মুভি রিভিউ : গুমনামী

মুভি রিভিউ : গুমনামী

অভিনয়ে: অনির্বাণ, প্রসেনজিৎ; নির্দেশনা : সৃজিত মুখোপাধ্যায়

নেতাজী! নামটাই যথেষ্ঠ শিরায় শিরায় কাঁপুনি ধরানোর জন্য। তো এই পুজোয় তিনি আবার এলেন। তাঁর সংগ্রাম,তাঁর আত্মত্যাগ এ ছবির বিষয় নয়। 1945 সালে সায়গণ-এ বিমান দুর্ঘটনার পর তাঁর কি হল সেটাই এ ছবির মুখ্য আলোচ্য বিষয়। বিষয়বস্ত জটিল ও বিতর্কিত। মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। প্রথমত, তিনি সায়গণ বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। সেটি ছিল নেতাজীরই পরিকল্পনা যাতে পৃথিবীর সামনে তিনি মৃত বলে প্রমাণিত হন এবং তাঁর পরবর্তী সংগ্রামের লক্ষে ঝাঁপ দিতে পারেন। তাঁর বিশ্বস্ত সহকারী কর্নেল হবিবুর রেহমান এই কাজে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন এবং এই দুর্ঘটনাকে সত্যি প্রমাণ করার জন্য নিজের শরীরের কিছু অংশ অ্যাসিড দিয়ে পুড়িয়ে নেন!!! নেতাজী আত্মগোপন করেন। এতে তাঁর ওপর থেকে বৃটিশদের নজরদারি একেবারেই বিলীন হয়।

ADVERTISEMENT
Tuhu Momo Video Teaser

দ্বিতীয়ত, সাইবেরিয়ার কোনও নাম না জানা জেল এ তাঁর মৃত্য হয় নি। তৃতীয়ত, তিনি সন্ন্যাস নিয়ে ভারতে ফিরে এসেছিলেন এবং তাঁর বিশ্বস্ত কয়েকজন তাঁকে স্বাধীন ভারতে লুকিয়ে রাখেন এবং তিনি নানা জনহিতকর কাজে নিজেকে মগ্ন করে দেন। তাঁর বিশ্বস্ত চেনা মানুষদের সাথে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁর যোগাযোগ ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ঘর থেকে এমন অনেক জিনিস উদ্ধার করা হয় যা তিনি ছাড়া আর কেউ রাখতে পারতেন না। তাঁকে যাঁরা চিনতেন তাঁরা মেনে নিয়েছেন তিনিই নেতাজী। চন্দ্রচূড় ঘোষ ও অনুজ ধর এর লেখা বিখ্যাত গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘কনান্ড্রাম’ কে অনুসরণ করে এই মুভি সৃষ্ট।

বিতর্কে যাচ্ছি না। নেতাজী গবেষক আমি নই। এতদিন যা পড়াশোনা নেতাজীকে নিয়ে করেছি তাতে মনে হয় প্রথম তত্ত্বটি সত্য। দ্বিতীয় তত্ত্বটি ধোঁয়াশাতে ঢাকা। নেতাজী ধরা পড়বেন এবং সাইবেরিয়াতে তাঁকে জেলে ধরে রাখা হবে, এ কিরকম কথা? কেননা যে মানুষটা বৃটিশ সরকারের ত্রাস ছিলেন,যাঁর সাথে হিটলার পর্যন্ত সসম্ভ্রম ব্যাবহার করতেন, গোটা বিশ্ব যিনি এপার ওপার করে ফেললেন কেউ তাঁকে ধরতে পারল না, যিনি আই এন এ র সর্বাধিনায়ক হিসাবে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে দুটি দ্বীপ কে স্বাধীন করলেন তাঁকে কব্জা করা কি এতই সহজ? কি জানি?

এবার পড়ে রইল তৃতীয় তত্ত্ব। সৃজিত এই মুভিতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে স্বাধীনোত্তর ভারতে তিনি সন্ন্যাস নিয়ে ফিরে এসেছিলেন (সম্ভাবনা আছে, কারণ ছাত্রাবস্থায় তিনি বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়ে সন্ন্যাস নিতে গিয়েছিলেন। ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দ তাঁকে সন্ন্যাস নিতে বারণ করেন)। তো এই মুভিতে আমরা দেখছি চন্দ্রচূড় বাবু একজন সাংবাদিক। তিনি মুখার্জী কমিশন (নেতাজী অন্তর্ধান রহস্য সম্পর্কিত শেষতম কমিশন) এর সামনে তাঁর গবেষণার প্রমাণ নিয়ে ও তাঁর টিম কে নিয়ে হাজির হন। এই গবেষণার জন্য তাঁর সাংসারিক জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তাঁর স্ত্রী তাঁকে ছেড়ে চলে যান, এমনকি তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে দিনরাত গবেষণায় মগ্ন থাকেন। মূলত তাঁর দেওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কমিশন রায় দেন যে সায়গণ এ কোনও বিমান দুর্ঘটনা হয় নি।

এই ভূমিকায় অনির্বাণ অনবদ্য। কিছু বলার নেই৷ প্রসেনজিৎ গুমনামী বাবা কে সুন্দর ফুটিয়েছেন। মূলত অনির্বাণের একক অভিনয় এই মুভিতে। বাকিটা থিয়েটার এ গিয়ে দেখতে হবে।

সিনেমাটোগ্রাফি ভাল। নেতাজীর সময়টা সাদা কালোয় ধরা হয়েছে। ছোট ছোট ভূমিকায় প্রত্যেকে অনবদ্য। কিন্তু কোর্টরূম এ যুক্তি বিশ্লেষণ এর সময় অনির্বাণের চরিত্রটি অভিনয় বেশ কয়েকবার অতিনাটকীয় হয়ে গেছে। শুধু ওটুকুই। তাঁর চোখা যুক্তিবানে কমিশন পর্যুদস্ত। ছবিটি তাঁর জন্যই দেখুন। সোনু নিগমের কণ্ঠে ‘সুভাষজী’ গানটি খুব সুন্দর। তবে বাবুল সুপ্রিয়র কণ্ঠে ‘শুভ সুখ চেয়ন’ গানটি শুনে গায়ে কাঁটা দেয় এবং চোখে জল আসবেই। নেতাজীকে ভেবে।

যে মানুষটা আই সি এস এ চতুর্থ স্থান অধিকার করেও বৃটিশদের চাকরি করেন নি তাঁর কথা ভেবে। যে মানুষটা দেশের জন্য সমস্ত দিলেন তাঁর কথা ভেবে। যে মানুষটা বলেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ বেঁচে থাকলে তিনি ভৃত্যবত্ স্বামীজীর কাছে পড়ে থাকতেন, তিনি তো আসলে একজন সন্ন্যাসীই। স্বীকৃতি নাই বা পেলেন, তিনি কোটি কোটি মানুষের হৃদয়ে রাজা হয়ে বসে আছেন, তাঁর কথা ভেবে চোখে জল আসবেই। থাকুন তিনি রহস্যের আড়ালে। পরবর্তী প্রজন্মও আমাদেরই মত জানুক,তাঁর জন্ম হয়েছিল,মৃত্যু হয় নি। তিনি অমর, তিনি মৃত্যুঞ্জয়!

সৃজিত,কুর্নিশ!! আপনার সাহসের জন্য!

জয়তু নেতাজী!!!(1897—????)

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait