স্তম্ভ ৬৩৮ : একদল ভারতীয় সেনার বীরত্বের কাহিনী

স্তম্ভ ৬৩৮ : একদল ভারতীয় সেনার বীরত্বের কাহিনী

         /""
       /  6   
     /    3   
   /      8       
 /____    ____ স্তম্ভ ৬৩৮
 
     আজ ১৫ই আগস্ট, ভারতের তথাকথিত ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস। তবুও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, ভারতের ইতিহাসে এই দিনটির যথেষ্টই গুরুত্ব রয়েছে। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে শাসনের এই হস্তান্তর কে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে মানিনা। আমি ২১শে অক্টোবর ১৯৪৩ কেই স্বাধীনতা দিবস হিসেবে মান্য করি। তবুও সাধারণ দেশবাসী হিসেবে কোনোদিনও এই দিনটিকে যথার্থ মর্যাদায় পালন করার ক্ষেত্রে কার্পণ্য করিনি। তাই ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ দিনটি উপলক্ষে আমি সকল দেশবাসীকে জানাই আমার আন্তরিক প্রীতি, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ১৯৪৭ এর পূর্বে যেরূপ আমাদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম করতে হয়েছে, তার উত্তর যুগেও আমাদের সেনাবাহিনীকে বারংবার সংঘর্ষে লিপ্ত হতে হয়েছে (১৯৪৮, ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১ ও ১৯৯৯ এর যুদ্ধই তার প্রমাণ)। আজ তারই এক অধ্যায় আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেবো। শোনাব দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে দেশের শ্রেষ্ট সন্তানদের বীরত্বের এক আমার গাঁথা।
 
     ১৯৭১ সাল পাকিস্তানের সঙ্গে ভারত- বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান) আর তার বাঙালি জাতীর রক্ষার্থে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে (1971 Indo-Pak War) জড়িয়ে পরে। মাত্র ১৪ দিনের এই যুদ্ধে পাকিস্তান প্রায় ৯৩ হাজার সেনা সহ আত্মসমর্পণ করে পরাজয় স্বীকার করে নেয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশ জড়িত ছিলো বলে যে এই যুদ্ধ শুধু বাংলার অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিলো তা ভাবলে ভুল হবে। আমেরিকা - রাশিয়ার মতো বিশ্বের দুটি সর্ববৃহৎ শক্তি ভারত মহাসাগরে প্রায় এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছিলো। সমগ্র পথিবীর মানুষ পূর্বের বিশ্বযুদ্ধের ন্যায় আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো। আজ সেই যুদ্ধেরই একটি ছোট্ট অথচ অতিগুরুত্বপূর্ণ অংশ আপনাদের কে শোনাবো। জানাবো আপনাদের The Battle of Langewala (4th December to 7th December, a part of 1971 Indo-Pak War) তে একদল ভারতীয় সেনার বীরত্বের কাহিনী।
 
     আপনারা হয়তো ভাবছেন The Battle of Langewala, মানে নিশ্চয়ই ১৯৯৭ সালের জে.পি.দাত্ত পরিচালিত বলিউড চলচিত্র বর্ডার এর কথা বলছি। ঠিক তাই, একবারেই ঠিক ধরেছেন। কিন্তু আজ আমি আপনাদের বলবো চলচিত্রের অতিরঞ্জিকতার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য ইতিহাস। ১৯৭১ এর ৪ঠা ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানের দুটি ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, ৪৫এর ওপর ট্যাঙ্ক, বহু সাজোয়া গাড়ি, আর ২০০০ সেনা নিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে। রাজস্থানের রামগড়ের কাছে ৬৩৮ নম্বর সীমান্ত স্তম্ভ পেরিয়ে লঙ্গেওয়ালা তে ৫ই ডিসেম্বর রাত ১২:৩০ নাগাদ আক্রমণ করে। পোষ্টে তখন ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট আর কয়েকজন বিএসএফ এর সেনা। মেজর কুলদীপ সিং চাঁদপুরী - সঙ্গী সেকেণ্ড লেফটেন্যান্ট ধরমবীর ভান সিং, বিএসএফ ক্যাপ্টেন ভ্যাইরো সিং সহ মাত্র ১২০ জন সেনা থাকায়, হেড কোয়াটারে তার অসহায়তার কথা জানান। যত দ্রুত সম্ভব জয়সালমির এর বিমান ঘাঁটির কাছে সহায়াতার আবেদন করেন। কিন্তু বিমানঘাঁটিতে রাতে উড়তে অক্ষম হকার-হান্টার বিমান থাকায় উইং কমান্ডার এম.এস. ভাবা তাকে ভোরের জন্য অপেক্ষা করতে বলেন। হেডকোয়াটার থেকে বলা হয় কোম্পানি নিয়ে যেনো মেজর চাঁদপুরী পিছিয়ে আসেন। কিন্তু মেজর কুলদীপ সিং চাঁদপুরী আর তার সেনারা সেদিন মাত্র ১টি জিপে লাগানো ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী তোপ (ReCoilLess or RCL Gun), কিছু ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন, কিছু মটার, কিছু মেশিনগান আর অদম্য সাহস ও বুদ্ধি কে সঙ্গী করে শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান।
 
     সেইদিন সেই বীরেরা যদি পিছিয়ে যেত তো আজ ভারতের মানচিত্র অন্যরকম হতো। বর্ডার চলচিত্রে সেই বিখ্যাত সংলাপ (পাকিস্তানের উদেশ্য) সত্যি হয়ে যেতো - 
"শুভাকা নাস্তা জয়সালমির মে কারেঙ্গে, দোব্যাহের কা খানা যোদপুর মে কারেঙ্গে, অউর রাতকা দিল্লী মে"।
 -দু কিলোমিটার ধরে বানানো পরিখা থেকে ভারতীয় বাহিনী হামলা করতে থাকে। আর ভিন্ন ভিন্ন স্থান হতে চিৎকার করে বলতে থাকে -
"যো বোলে সো হিনাল... সত শ্রী আকাল... ওয়াহেগুরু জী কা খালসা, ওয়াহেগুরু জী কি ফাত্যেয়"। 
-ফলে পাকিস্তানের সেনারা বুঝতেই পারেনি মাত্র ১২০ জন ভারতীয় সেনা রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। মেজর কুলদীপ সিং বুঝে ছিলেন স্বল্প অস্ত্র সঙ্গে থাকায়, বুদ্ধিই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়। তার আদেশে পূর্বেই ভারতীয় সেনারা কয়েকটি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন এর সঙ্গে নিজেদের টিফিনকারী বালি ভরে নকল মাইন হিসেবে চারিদিকে বিছিয়ে রেখেছিলো। শত্রুর আগমনের রাস্তায় আসল বিস্ফোরক গুলি রাখায় শুরুতেই পাকিস্তানের দুটি ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা হটাৎ একটি ধাতব তার দেখে স্তম্ভিত হয়ে ভেবে নেয় বালির নিচে মাইন বিছানো রয়েছে। কিন্তু বালি ভর্তি টিফিনকারী যে আদতে মাইন নয়, আর সেখানে কোনো মাইন ক্ষেত্র নেই তা বুঝতেই তারা গুরুত্বপূর্ণ দুই ঘণ্টা দেরি করে ফেলে। এদিকে এই চূড়ান্ত বিলম্বের সুযোগ নিয়ে মেজর চাঁদপুরীর নির্দেশে ভারতীয় সেনারা মটার দিয়ে পাকিস্তানি সেনার ওপর ক্রমাগত আক্রমন করতে থাকে। তিনি সর্বক্ষণ আর্টিলারি বিভাগ কে নির্দেশনা দিয়ে শত্রু পক্ষের গতি রুদ্ধ করতে থাকেন।
 
সম্পর্কিত ভিডিওটি দেখতে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন।
 
 
     একদিন পূর্বে পূর্ণিমা হওয়ায় চাঁদ যুক্ত উজ্জ্বল রাতে খোলা মরু প্রান্তরে পাকিস্তানের সেনারা এরূপ আক্রমনে হতভম্ব হয়ে যায়। লোকানোর স্থান না পেয়ে রাত কাটতে না কাটতেই পাকিস্তানের ১২ টি ট্যাঙ্ক, মাইন আর RCL তোপ এর আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। পাকিস্তানের বহু সেনা হতাহত হয়। ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই শুরু হয় উইং কমান্ডার এম.এস. ভাবার নেতৃত্বে চার হান্টার বিমানের তাণ্ডব। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত এই তাণ্ডবে আরো ২২ টি ট্যাঙ্ক সহ ১০০ এর উপর সজোয়া গাড়ি ধ্বংস হয়। পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। ৭ই ডিসেম্বর সেনা ও সরকার লঙ্গেওয়ালাতে এই যুদ্ধের বিজয় ঘোষণা করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আর কোনো যুদ্ধে এক পক্ষের এত ট্যাঙ্ক এতো কম সময়ের মধ্যে ধ্বংস হয়নি। ভারতীয় বিমানের থেকে বাঁচতে পাকিস্তানের ট্যাঙ্ক দল বালির ধুলোর আড়ালে নিজেদের লুকিয়ে ফেলার জন্যে, ভয়ে এদিক ওদিক ছুটে ধুলোর ধোয়া বানাতে থাকে। পরবর্তীতে উপগ্রহের ছবিতে বিমান বাহিনীর এই প্রলয় দৃশ্য, পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক বাহিনীর বালির ওপর পালায়ানের রেখাচিত্রে প্রকাশ পায়। সেখানের ওয়ার মেমোরিয়াল, মিউজিয়াম গুলিতে সেই ট্যাঙ্ক আর গাড়ির কিছু প্রমাণ বিজয় সৌধ রূপে আজও রক্ষিত রয়েছে। এরপর ভারতীয় ট্যাঙ্ক বাহিনী ২০ ল্যান্সার, কর্ণেল ভাবা গুরবাচান সিং এর নেতৃত্বে, ১৭ রাজপুতানা রাইফেল কে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়ে পাক বাহিনীর ওপর প্রতি আক্রমণ শুরু করে। শত্রুপক্ষ সম্পূর্ণ রূপে পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করে।
 
     লঙ্গেওয়ালাতে অবস্থিত তানট মায়ের (হীংলাজ মায়ের এক রূপ) মন্দির ভারতীয় সেনার কাছে আজও বিখ্যাত। স্থানীয় মানুষ অনেকে তানট মাকে "যুদ্ধবালি দেবী" বলে ডাকেন। ১৯৬৫ এর যুদ্ধে পাকিস্তানের ৩০০০ এর ওপর গোলা সেখানের সকল ঘর বাড়ি ধ্বংস করেদিলেও এই মন্দির অক্ষত থেকে যায়। ৪০০ টির বেশি গোলা মন্দিরের সম্পূর্ণ কাছে পড়েও তা কোনো অজ্ঞাত কারনে বিস্ফোরিত হয়নি। এরপর বি.এস.এফ সেনারা এই মন্দিরের পুজোর দায়িত্ব ভার নিজেরাই গ্রহণ করেন। ১৯৭১ এর যুদ্ধেও একই ভাবে এই মন্দির রক্ষা পায়। পরবর্তীতে ভারতীয় সেনার তরফ থেকে বড় একটি মন্দির বানানো হয়। এ এক চমকপ্রদ ঘটনা, যেন এক শুভ শক্তির অদৃশ্য ছায়া ঘিরে রেখেছে এই অঞ্চলকে অশুভ শক্তির হাত থেকে বাঁচাতে। বিস্ফোরিত না হওয়া সেই গোলা গুলির কিছু নিদর্শন আজও মন্দিরে গৃহে আর লঙ্গেওয়ালার ওয়ার মেমোরিয়াল আর জয়সালমের ওয়ার মিউজিয়ামে সজ্জিত রয়েছে। পাকিস্তানের এক উচ্চপদস্থ সেনা আধিকারিক নিজে একবার এই তানট মন্দির দেখতে এসেছিলেন।
 
     এই ঘটনার ওপর নির্মিত বর্ডার চালচিত্র আর তার মনমুগ্ধকর সঙ্গীত ও সংলাপ ভারতে দেশপ্রেমের শ্রেষ্টত্বের আসন চিরতরে অর্জন করেছে। তবে চলচিত্রে অতিরঞ্জিত করে অনেক ভারতীয় সেনার মৃত্যু দেখান হয়ে থাকলেও, বাস্তব এর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাত্র ২জন ভারতীয় সিপাই আর বি.এস.এফ. এর ৫টি উট সেদিন যুদ্ধ শুরুর প্রাথমিক পর্যায়ে, পাকিস্তানি আর্টিলারির গোলার আঘাতে শহীদ হন। আর ১জন আহত সেনা যুদ্ধ শেষে মারা যান। পাকিস্তানের ৩৪ টি ট্যাঙ্ক (সেরমান ও টি-৫৯) সহ ৫০০ এর ওপর গাড়ি ধ্বংস হয়। প্রায় ২০০ সেনা প্রাণ হারায়। আর কিছু ট্যাঙ্ক আর গাড়ি ভারতীয় সেনা বন্দী বানায়। বীরত্বের সঙ্গে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে মেজর কুলদীপ সিং চাঁদপুরী (Brigadier Kuldip Singh Chandpuri MVC, VSM - 22Nov1940 to 17Nov2018) ভারতের দ্বিতীয় সর্বচ্চ সামরিক সন্মান মহাবীর চক্রে ভূষিত হন। আরো অন্যান্য সেনারাও বিভিন্ন সামরিক সন্মানে ভূষিত হন। যদিও এই যুদ্ধের সফলতার শিরোপা নিয়ে ভারতীয় সেনা বাহিনী আর বিমান বাহিনীর মধ্যে বিস্তর মতান্তর রয়েছে। বিমান বাহিনীর মতে সেদিন কোনরূপ প্রতিরোধ ভারতীয় সেনারা গড়ে তুলতেই পারেনি। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী এটি নিছকই সেনা কর্তৃক একটি সাজানো ঘটনা, আর তাই এই জয়ের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব ভারতীয় বিমান বাহিনীর। কিন্তু বিভিন্ন তথ্যের নিরিখে বলাই যায় এই যুদ্ধে সেনা বাহিনীর ভূমিকাও অনস্বীকার্য। কারন গতি রুদ্ধ না হলে শত্রু বাহিনী পরদিন ভোরে ভারতের অনেকাংশ দখল করে নিতো। তবে যেভাবেই ঘটে থাকুক, আর যারাই ঘটাক, আদতে এটি ভারত মায়ের জয়, সকল ভারতবাসীর জয়।
 
     রাজস্থানে ঘুরতে গেলে লঙ্গেওয়ালার ওয়ার মেমোরিয়াল, জয়সালমির ওয়ার মিউজিয়াম আর তানট মায়ের মন্দিরে অবশ্যই অবশ্যই যাবেন বন্ধুরা। দেশের বীরদের বীরত্বের উজ্জ্বল গাঁথা নিয়ে লঙ্গেওয়ালা আজও বিরাজমান। 
 
(বৃহদারন্যক উপনিষদ ১/৪/১৪)-
"সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ
     সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ।
          সর্বে ভদ্রাণি পশ্যন্তু
               মা কশ্চিৎ দুঃখভাগ্ভবেৎ।।"
 
     জয় হিন্দ
ADVERTISEMENT

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait