঠাকুর আর মা। বাকি সবাই ভান করে।" এ যে কতবড় মহা উপলব্ধি, এ শুধু যাঁরা ঠাকুর ও মাকে পায়, তারাই জানে।
 

স্বামীজীর দেহ চলে গেছে, কিন্তু তিনি মিশে রয়েছেন এই ভারতের প্রতি ধূলিকণায়। যেমন আমেরিকা মহাদেশ থেকে ফিরে দেশের ধূলিকণা মুঠি ভরে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, "ভারতবর্ষের প্রতিটি ধূলিকণা আমার কাছে মহাপবিত্র।"
 

গৈরিক সন্ন্যাসীর পদপ্রান্তে, তাঁর পুণ্যতিথিতে কোটি কোটি প্রণিপাত। আপনি আছেন, থাকবেন সর্বদা। ঘনীভূত ভারত! প্রণাম!
 

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait