প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথের দুই রানী – ‘নয়রানি’ আর ‘হয়রানি’

প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথের দুই রানী – ‘নয়রানি’ আর ‘হয়রানি’

রূপকথার প্রায় সব গল্পেই একজন করে রাজা থাকেন, আর তার দুটি রানী থাকেন, একটি সুয়োরানী আর অন্যটি দুয়োরানী। তবে রূপকথায় কিংবা গল্প-উপন্যাসে কেউ হয়ত ‘হয়রানি’ ও ‘নয়রানি’র গল্প শোনেননি। আর হ্যাঁ, তাঁরা ছিলেন, আর নির্মলাকুমারীর ভাষায়: “আমরা দুজনেই রানী, কাজেই কবি মজা করে কখনও আমাকে ‘প্রথমা’ ও রানী চন্দকে ‘দ্বিতীয়া’ বলে সম্বোধন করেন, আবার কখনও আমাকে ‘হয়রানি’ আর ওঁকে ‘নয়রানি’ বলে ডাকেন”। পড়ুন ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত'র কলমে প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথের দুই রানী – ‘নয়রানি’ আর ‘হয়রানি’


প্রবন্ধ : রবীন্দ্রনাথের দুই রানী – ‘নয়রানি’ আর ‘হয়রানি’
কলমে : ইন্দ্রজিৎ সেনগুপ্ত

 

রূপকথার প্রায় সব গল্পেই একজন করে রাজা থাকেন, আর তার দুটি রানী থাকেন, একটি সুয়োরানী আর অন্যটি দুয়োরানী তবে রূপকথায় কিংবা গল্প-উপন্যাসে কেউ হয়তহয়রানিনয়রানি গল্প শোনেননি আর হ্যাঁ, তাঁরা ছিলেন, আর নির্মলাকুমারীর ভাষায়: আমরা দুজনেই রানী, কাজেই কবি মজা করে কখনও আমাকেপ্রথমা রানী চন্দকেদ্বিতীয়াবলে সম্বোধন করেন, আবার কখনও আমাকেহয়রানিআর ওঁকেনয়রানিবলে ডাকেন”।
 

ADVERTISEMENT

রাণী চন্দ (নয়রানি) সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয়:

১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে মুকুল দে (রাণী চন্দের দাদা) মা, ভাই, বোনেদের শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসেন রানী চন্দ লিখছেন: সন তারিখ মনে নেইমনে থাকেও না; তখন বেশ বড় হয়েছি, বিক্রমপুর থেকে কলকাতায় এলাম আমরা মায়ের সঙ্গে; তার কিছুকাল বাদে বড়দা দেশে ফিরে এলেন বিলেত হতে বারো বছর পরে এসেই চললেন শান্তিনিকেতন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করতে; সঙ্গে নিলেন - দিদি আমি - দুই বোনকে

আশ্রমের আদি বাড়ি ছিল গেষ্ট হাউস সেখানেই আমরা ছিলাম পরদিন খুব ভোরে ভোরে উঠলাম গেষ্ট হাউসের কাছেই রাস্তার ওধারে পান্থশালা; উঠোনে মাচা ভর্তি বেগনি রঙের সিম ফুল, আর ঝোপভরা ছিল রাশি রাশি আকন্দ বড়দা এনেছিলেন বিদেশ হতে বিখ্যাত স্টেটমারের হাতে গড়া মাটির একটি মেটুলি রঙের ছোট্ট বাটি দুহাতের মাঝে রাখা যায় এমনি মাপ বাটির সেই বাটিতে সিম ফুল আর আকন্দ ফুল তুলে ভরে নিলাম; নিয়ে চললাম দু-বোন বড়দার সঙ্গে গুরুদেবকে প্রণাম করতে

মনে আছে ঘরে ঢুকে প্রণাম করতে যাবকি খুশি হয়ে উঠলেন ফুল দেখে বললেন, ‘কে এল আমার আকন্দ নিয়ে আমায় উপহার দিতে’? বলতে বলতে দু-হাত বাড়িয়ে ফুলভরা বাটিটি তিনি তুলে নিলেন আমার অঞ্জলি হতে আমাদের বললেন, ‘আশ্রম দেখেছিস তোরা? আলাপ হয়েছে মেয়েদের সঙ্গে? যা যা আলাপ করে নে মেয়েদের সঙ্গে আলাপ হতে আর কি – ‘হ্যাঁ ভাই, হুঁ ভাই করবি, আলাপ হয়ে যাবে সেই শুনেই খিলখিল করে হেসে উঠলাম, আর কি বললেন শুনতেই পেলাম না গুরুদেবও হাসলেন সেই সঙ্গে
 

সোয়া পাঁচ আনা - মঙ্গল চণ্ডীর ব্রত:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলেন, কিন্তু খরচা আসবে কোথা থেকে? ইতিমধ্যে তিনি তার নোবেল প্রাপ্তির প্রায় পুরো টাকাটাই দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির কাজে কিন্তু আরও টাকা চাইখরচ অনেক তিনি সেই সময় অর্থ চিন্তায় বেশ জর্জরিত
কিভাবে টাকার উপায় হতে পারে আলোচনার জন্য শান্তিনিকেতনেই নিজের কাছের জন দের নিয়ে একটা ছোট সভা ডাকলেন উপস্থিত সকলের মতামত চান তিনি অনেকেই গুরুদেবকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিচ্ছেন সবার চোখে-মুখে উৎকণ্ঠা
গুরুদেব বুঝলের সভার পরিবেশ বড় বেশী গুরুগম্ভীর হয়ে উঠছে তিনি হঠাৎ বলে উঠলেন, - “আহা তোমরা এত ভাবছ কেন? টাকা পাবার একটা অতি সহজ উপায় আছে
সবাই কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইলেন, - “কি সে উপায়”?
গুরুদেব এবার সেখানে উপস্থিত রানী চন্দকে আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে সবার দিকে ফিরে বললেন, - “মাত্র সোয়া পাঁচ আনা খরচ
গুরুদেবের কথা শুনেই লজ্জায় পড়ে গেলেন রানী চন্দ তিনি বুঝে নিয়েছেন এবার গুরুদেব ঠিক কি বলতে চলেছেন
আসল ঘটনা হল, রানী চন্দ একবার খুব আগ্রহ নিয়ে গুরুদেবকে মা মঙ্গলচণ্ডীর ব্রতের কথা শুনিয়ে ছিলেন বাংলার ঘরে ঘরে সেই সময় এই ব্রত বেশ প্রচলিত ছিল এই ব্রতকথাতে বলা আছে নিষ্ঠাভরে এই ব্রত উপবাস করলে নির্ধনেরও ধন হয় রানী চন্দ ঠিক এই কথাই বলেছিলেন গুরুদেবকে সাথে এও বলেছিলেন – “পুজোর খরচও বেশি নয়, মাত্র সোয়া পাঁচ আনা



রাণী চন্দ বিয়েরবীন্দ্রনাথের পৌরহিত্য:

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সেইটি হয়েছিল ১৯৩৩ সালে সেবার রবীন্দ্র সপ্তাহ উদযাপনের জন্য ডাক এসেছে মুম্বই থেকে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছেন সাথে প্রায় জনা পঁয়তাল্লিশের একটি দল সেই দলে রানী চন্দ আছেন তিনি তখন রানী দে এবং সাথে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত সচিব অনিল চন্দও সেই দলে উপস্থিত বিশ্বভারতীর সূত্রেই শান্তিনিকেতনেই একে অপরকে চেনা জানা দুজনের বিয়েও প্রায় ঠিক কিন্তু শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসেছে অনিল চন্দের পরিবার বিয়ে এখন হয় কিনা সেটিই একটি বিরাট প্রশ্ন গুরুদেব সব শুনেছেন কিন্তু কোনও মন্তব্য করেন নি
রবীন্দ্রনাথ মুম্বাই চলেছেন হঠাৎ বর্ধমান ষ্টেশনে দেখা গেল রানী দে আর অনিল চন্দ হাজির তারাও বিয়েতে দুবাড়ির মনোমালিন্য ভুলে রবীন্দ্রনাথের সাথে যাত্রায় সামিল হতে চায় মুম্বই পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ উঠলেন পূর্ব নির্ধারিত টাটা প্যালেসে বাকিরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা মতো রানী দে উঠলেন পুরুষোত্তম ত্রিকোমদাসের (সেই আমলের নামজাদা আইনজীবী) স্ত্রী বিজু বেনের বাপের বাড়িতে তখন বিজু বেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের ছাত্রী যেদিন তারা মুম্বই পৌঁছালেন সেদিন বিকেলেই রবীন্দ্রনাথ খবর পাঠালেন রানীকে ভালো করে সেজে গুঁজে তাড়াতাড়ি টাটা প্যালেসে চলে আসতে কবিগুরু সেজে আসতে বলেছেন এদিকে রানী তাড়াহুড়োয় একটার বেশি শাড়ি আনেন নি গত কয়েকদিন এই একটি শাড়ি পরেই কাটছে চিন্তায় পড়লেন তিনি অনেক কষ্টে একটা শাড়ি জোগাড় হল সেই শাড়ি পরে এবং মাথায় একটু ফুল জড়িয়ে হাজির হলেন রানী টাটা প্যালেসে গিয়ে দেখলেন গরদের ধুতি-পাঞ্জাবি আর গলায় লম্বা জুঁইয়ের মালা পরে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ ডেকে পাঠানো হয়েছে অনিল চন্দকেও রানী আর অনিলকে নিজের সামনে বসালেন কবি
ঘরে তখন উপস্থিত সরোজিনী নাইডু, নন্দলাল বসু, ক্ষিতিমোহন সেনও গুরুদেবের নির্দেশে নন্দলাল বসু হলেন কন্যাপক্ষ শান্তিনিকেতনে রানী তার প্রিয় ছাত্রী ক্ষিতিমোহন সেন হলেন বরপক্ষ রবীন্দ্রনাথের কড়া হুকুম ঘরে এই সময় যেন কেউ না ঢোকে সেই কারণে দরজায় পাহারায় রইলেন হরেন ঘোষ (তিনিই মুম্বাইতে এই রবীন্দ্র সপ্তাহ অনুষ্ঠানের মূল পরিকল্পনাকার) দুজনকে সামনে বসিয়ে রবীন্দ্রনাথ শুরু করলেন বৈদিক মন্ত্র পাঠ তারপর নিজের গলা থেকে ফুলের মালা খুলে ওঁদের হাতে দিলেন তাই দিয়েই হল মালা বদল এবং সম্পন্ন হল বিবাহ


গুরুদেব’ - রাণী চন্দ:

গুরুদেব বইতে রানী তাঁর রবীন্দ্রসান্নিধ্যের অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন যখন প্রথম শান্তিনিকেতনে আসেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, ‘তোর ছবির দিকে ঝোঁকছবিতেই মনপ্রাণ দিয়ে লেগে যা আর সময় নষ্ট করিস নেসে-উপদেশ রানী নিষ্ঠাভরে পালন করেছেন তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৪৮ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে আইফ্যাকসের উদ্যোগে তাতে যথেষ্ট খ্যাতি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তিনি
 

সব হতে আপন’ - রাণী চন্দ:

সব হতে আপন বইতেও রানীর সাহিত্য-প্রতিভার বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে আছে শান্তিনিকেতনের পরিমন্ডল, রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী, নন্দলাল অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সান্নিধ্যের নানা উজ্জ্বল মুহূর্ত -বইয়ের প্রধান উপজীব্য এরই মধ্যে কখনো কখনো ঝলক দিয়ে ওঠে তাঁর ছবি আঁকার প্রসঙ্গ নন্দলাল-সান্নিধ্যের সেরকম একটি বর্ণনার কিছুটা অংশ আমরা উদ্ধৃত করতে পারি

 

আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’ - রাণী চন্দ:

রোগশয্যার দিনগুলিতে প্রতিদিনই কিছু না কিছু বলেন, পাশের লোক লিখে নেন রাণী চন্দ কথাবার্তা লিখতে চেষ্ঠা করেন, তার আভাষআলাপচারী রবীন্দ্রনাথগ্রন্থে পাওয়া যায়

এক-একদিন এক-একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করেনকোনদিন পুরনো কথা, বিলেতে হেনরি মর্লি কিভাবে পড়াতেনবঙ্কিমচন্দ্র কোন বই পড়ে কি বলতেন, ইত্যাদি সমাজে মেয়েদের স্থান যে কতো বড়ো, এবং কেন যে বড়ো, একদিন সে সম্বন্ধে আলোচনা করলেন (২০ এপ্রিল ১৯৪১) সেদিন বললেন, সব মানুষই Instinct নিয়ে জন্মায় সবার ভিতরেই থাকে কামনা ইচ্ছে ক্ষুধার অন্নএই অন্ন দেহ মন দুই চায় মানুষের ভিতরে ভিতরে অনেক রকম পশুবৃত্তি আছে, যা নির্মল নয়, অথচ প্রবল যারা ভালো তারা চায়, সেই Instinctকে জয় করতে ... এখানেই দরকার হয় শিক্ষার শিক্ষার দ্বারা Instinctকে মার্জিত সুন্দর সংযত সুসভ্য করা যায় Instinctকে মার্জিত করেই সাধক, মুনি, সাধু হতে পেরেছে এই জায়গায় শিক্ষার প্রয়োজন; সংস্কারে হয় না
 

রাণী চন্দকে উপলক্ষ্য করে বিশ্বের নারীদের নিয়ে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ

শেষ জীবনে যখন রবীন্দ্রনাথ বাধ্য হয়েছেন কারও কারও সেবা নিতে, সেই সেবিকাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রানী চন্দ ১৯৪০ সালে কালিম্পং থেকে ফিরে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি সে বার চিকিৎসা চলার সময়ে টানা কলকাতায় থেকে তাঁর সেবা করেছেন রানী সে সময়

একদিন রোগশয্যায় শুয়ে কবি রাণীচন্দকে বলেন, “এক হিসাবে নারী হচ্ছে universal, তাদের স্থান হচ্ছে সৃষ্টির মূলে দয়া, সেবা, লালনপালন এতেই তাঁদের সত্যকার রূপ প্রকাশ পায় পুরুষ যেমন বিধাতার স্বতন্দ্র সৃষ্টি, কিন্তু মেয়েদের বেলায় তা নয় সব নারী মিলেএক নারী এই দিন কবি লেখেননারীকবিতাটি কবিতাটি লিখে রাণী চন্দকে দিয়ে বলেন, “তোকে উপলক্ষ্য করে বিশ্বের নারীদের লিখেছি রোগই তোদের দেবতা

যে অভাগ্য নাহি লাগে কাজে,

প্রাণলক্ষ্মী ফেলে যারে আবর্জনা-মাঝে,

তুমি তারে আনিছ কুড়ায়ে,

তার লাঞ্ছনার তাপ স্নিগ্ধ হস্তে দিতেছ জুড়ায়ে

 

অনুলিপিকার রাণী চন্দ:

রবীন্দ্রনাথের রোগশয্যায় মুখে মুখে বলা রচনার অনুলিপিকার ছিলেন তিনি ছাড়া অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনী এবং তার দুটি স্মৃতিকথা জোড়াসাঁকোর ধারে এবংঘরোয়াতারই অনুলিখন

৩০ জুলাই, ১৯৪১ - সকালে কবির অপারেশন, সেজন্য দুজনেই গিয়েছিলেন জোড়সাঁকোয় গুরুদেব অনেকক্ষণ হল চুপ করে বসে আছেন কি যেন ভাবছেন রানী চন্দ লিখছেন: “বুঝলাম কিছু কথা মনে এসেছেকাগজ কলম নিয়ে পাশে বসলাম আমাকে কাছে বসতে দেখে ইশারা করলেনলেখো আমি লিখে যেতে লাগলাম, গুরুদেব ধীরে ধীরে বলে যেতে লাগলেন:

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি

বিচিত্র ছলনাজালে,

হে ছলনাময়ী

মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে

সরল জীবনে

কবিতাটি বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন গুরুদেব আজকাল কিছু ভাবতে গেলে অল্পেতেই তাঁর ক্লান্তি আসে; কথা তিনি নিজেও বলেন

গুরুদেব আবার বুকে দুহাত জড়ো করে চুপচাপ চোখ বুঝে রইলেন অনেকক্ষণ কাটল এইভাবে, সাড়ে টার সময় বললেন, লিখে নে:

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার

বললেন, “সকালবেলার কবিতাটার সঙ্গে জুড়ে দিস্

গল্পসল্প’- বেশ কিছু গল্পের লিপিকার রানী চন্দ শেষ দিকে যখন কবি টানা লিখতে পারতেন না, তখন মাঝেমধ্যেই ডাক পড়ত তাঁর ১৯৪১-এর জুলাই মাসে কলকাতায় অসুস্থতার সঙ্গে যখন লড়ছেন কবি, তখনও তাঁর নির্দেশেই শহরে ছিলেন রানী-অনিল রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতামৃত্যু’- লেখা তাঁর হাতেই

দুঃখের আঁধার রাত্রি বারে বারে

এসেছে আমার দ্বারে;

একমাত্র অস্ত্র তার দেখেছিনু

কষ্টের বিকৃত ভান, ত্রাসের বিকট ভঙ্গি যত

অন্ধকার ছলনার ভূমিকা তাহার

 

রাণী মহলানবিশ’(হয়রানি) - এর সাথে রবীন্দ্রনাথের প্রথম পরিচয়:

নির্মলকুমারী [রানী] মহলানবিশ লিখেছেন: "কবির সঙ্গে সত্যিকার পরিচয় ঘটল আমাদের বিয়ের রাত্রে--- তাই তারিখটা মনে আছে, --- ১৫ই ফাল্গুন ১৩২৯ সালবিয়ের সভা ভঙ্গ হলে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন রবীন্দ্রনাথ উপরে এসে বসলেন বরকনের সামনেনিজেই মনের আনন্দে একটার পর একটা গান চললো অনুরোধ উপরোধের অপেক্ষা না রেখেই মনে আছে প্রথমেই গেয়েছিলেন "এতদিন যে বসে ছিলেম" তারপরে হোলো " আমার চাঁদের আলো", … সেদিন দোলপূর্ণিমার আগে শুক্লা একাদশীর রাত - গাইলেন " কবে তুমি আসবে বলে" আরো কত গান--- "সে কি ভাবে" ইত্যাদি বসন্ত গানের ছড়াছড়ি"

রাণীর বিয়েতে রবীন্দ্রনাথের উপহার:

তোমাদের এই মিলন-বসন্তে

দিলেন কবি বসন্ত-গান আনি

সুন্দরের প্রেম সাজুক আনন্দে

পরুক গলায় সুরের মালাখানি"

এই প্রসঙ্গে পরবর্তীকালে রাণী মহলানবিশ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে "পত্রাবলীর ভূমিকা" প্রবন্ধে লিখছেন, "পরদিন [১৬ ফাল্গুন বুধ 28 Feb.] জোড়াসাঁকোয় দুজনে গেলাম রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করতে … 'বসন্ত' নাটকটির সব গানগুলির বাঁধানো পান্ডুলিপিখানি আমাদের হাতে দিয়ে বললেন, তোমাদের বিয়ের রাত্রেই এই নাটকের প্রথম [দ্বিতীয়] অভিনয়, তোমাদেরই এটি পাবার অধিকার; তাই মনে ভাবলুম এই গানগুলিই হবে যোগ্য উপহার বিবাহের--- আমি এর চেয়ে আর বেশী কি দিতে পারি

রাণীর প্রথম শান্তিনিকেতনে পা:

পৌষমেলা [1923] উপলক্ষেই তখন শান্তিনিকেতনে এলেন প্রশান্তচন্দ্র মহালানবিশের পত্নী রানী মহলানবিশ প্রশান্তচন্দ্র কলেজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় পৌষোৎসবে আসতে পারেননি, পত্নী রানীকে পৌষ [শুক্র ২১ ডিসেঃ] শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দিলে রানী পরের দিন পৌষ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে স্বামীকে লিখলেন:

তুমি আসনি বলে খুব বল্লেন আমাকে বকলেন যে আমি কেন জোর করে ধরে আনলাম না

প্রশান্তচন্দ্রের শান্তিনিকেতনে আসাকে উপলক্ষ করে কৌতুকপ্রিয় রবীন্দ্রনাথ স্বামী বিরহিনী নির্মলকুমারীর উদ্দেশে একটি কবিতা লিখে প্রচার করেন:

চৈত্ররজনী সুফলা

বিরহিনী একাকিনী হতজ্ঞান করে ধ্যান

পায়ে ফলা

বিশ্বভারতী হায়

তার কোথায় সারথি

সেই দুরন্ত চিন্তা কারে করে চপলা

 

রানীর মুখে গানের গল্প:

তোমার বীণা আমার মনোমাঝে’ – এই গানটি সম্পর্কে রানী মহলানবিশ লিখছেন: “কিছুদিন আগে আলিপুরে থাকার সময় একজন তরুণ পাগল-কবি রবীন্দ্রনাথকে কবিতা পড়ে শোনাতে আসে তার সত্যকার কবিত্বশক্তি থাকলেও পাগলামীর জন্য কয়েক লাইন লেখার পরেই তার সংগতি হারিয়ে যেত এই পাগল রবীন্দ্রনাথের মনকে এতটা নাড়া দিয়েছিল যে, খানিকক্ষণ পরে চমৎকার একটি গান লিখলেন

তোমার বীণা আমার মনোমাঝে

কখনো শুনি, কখনো ভুলি, কখনো শুনি না যে

 

কবির সঙ্গে য়ুরোপে:

রবীন্দ্রনাথে সঙ্গে রানীর শুধুমাত্র ভ্রমণ নয়সাহিত্য থেকে রাজনীতি সব কিছু তিনি যেমন লিপিবদ্ধ করেছেন তেমনি সাধ্যমত সহযোগিতা করেছেন জেনিভা হ্রদের ধারে ছোট্ট শহর ভিলেন্যুভ- রোমা রোলাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতকারের বিবরণ আছে নির্মলকুমারীর ডায়েরিতে

 

পথে পথের প্রান্তে:

রবীন্দ্রনাথের ইউরোপ ভ্রমণের সময় রানী যে কতটা সামাল দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন তাই- লেখা আছে পথে পথের প্রান্তের চিঠিপত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “১৯২৬ খ্ৰীষ্টাব্দে যুরোপ ভ্রমণে বেরিয়েছিলুম সেখানকার নানা দেশে আমার ডাক পড়েছিল তখন অসুস্থদশায় রথীন্দ্রনাথ বন্দী ছিলেন বার্লিনে আরোগ্যশালায় তাই আমার সাহচর্যের ভার পড়েছিল প্রশান্ত মহলানবিশের পরে, তার স্ত্রী রাণী ছিলেন তার সঙ্গে সমস্ত ভার বিনা বাক্যে কখনো বা প্রবল বাক্যব্যয়ে তিনিই নিয়েছিলেন নিজের হাতে

 

কবির সঙ্গে দাক্ষিনাত্যে - ‘শেষের কবিতা’:

এই দাক্ষিনাত্য ভ্রমণের ফাঁকে অনেকটা রানীর চাপে পড়েই তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত উপন্যাসশেষের কবিতা রানী কবিকে বলেছিলেন: “শেষের কবিতা’-টাও তো আমি জোর করেই আপনাকে দিয়ে আরম্ভ করিয়েছিলাম আপনি মুখে মুখে সন্ধ্যেবেলা কুনুরে আমাকে আর ওঁকে গল্প বলেছিলেন চা খাবার পরেই আমি আবদার করলাম কালকের গল্পটা আপনি লিখে ফেলুন আপনি কিছুতেই রাজি হচ্ছেন নাআমি মনে মনে জানতাম যে কোনরকমে ১২-১৪ লাইন লেখা হয়ে গেলেই আর ভাবনা নেই, আপনি নিজের তাগিদেই তখন লিখবেন তাই একখানা খাতা টেবিলের উপর রেখে প্রায় জোর করেই আপনাকে আরামচৌকি থেকে উঠিয়ে নিয়ে এসে লেখবার টেবিলে বসিয়ে জবরদস্তি লেখাটা শুরু করালাম যখন উটি রওনা হচ্ছি তখন দেখি প্রায় ১২/১৪ লাইন লেখা হয়েছে মন নিশ্চিন্ত করে চলে গেলাম যে এইবার গল্প চললো

 

রবীন্দ্রনাথের থেকে পাওয়া কবিতা উপহার:

পনেরোই ফাল্গুন ২৭ ফেব্রুয়ারি আমাদের বিয়ের সাম্বৎসরিক প্রত্যেক বছরেই এই দিনে ওঁর আশীর্বাদ পাই এবারে এত শরীর খারাপ সত্ত্বেও আমাদের সে-সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত করেনি খাম খুলে দেখিরানী প্রশান্ত

          বর্ষ পরে বর্ষ গেছে 'লে

      ছন্দ গাঁথিয়াছি আমি তোমাদের মিলনমঙ্গলে

      এবার দিনের অন্তে বিরল ভাষার আশীর্বাণী

          রবির স্নেহের স্পর্শ আনি

          পশ্চিমের ক্লান্ত রশ্মি হতে

যোগ দিল তোমাদের আনন্দিত গৃহের আলোতে

 

রানীর সঙ্গে শেষ কথোপকথন:

রাণী লিখছেন, আগষ্ট দুপুর থেকে হিক্কা আরম্ভ হয়েছে, বড্ড কষ্ট পাচ্ছেন সন্ধ্যেবেলা কবির খাটের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আমার দিকে চেয়ে বললেন, “একটা কিছু করো? তুমি তো হেড নার্সদেখতে পাচ্ছ না কি কষ্ট পাচ্ছি? বলো তোমার দাদাকে কিছু ব্যবস্থা করতে

মীরাদি ঘরের কাছেই দাঁড়িয়েছিলেন, বললামভাই, একটু বড়ো এলাচ আর মিছরি গুড়ো করে একসঙ্গে মিশিয়ে দাও না কয়েকবার দেবার পরই হিক্কা অন্তত খানিকক্ষণের জন্যেও থেমে গেল গুরুদেব বললেন, “আঃ বাচলুম! এই জন্যেই তো হেড নার্স বলি

 

রাণীর থেকে চিরবিদায় নিলেন রবীন্দ্রনাথ:

মনে হল গুরুদেব আমাকে বারবার বলেছিলেন, "তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলকাতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, 'জয় বিশ্বকবির জয়', 'জয় রবীন্দ্রনাথের জয়', 'বন্দেমাতরম' - এই রকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে আমি যেতে চাই শান্তিনিকেতনের উদার মাঠের মধ্যে উন্মুক্ত আকাশের তলায়, আমার ছেলেমেয়েদের মাঝখানে সেখানে জয়ধ্বনি থাকবে না থাকবে শান্ত স্তব্ধ প্রকৃতির সমাবেশ প্রকৃতিতে মানুষে মিলে দেবে আমাকে শান্তির পাথেয় আমার দেহ শান্তিনিকেতনের মাটিতে মিশিয়ে যাবে - এই আমার আকাঙ্ক্ষা তোমাকে সব বলে রাখলুম আগে থেকে"

কবিগুরুর সেই শেষ ইচ্ছে আর পূরণ হতে পারেনি নির্মলকুমারী লিখছেন, "বেলা তিনটের সময় একদল অচেনা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষে আমাদের সামনে থেকে সেই বরবেশে সজ্জিত দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল শুধু কানে আসতে লাগল - 'জয় বিশ্বকবির জয়', 'জয় রবীন্দ্রনাথের জয়', 'বন্দেমাতরম'

 

ঋণ: রবিজীবনীপ্রশান্ত কুমার পাল

বাইশে শ্রাবণ/কবির সঙ্গে য়ুরোপে:/ পথে পথের প্রান্তে:/ কবির সঙ্গে দাক্ষিনাত্যে; – নির্মলকুমারী মহালনবিশ

গুরুদেব’/‘সব হতে আপন’/ ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’- রাণী চন্দ


0 comments

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait