অণুগল্প : বাক্রহিত
কলমে : মৌসুমী মুখোপাধ্যায়
প্ল্যাটফর্মের ওভারব্রিজের উপর মিনতিদিকে দেখেই চুপচাপ কেটে পড়ার ধান্দায় ছিলাম। বড্ড বকেন ভদ্রমহিলা! অবশ্য বয়স বাড়লে এমনিতেই অনাবশ্যক কথা বলার প্রবণতা বেড়ে যায় মানুষের, উল্টোদিকের মানুষটি শুনতে চাইছে কিনা একেবারেই ভেবে দেখেন না। স্বাভাবিক লজ্জা সংকোচ কিংবা ভদ্রতাবশে আমি আবার অপছন্দটা ওঁকে বুঝিয়ে দিতেও পারি না। মনে হয় যাক্গে, আর তো কয়েকটা মাস। সামনের বছরেই রিটায়ার করবেন মিনতিদি।
এবার অবশ্য দেখাও হল অনেক দিন পরে। কী জানি আমার এড়িয়ে যাওয়াটুকু বুঝে উনিও আমাকে এড়িয়ে যেতেন কিনা! দীর্ঘ দিন দেখা পাইনি ওঁর। অন্য ট্রেনে যেতেন, তাও অবশ্য হতে পারে। আসলে আমি অফিসে যাতায়াতের এই ছোট্ট পথটুকুতে একটু নিজের মত থাকতে ভালোবাসি। পছন্দের বই পড়ি, কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনি, কখনও নিছকই চলন্ত ট্রেনের জানালায় চোখ ফেলে রাখি আলগোছে। চলার পথের এই নিজস্ব সুখের সময়টুকু এক্কেবারে নষ্ট হয়ে যায় মিনতিদির সঙ্গে দেখা হলে। ফাঁকা ট্রেনে উঠে ঠিক আমার পাশটিতেই বসেন উনি আর নামেন আমারও চারটে স্টেশন পরে। তার পর গোটা পথ জুড়ে কেবল বকবক আর বকবক। ছেলে কী করছে, বৌমা কত ভালো হয়েছে, মেয়ের নতুন বয়ফ্রেন্ড কতটা বড়লোক থেকে শুরু হয় আর তারপর স্কুল, কলিগ, বড়দি, পুজোর বাজার সব ছুঁয়ে শেষ হয় রাজ্য এবং দেশের দুরাবস্থা দিয়ে। প্রায়শই কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার গন্তব্য চলে আসে। প্ল্যাটফর্মে নেমে ট্রেনের জানলা দিয়ে হাত নাড়তে আসি যখন, তখনও উনি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে আগের কথার কন্টিনিউশান চালিয়ে যান, যতক্ষণ না ট্রেন গতি নিচ্ছে।
এ হেন মানুষ যতই ভালো হন না কেন এড়িয়ে না গিয়ে উপায় থাকে না।
প্রায় এড়িয়ে গেছিলামও, হঠাৎ চোখে চোখ পড়ল। উনি হাসলেন। দীর্ঘদিনের সহযাত্রী; তার উপরে আবার এত দিন বাদে দেখা, সৌজন্যের হাসি হেসে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রেন এখনও বলেনি। এক নাম্বার নাকি তিন নাম্বার কোন প্ল্যাটফর্মে দেবে ঠিক নেই, ওভারব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে থাকাটাই তাই দস্তুর। কাছে গিয়ে বললাম, "এই এক ভালো কাজ হয়েছে আমাদের বলো, ওভার ব্রিজের উপর ভারী ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা! রেলের উচিত ওভার ব্রিজের উপর বসার কয়েকটা জায়গা করে দেওয়া।"
মিনতিদি হাসলেন; মুখে বললেন না কিছুই। আমি নিজেই কথা বলা শুরু করলাম আগের দিন ট্রেন ধর্মঘটে কেমন অসুবিধায় পড়েছি, ভাড়ার গাড়িতে কতজন মিলে, কত কষ্ট করে, কী ভাবে ফিরেছি, কত রাত হয়েছে এইসব আর কী। মিনতিদি চোখ বড়বড় করে শুনলেন সব, কিন্তু একটি কথাও বললেন না। একটিও প্রশ্ন করলেন না। একটু অবাকই হলাম। ভদ্রমহিলার হল কী! কোনো কারণে রাগ করলেন আমার উপর! নাকি বুঝতে পেরে গেলেন ওঁর ওই অনাবশ্যক বকবক আমার বিরক্তিরই উদ্রেক করে শুধু!
ইতিমধ্যে ট্রেন বলল। তিন নাম্বার প্ল্যাটফর্মে দিয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে নামছি, আমার পাশে পাশে মিলি, আর এক সহযাত্রিণী। মিনতিদি অনেকটা এগিয়ে। মিলিকে বললাম, "মিনতিদি, কেমন চুপচাপ হয়ে গেছেন, না গো! কত কথা বলতেন আগে!"
মিলি অবাক হয়ে বলল, "চুপচাপ কি গো! তুমি জানো না কিছু?"
-"কী জানব?"
-"মিনতিদির তো জিভে ক্যান্সার হয়েছিল, পুরো জিভটাই কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়েছে। মিনতিদি এখন আর কথা বলতে পারেন না।"
Enter your email address to reset your password.
The very name 'SWADES' denotes the philosophical essence and ideological standpoint of our vision. We envisage serving our 'Swades' by providing news, special stories and literary works of the new generation writers which would cater to the interest of the Nation.
Swades Times © 2020 , All rights Reserved
0 comments