ভ্রমণকাহিনী : কার্শিয়াং - দার্জিলিং - তাকদা

ভ্রমণকাহিনী : কার্শিয়াং - দার্জিলিং - তাকদা

প্রায় দু'বছর বাড়িতেই কোণঠাসা ছিলাম। তাই প্ল্যান হল, কার্শিয়াং - দার্জিলিং - তাকদা যাওয়ার। করোনা কালের আগমনের আগেই ভাইজাগ ছুঁয়ে এসেছিলাম। দীর্ঘ দু'বছর পর কদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে আসলেও প্রথমে ভেবেছিলাম এবার বোধহয় আর ঘুরতে যাওয়া হলো না। কারণ এন.জে.পি স্পেশাল যাওয়ারটা আমাদের ক্যানসেল হয়ে গেছিলো। তড়িঘড়ি তৎকালে টিকিট কেটেই ফেললাম। অলোকা বিশ্বাস সাহার লিখলেন কার্শিয়াং - দার্জিলিং - তাকদা'র ভ্রমণ কাহিনী।


ভ্রমণকাহিনী : কার্শিয়াং - দার্জিলিং - তাকদা
কলমে : অলোকা বিশ্বাস সাহা

 

প্রায় দু'বছর বাড়িতেই কোণঠাসা ছিলাম। তাই প্ল্যান হল, কার্শিয়াং - দার্জিলিং - তাকদা যাওয়ার। করোনা কালের আগমনের আগেই ভাইজাগ ছুঁয়ে এসেছিলাম। দীর্ঘ দু'বছর পর কদিনের জন্য বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে আসলেও প্রথমে ভেবেছিলাম এবার বোধহয় আর ঘুরতে যাওয়া হলো না। কারণ এন.জে.পি স্পেশাল যাওয়ারটা আমাদের ক্যানসেল হয়ে গেছিলো। তড়িঘড়ি তৎকালে টিকিট কেটেই ফেললাম। সঙ্গে বগলদাবা করে নিয়ে চললাম আমার মা- বাবা, আমার কর্তা আর আমার একমাত্র পুত্রকে।
 

২৬ শে মে সন্ধ্যেবেলা যথারীতি  ট্রেনে চেপে বসলাম। গল্প গুজবে, খাওয়াদাওয়ায় ট্রেনে সময় ভালোই কাটলো। পরের দিন সকাল ৯টা নাগাদ জলপাইগুড়ি পৌঁছে গেলাম। আমরা কার্শিয়াং যাবো প্রথমে। ওখানে ইডেনলা হোমস্টেতে উঠবো। ডাউহিলের বড়ো শিবখোলা ফরেস্টের আন্ডারেই এই হোমস্টে।
 

ADVERTISEMENT
Swades Times Book

যাইহোক, জলপাইগুড়িতে গাড়ি এসে পৌঁছলো আমাদের। শিলিগুড়ি ছাপিয়ে হু হু করে ছুটে চললো আমাদের গাড়ি কার্শিয়াংয়ের উদ্দেশ্যে। ব্রেকফাস্ট করা হয়নি কারোরই। তাই মাঝ রাস্তায় গাড়ির ড্রাইভার দাদাকে বললাম গাড়ি থামিয়ে আগে কিছু খাওয়ার জন্য। কার্শিয়াং ছুঁয়ে ফেলেছি তখন প্রায়। পাহাড়ের আঁকিবুকি কাঁটা রাস্তায় সূর্যের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্রমে আকাশে মেঘ জমে উঠছে থেকে থেকেই। আর সে মেঘ আমাদের ঘিরে ধরলো অচিরেই।
 

 

গাড়ি এসে থামলো সুন্দর একটা ছবিওয়ালা জায়গাতেই। পাহাড়ের আড়ালে লাল নীল সবুজ হলুদ পতাকা টাঙানো বেশ কয়েকটা হোটেল রয়েছে এখানে। যেখানে আমরা উঠলাম সেখানে ঠান্ডা পানীয়, চা কফি সবই আছে। বেলা তখন প্রায় এগারোটা। খিদেও পেয়ে গেছিলো আমাদের। মোমো বরাবরই আমার ভীষণ প্রিয়। আর পাহাড়ের লোকেদের হাতের বিশেষত্ব হয় তো এটাই। যতই কলকাতায় মোমো খাই না কেন, এখানকার কাছে হার মানতেই হবে। ওখানে আমরা মোমো, ডিমের ওমলেট, কোল্ড ড্রিংক সহযোগে খেলাম, বাবা এসব খায় না বলে পরোটা খেলো। সামান্য বেসিনে হাত ধুতে গেছিলাম, তখনি পাহাড়ের গা ঘেঁষে বাইকের আওয়াজ আর পিঁপড়ের মতন সারি সারি গাড়ি লাইন দিয়ে চলছে আপন পথে সে দৃশ্যতেও আটকে থাকতে হলো কিছুক্ষণ। ওখানে একজন বৃদ্ধা আর তার ছেলে এসব খাবার বানিয়ে দিচ্ছিলো।

সব শেষে যখন কফির কাপে চুমুক দিয়েছি তখন পাহাড় ভেঙে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি এলো। এলোপাহারি হাওয়া কাছের জানলায় ঝাপ্টা দিয়ে বৃদ্ধা মা আর তার ছেলেকে ব্যস্ত করে তুললো।

 


সাড়ে এগারোটা ছাড়িয়েছে ঘড়ি, বুঝতে পারলাম ড্রাইভার দাদা তাড়া দিচ্ছে, কারণ আমাদের পৌঁছে দিয়ে তাকে আবার দার্জিলিং পৌঁছতে হবে। কিন্তু আমার ছেলের কফি তখনো শেষ হয়নি যে। ড্রাইভার দাদাকেই উল্টে হালকা করে বকা দিলো বৃদ্ধা মা এবার। বুঝলাম উনি বলছেন, বাচ্চা ছেলেটা খাওয়া হয়নি, না খাওয়া হলে যাবে কি ভাবে!

 

পাহাড়ি মানুষের আতিথেয়তা ভীষণ আকর্ষণীয় লাগে বরাবরই আমার। পাহাড়ের মতনই বড়ো মাপের মন আর ডেডিকেশন লেভেল অকল্পনীয়। আমার হাতের ছাতাটাও ভেজাতে নিষেধ করলো। নিজের ছাতা দিলো একটা, আর ড্রাইভার দাদা সেই ছাতা ধরে এক একজন করে যত্ন সহকারে আমাদের গাড়িতে তুলে দিলো।



রাস্তাতেই দেখা মিললো, কার্শিয়াং স্টেশন থেকে বেরোনো টয় ট্রেনের। তাকে টাটা করতে করতেই বাঁক নিয়ে ডানদিকে গাড়ি উঠলো আরো উঁচুতে।
আরো ৪৫ মিনিট পর বেশ উঁচুতেই আমাদের হোমস্টে, এবং বেশ একটু ভেতরেই। গাড়ি পথ নয়। হালকা জঙ্গলের আস্তরণের মাঝখানে হোমস্টের মালিক দাদা দায়িত্ব সহকারে তার ভাইকে পাঠিয়ে দিয়েছিলো পথ চেনানোর জন্য। প্রথমে একটু বিরক্ত হয়েছিলাম বটেই। এতো ফাঁকা, এরকম জন কোলাহলের বাইরে, আবার শুনেছি ডাউহিলের ভূতের উপদ্রবের কথাও। গা ছম ছম করবে দিনের বেলাতেই। এরকম এতো ভেতরে জায়গা, নিরাপদ হবে তো? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এসে উঠলাম ছবির মতন একটা বাড়িতে। আশে পাশে লোকজন আছেন দেখে একটু হলেও নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু এতো কিছু মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেলাম এক নিমেষেই যখন আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখলাম, আমি কি আর আমার মধ্যে আছি? হারিয়ে ফেলেছি যেন নিজেকেই? ঘর কোথায়, বসে আছি তো আকাশেই।

 



 

দূরের দুটো পাহাড় দেখিয়ে হোমস্টের মালিক ভদ্রলোক, বললেন একটা মিরিক অন্যটি জোরবাংলো। মেঘের আস্তরণে কখনো পাহাড়ের মাথা ঢেকে যাচ্ছে, কখনো কুয়াশা ছুঁয়ে যাচ্ছে ব্যালকনি। স্নান করে ফ্রেশ হয়ে হাত ধুয়ে খেতে বসলাম। প্রথমে শুনলাম, ডিমের ঝোল- ভাত। যদিও খেতে বসে দেখি, এলাহি আয়োজন। ভাত, করলা ভাজা, ডাল, আলু পটলের তরকারি, ফুলকপির তরকারি, বরবটির তরকারি, ডিমের কারি, স্যালাড আর ঝরঝরে গরম ভাত। আকৃষ্ট করলো, করলা ভাজাতে। এরকম চিপসের মতন করলা ভাজার রেসিপিটাও জেনে নিতে ভুললাম না। ঘরোয়া রান্নার এক বিশাল সৃজনী তুলে ধরছেন এঁরা। পড়ন্ত বিকেলে রোদের দেখা মিললো। পরিষ্কার আকাশ থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় একথাও শুনলাম। এখানকার লোকজন আমাদের সঙ্গে গল্পে সময় কাটালো। সন্ধ্যেবেলা জোনাকির মতন দূর পাহাড়ের গা চকচক করতে দেখে মন জুড়িয়ে যায়। পাহাড়ি পোকাদের গুঞ্জন, নিজেদের ভাষায় যেন গানের আসরে জমায়েত হয়ে চলেছে। মন প্রলুব্ধ করে বারবার, মনে হয় - কেন থেকে যেতে পারি না একেবারেই!
আবারও যথেষ্ট যত্ন সহকারে নিয়ম করে খাবার, চা, বিকেলে আবার মোমো আর রাতে রুটি আর চিকেন সহযোগে দিনটা কাটলো বেশ।


 

পরের দিন আমাদের লোকাল সাইড সিনে যাওয়ার কথা। এদিন জলখাবারে ছিলো কচুরি আর ঘুগনি। অল্প কিছু খেয়েই বেরোলাম আমরা। কিন্তু এদিন আমার আর আমার পুত্রের শরীরটা একটু খারাপ হয়ে গেছিলো। তাই আমরা কাছেই চিমনি হেরিটেজ পার্ক দেখতে গেলাম। ওপরের দিকে এটা, তাই আমাদের পেছন পেছন বৃষ্টিও পিছু নিলো। ওখানে গিয়ে ভেজা রাস্তার ওপর গাড়ি থামলো। ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ঢুকতে হলো। ইংরেজ আমলের স্থাপত্যের নিদর্শনের মধ্যে পরে এই চিমনি। যার বাকি অস্তিত্ব লুপ্ত হলেও এটি থেকে গেছে। আবার গাড়ি ঘুরিয়ে নিচের দিকে নামতে থাকলাম। ডাউহিলের বিখ্যাত স্কুল ছবির মতন চোখের সামনে চলে এলো। এটি গার্লস স্কুল। মেয়েরা ভলি বল, ফুটবল খেলছিল। অসাধারণ লাগছিলো দেখতে। কিন্তু সেখানেও বাধ সাধলো বৃষ্টি। ডাউহিলের ফরেস্টের বেশ কিছুটা যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো। বৃষ্টির জন্য কাউকে নামতে দিলাম না গাড়ি থেকে। আমি আর বাবা দু চার পা হেঁটে কয়েকটা ছবি তুলে মন শান্ত করে রাখলাম অগত্যা। পাইন গাছের ঝাড় থেকে চুঁয়ে পড়া জল পাতার কোণ থেকে নেমে ফোঁটা ফোঁটা জল কপালের মধ্যে এসে পড়ছে। মেঘগুলো জমায়েত হয়ে চলেছে রাস্তায়, আর আমার মনেও।

 

মায়ের আবদার কার্শিয়াং মার্কেট দেখবো, ঘুরবো। তাই আবার নিচের দিকে নামতে হলো, কার্শিয়াং স্টেশনের কাছে এলাম। টুকটাক কিনলাম। তারপর ফিরে এলাম আবার হোমস্টেতে। ছেলে এবং আমার শরীরের জন্য আর কেউই রাজি হলাম না অন্য কোথাও যাওয়ার জন্য।
দুপুরে আবারো ভাত সহযোগে তিন রকম তরকারি। জম্পেশ ঘুম, বিকেলে পিঁয়াজি আর চায়ের সাথে গল্প গুজব, আলসেমি ভরা সময় দিয়ে আরো একটা দিন কাটিয়ে ফেললাম কার্শিয়াংয়ে। কাল ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়বো দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে।


 

সকাল হতে না হতেই বেরোনোর তোড়জোড়। সকাল ১০ টায় গাড়ি আসার কথা। আমরা সবাই তৈরী। এমন সময় যিনি গাড়ি ঠিক করে দিয়েছিলেন, তিনি জানালেন রাজ্যপাল এসেছেন দার্জিলিং পরিভ্রমণে তাই প্রায় সব রাস্তা বন্ধ। ঘুরিয়ে দিচ্ছে সব দিক থেকে। উনি দু'দিক থেকে দুটো গাড়ি ঠিক করে দিলেন, একটা শিলিগুড়ি থেকে আসুক, একটা দার্জিলিং থেকে আসুক। যেটা আগে আসবে, উঠে পড়লেই হবে। কিন্তু বাধ সাধল ভাগ্য। ড্রাইভার দাদারাও ফোন করে করে পরিস্থিতি বলতে লাগলেন, যে কোনো ভাবেই এক পা গাড়ি নড়ার মতন ক্ষমতা নেই। ফলে অপেক্ষা আর অপেক্ষা। এদিকে কার্শিয়াংয়ের হোমস্টের মালিক দাদাও খুব চেষ্টা করতে থাকলেন গাড়ির। আমাদের সকাল পর্যন্তই বুকিং ছিলো। তারপরেও তারা আমাদের জন্য লাঞ্চের ব্যবস্থা করে দিলো। এঁদের আতিথেয়তা সারাজীবন মনে রাখবো।

 

বিকেল তিনটের সময় গাড়ি এসে পৌঁছলো। ড্রাইভার দাদাও বিধ্বস্ত। প্রত্যেকেই একটা অস্বস্তিতে ছিলাম। মাঝ রাস্তায় পাইনের ঝোপ ঝাড় আর কুয়াশা ঘেরা এক জায়গায় গাড়ি থেকে নামলাম। দেখি কুলকুল করে আওয়াজ হচ্ছে, নিচে বৃষ্টির জল মনে হয় পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে যাচ্ছে। কিছু ছবি তুললাম। তারপর আবার পাহাড়ি রাস্তার আঁক বাঁক পেরিয়ে একটু চা খাওয়ার ঝোঁক তো থাকেই। গাড়ি থামলো চটকপুর। চা খেলাম। আরো টুকটাক ছেলের বায়না অনুযায়ী লজেন্স, চিপস এসব কিনলাম। তারপর সোনাদা হয়ে দার্জিলিং ঢুকলাম। রাস্তাঘাট বুঝে ড্রাইভার দাদা ভিড় এড়িয়ে আরেক রাস্তা ধরলো ঘুম স্টেশনকে পাশে রেখে। কিছু দূর যাওয়ার পরেই আরেক পাহাড় ধরে নিলো গাড়ি। আসলে পাহাড় তো নয়, এক পাহাড়েই উঁচু নিচু রাস্তা, অলিগলি আর শহর। কেনাকাটা পাগল আমার মা উৎসুক চিত্তে তাকিয়েই আছে দোকানপাটের দিকে। বেশ কয়েক বাঁক নিতেই একটা রাস্তার কোনের দিকের হোমস্টেতে নামলাম। বিকেল সাড়ে পাঁচটা। অল্প বয়সী একটি ছেলে রিসিভ করলো আমাদের। ভালো ব্যবস্থা বেশ। হোটেলের থেকে কোনো অংশে কম নয়। প্রচন্ড খিদে এদিকে, বলেই ফেললাম একটু চা খাবো। ফ্রেশ হওয়ার পর, চা আর ডিমের পকোড়া সহযোগে পেটে পুড়লাম। সে রাতে জানলা থেকেই গোটা শহর উপভোগ করলাম। কষ্ট হয় সত্যি। এরকম একটা জায়গায় আমার জীবনটা লেখা থাকলো না কেন? সে রাত এখানে এদের আতিথেয়তায় ভালো কাটলো। অল্পবয়সী ছেলেটি আমার ছেলের সঙ্গে বেশ মিশে গেল। এ দিনটা হয় তো নষ্টই হলো, কিন্তু শহরের সৌন্দর্য মন ভুলিয়ে দিলো এক মুহূর্তেই।

 

পরের দিন আমাদের টয় ট্রেন চড়ার পালা। ভাবলাম আজ একটু হাঁটাহাঁটি করবো। হোমস্টে থেকে বেরিয়েই একটা ছোট মনেস্ট্রি দেখে হাঁটা লাগালাম। পুরো পাহাড়ি রাস্তা ধরে এক মাইল হাঁটার পর দার্জিলিং স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। নির্দিষ্ট সময় ট্রেন ছাড়লো। আঁকাবাঁকা রাস্তার এক পাশে ট্রেন আর আরেক পাশে গাড়ি চলতে দেখেই ওই গানটা মনে চলেই আসে, "মেরি সপ্ন কি রানী কব আয়েগি তু"... পৌঁছে গেলাম বাতাসিয়া লুপ। বাবাকে দেখে ভালো লাগছিলো। ছোট ক্যামেরা বার করে ছবি তুলতে তুলতেই চোখ দুটো আনন্দে চকচক করে উঠছিলো। আমার সব ছবি আমার ছেলে তুলে দিয়েছে প্রায়। কর্তার ছবিতে খুব এলার্জি। তোলা এবং তুলতে বলা দুটোতেই অনীহা। যাই হোক, বাতাসিয়া ছেড়ে আমরা ঘুম-এ এসে পৌঁছালাম। ওখানে মিউজিয়ামটা দেখে, কিছু খেলাম। ফেরাটা আমরা গাড়িতেই করেছি, কারণ ভেবেছিলাম ঘুম মনেস্ট্রিটা দেখবো। মা এমন ম্যাল-এ যাবো, ম্যাল-এ যাবো করেছে, আমরাই বেমালুম ভুলে গেছি মনেস্ট্রির কথা। অগত্যা ম্যালে পৌঁছালাম। কেভেন্টার্স এও বিরাট ভিড়, ম্যাল না মেলা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। এদিকে পায়ের অবস্থা খারাপ। অগত্যা ম্যাল থেকে বেরিয়ে হোমস্টে। তখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে।




 

 

দার্জিলিং ছুঁয়ে তো গেলাম। হয় তো প্রথম দিনের সমস্যার জন্য সেভাবে ঘোরা হলো না। দীর্ঘ ৩৭ বছর পরে আমার বাবা মা দ্বিতীয় বার দার্জিলিং এলো। প্রথম বার আমার বয়েস ছিলো ঠিক ৯ মাস। ওঁদের অভিজ্ঞতা খুব তিক্ত ছিলো। জলের সমস্যা ও ঠান্ডার জন্য খুব কষ্ট হয়েছিল। তাই এ পথে আর আসেনি। কিন্তু ২০১৬ সালে আমি আবার দার্জিলিং ঘুরে এটুকু বলতে পেরেছিলাম, এখন আর সে দিন নেই।

 

কাল সকালে আমরা তাকদার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবো। ৩১ শে মে, সকালের ব্রেকফাস্ট আমরা হোমস্টের ছাদে করলাম। অল্প বয়সী ছেলেটির নাম যুবরাজ। সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে ছাতা ফিট করে দিলো। ছাদ থেকে ভিউ ভালো। মেঘ না থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। তাঁদের বাড়ি বলে ও এবং ওর বোন, ছুটোছুটি করে সার্ভিস দিচ্ছে, মা আর বৌদি রান্না করছে। কখনো আমিও চা এর কাপ দিয়ে আসা, খাবারের প্লেট দিয়ে আসা এগুলো করে সাহায্য করার চেষ্টা করেছি। সেটুকুতেও তারা খুশি। কিছু মানুষ এভাবে মনে দাগ কেটে যায়। ভালো লেগে যায়। ভালো মানুষ হিসেবে স্মৃতি রেখে যায়।

সকাল দশটা নাগাদ গাড়ি চলে এলো। এদের আতিথেয়তাও ভালোই। এমনকি তাকদা ঠিক মতন পৌঁছেছি কি না সেটুকুও খবর নিতে ভোলেনি যুবরাজ।


 

ঘন্টা দেড়েকের রাস্তা তাকদা। তার মাঝখানে তাকদা অর্কিড সেন্টার এ নেমে সুন্দর সুন্দর অর্কিড-এর নার্সারী দেখে পাহাড়ি রাস্তার আঁক বাঁক ধরে চললাম। তারপর আরো সরু এবং পাথুরে রাস্তার মধ্যে ভীষণ উঁচু নিচু রাস্তার মধ্যে ড্রাইভার দাদা অত্যন্ত সাবধানে গাড়ি চালিয়ে নামিয়ে দিলো আমাদের। এখানে আমাদের নতুন হোমস্টে হল উডস হেরিটেজ বাংলো। ঝকঝকে বিশাল বাংলোই বটে। সুন্দর বাগান, কফি হাউস, বোনফায়ার, দোলনা, মাছ, খরগোশ, কি নেই! অদ্ভুত সুন্দর ভিউ। এখানকার মালিক, প্রাক্তন আর্মি। একদম খোদ প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জেন্টলম্যান মানুষ। খাবারদাবার  অসাধারণ। এদিন হঠাৎ করেই জ্বর এসে গেছিলো আমার। বিকেলে নামলো অঝোর ধারায় বৃষ্টি। এদিন বিশ্রাম। কাছেই এক কৃষ্ণ মন্দির। আমার যাওয়া হলো না।
পরের দিন আমরা তিনচুলে, পেশক টি-গার্ডেন, লামাহাটা যাবো। সকাল দশটায় গাড়ি এলো। প্রথমে আমরা টি-গার্ডেন দেখলাম। তারপর ত্রিবেণী সঙ্গম। ছোটা রঙ্গীত, বড়া রঙ্গীত আর তিস্তা এই তিন নদী এক ধারায় মিশেছে। বহু কাছ থেকে তিস্তা ছুঁলাম। ফেরার পথে লামাহাটা স্যাক্রেড হোলি পন্ডদ্রষ্টব্য। পাহাড়ের ওপরে একটা লেক। প্রচুর দুর্গম সে হাঁটা পথ। মা গেল না, নিচে অপেক্ষা করলো। আমি, বাবা, আমার ছেলে আর আমার হাসব্যান্ড আমরা ৪ জন গেলাম। ৪ জনেই চলতি পথে পিছল খেয়েছি। তবু হার মানিনি। ৭৫০ মিটার হাঁটা উঁচু নিচু পাহাড়ের রাস্তা পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠতে পারলাম। ওপরে গিয়ে মনে হলো, সত্যি বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি!

 

 

আমাদের যেতে আধ ঘন্টা লেগেছিলো। জোশ এসে গেছিলো পুরো। তবে বাবাকে নিয়ে একটু টেনশন হয়ে গেছিলো আমার। মনের জোরে হয় তো চলে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয়, বয়স্কদের না যাওয়াই ভালো।


নিচে নেমে আমরা ফিরে এলাম বাংলোতে। আজ বোনফায়ারে মুরগি খাওয়া হলো। কিছু গল্প আর বিশ্রামের পর রাত কাটানোর অপেক্ষা। কাল নেমে যাবো শিলিগুড়ি। বাড়ি ফেরার পালা।


বিদায় পাহাড়।

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait