ভ্রমণ কাহিনী : ফিরে দেখা - দিনান্ত

ভ্রমণ কাহিনী : ফিরে দেখা - দিনান্ত

আজ আমি যে দিনান্তের কথা লিখতে বসেছি, এ দিনান্ত তা নয়, এ হল ছবির মতো, রঙ তুলিতে আঁকা মনোমুগ্ধকর এক জায়গা, যার নামই হল 'দিনান্ত'। বেলজিয়ামের নামুর প্রদেশে অবস্থিত ওয়ালোনিয়ার একটি শহর এবং পৌরসভা। ব্রাসেলসের ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে, মিউজ নদীর তীরে অবস্থিত। ফ্রেঞ্চ সীমান্তের খুব কাছে এই দিনান্ত শহরটি। দিনান্ত শব্দের অর্থ এখানে পবিত্র উপত্যকা। পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন বেলজিয়াম ভ্রমণের কাহিনী।


ভ্রমণ কাহিনী : ফিরে দেখা - দিনান্ত

কলমে : পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


দিনান্ত শব্দের বাংলা অর্থ দিনের অবসান, সন্ধ্যা।

                       

         বিকেল বেলায় দিনান্তে মোর

         পড়ন্ত এই রোদ

         পুবগগনের দিগন্তে কি

          জাগায় কোনো বোধ ?


আজ কিন্তু আমি যে দিনান্তের কথা লিখতে বসেছি, এ দিনান্ত তা নয়, এ হল ছবির মতো, রঙ তুলিতে আঁকা মনোমুগ্ধকর এক জায়গা, যার নামই হল 'দিনান্ত'। বেলজিয়ামের নামুর প্রদেশে অবস্থিত ওয়ালোনিয়ার একটি শহর এবং পৌরসভা। ব্রাসেলসের ৯০ কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বে, মিউজ নদীর তীরে অবস্থিত। ফ্রেঞ্চ সীমান্তের খুব কাছে এই দিনান্ত শহরটি। দিনান্ত শব্দের অর্থ এখানে পবিত্র উপত্যকা।

ADVERTISEMENT


              ২০১৯ সালে আমাদের মেয়ে জামাইয়ের কাছে বেলজিয়াম গিয়েছিলাম, জামাইয়ের কর্মসূত্রে ওরা ওখানে থাকে। ওদের ব্যস্ততার জীবন , তারই মাঝে সময় সুযোগ করে অনেক জায়গাতেই ওরা আমাদের নিয়ে গেল। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হলেও আমার জামাই খুব ইতিহাস প্রেমী, দিনান্ত তাই ওর খুব প্রিয় জায়গা। ওই বললো, আপনাদের একদিন দিনান্তে নিয়ে যাবো, খুব ভালো লাগবে।



              ২২শে জুন ,২০১৯ খুব সকাল সকাল তৈরী হয়ে সাড়ে আটটা নাগাদ আমরা বেরোলাম। প্রথমে বাসে গিয়ে তারপর ট্রেনে উঠলাম, ট্রেনে দেড়ঘন্টা মতো লাগলো, মোট ছ'টা স্টেশন। স্টেশনে নেমে সামান্য হেঁটে এসে যেখানে পৌঁছলাম, জায়গাটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল, নদী,পাহাড়,দুর্গ, নদীর ওপর ব্রীজ আর চারদিকে সবুজের হাতছানি। সামনেই ব্রীজ, ব্রীজের নাম 'চার্লস দ্য গল।' ব্রীজে ওঠার মুখেই রয়েছে স্যাক্সোফোনের আবিষ্কর্তা এডলফ স্যাক্সের একটি মূর্তি, আর ব্রীজের ওপর ইউরোপের বারোটি দেশের নামে রয়েছে বারোটি স্যাক্সোফোন। কি সুন্দর শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, খুব ভালো লাগলো দেখে। এরপর ব্রীজ পেরিয়ে এসেই নামলাম চার্চের সামনে, শহরের ল্যান্ড মার্ক হল নটর ডেম ডি দিনান্তের কলেজিয়েট চার্চ। ১২২৭ সালে সংলগ্ন ক্লিফ থেকে পাথর পড়ে প্রাক্তন রোমানেস্ক শৈলীর চার্চটি আংশিকভাবে ধ্বংস হওয়ার পরে এটিকে গথিক শৈলীতে এর পুরোনো ভিত্তির ওপর পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। এই কলেজিয়েট চার্চের অবস্থিতি অসাধারণ। সামনে মিউজ নদী, পিছনে পাহাড়ের সারি আর মাথার উপরে দুর্গ। আর একটা দর্শনীয় ব্যাপার হল এই চার্চের চূড়াটা পেঁয়াজের মতো। চার্চের ভেতরে ঢুকেও ভীষন ভালো লাগলো, এমনিতে হয়তো মনে হবে সব চার্চের ভিতরটা একই রকম, কিন্তু এখানে রঙিন কাঁচের জানলাগুলি অত্যন্ত সুন্দর এবং মূর্তিগুলিও অসাধারণ বিখ্যাত সব শিল্পীদের তৈরী। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তৈরী এই চার্চের শিল্পকর্ম দেখবার মতো। রঙিন কাঁচের জ্যামিতিক জানলাগুলির সামনে রয়েছে বিশাল ত্রুশযুক্ত সজ্জিত বেদী, যেখানে যীশুর মূর্তি রাখা আছে।

 


              এরপর আমরা গেলাম দিনান্তের বিখ্যাত সিটাডেল বা দুর্গ দেখতে। সাম্প্রতিককালে এই দুর্গ তৈরী হয়েছিল ১৮১৫ সালে। দুর্গটি এখন একটি মিউজিয়ম হিসাবে রয়েছে। এখানে ওঠবার জন্য ৪০৮টি সিঁড়ি ভাঙতে হয়, তবে কেবলকারও রয়েছে। আমরা কেবলকারেই  ওপরে উঠলাম। সেও এক অনবদ্য অভিজ্ঞতা। একেবারে পাহাড়ের ওপর থেকে দিনান্তের সবুজ উপত্যকা  ও মিউজ নদী দেখে আবারও মুগ্ধ হলাম। এই দুর্গের ঐতিহাসিক পরিমণ্ডল দর্শকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। ফ্রান্স এবং স্পেনের মধ্যে ১৭শতকের যুদ্ধে দিনান্ত তার নিরপেক্ষতা সত্ত্বেও ধ্বংস ,দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর শিকার হয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে শহরটি আবার ধ্বংসের মুখে পড়ে। ১৯১৪ সালের ১৫ই আগস্ট জার্মানরা আক্রমণ করে শহরটিকে ধ্বংস করেছিল। ১৯১৪ সালে জাৰ্মানদের দ্বারা সংঘটিত সবচেয়ে বড় গণহত্যা, একমাসের মধ্যে প্রায়  পাঁচহাজার বেলজিয়ান ও ফরাসি বেসামরিক লোক জাৰ্মানদের দ্বারা নিহত হয়েছিল।

 


             সাধারণ দর্শকের জন্য এই দুর্গে যে মিউজিয়াম তৈরী করা হয়েছে সেখানেই দেখতে পেলাম ফ্রেঞ্চ সৈন্যেরা কিভাবে থাকতো, তাদের রান্নাঘর, শোবার ঘর। তাদের সে সময়কার সমস্ত ব্যবহৃত অস্ত্রশস্ত্র এবং কিভাবে যত্নসহকারে সেসব রাখা হতো তা সবই দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে।সাতটা বড় বড় ঘরে সেই সময়ের সমস্ত খুঁটিনাটি বিষয়গুলি সুনিপুণ ভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। শত্রুদের কিভাবে অন্ধকার কারাগারে রাখা হতো, গিলোটিন ব্যবহার করে কি ভাবে শাস্তি দেওয়া হতো তা দেখে মনে আতঙ্কের সঞ্চার হচ্ছিল। একটা বড় অন্ধকার ঘরে ভয়াবহ যুদ্ধের আওয়াজ ভেসে আসছিল চতুর্দিক থেকে, যাতে সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা মানুষ উপলব্ধি করতে পারে। দেখতে দেখতে এক ভয়ংকর যুদ্ধের আবহাওয়ার মধ্যে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম।



এই দুর্গের ভেতরে ছোটদের জন্য একটা পার্ক আছে। প্রথম ঢুকেই আমার নাতনী তিন্নি সেখানে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু তখন তাকে পরে আসব বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, আমরা তারপর সেখানে গেলাম। পার্কে কিছুটা সময় কাটিয়ে আবার আমরা রোপওয়ে করে নিচে নামলাম। এদিকে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছিল তাই আমরা একটা দোকানে ঢুকলাম। এখানে খাওয়া হলো দুড়ুম বলে একটা জিনিস, যেটা দেখতে এবং খেতে আমাদের রোলেরই মতো কিন্তু আকারে অনেক বড়, যেটা আমাদের মতো বয়স্কদের পক্ষে কখনোই পুরোটা খাওয়া সম্ভব নয়।



              খাওয়া শেষ করেই দৌড় লাগালাম জাহাজে ওঠার জন্যে। মিউজ নদীতে ঘোরা হবে। তিনটের সময় ছাড়ার কথা, কিন্তু তিনটে দশে ছাড়ল। আমরা সোজা ছাদে উঠে গিয়ে বসলাম। তবে রোদের প্রচণ্ড তেজ ছিল। এই মিউজ ইউরোপের এক বড় নদী। ফ্রান্স থেকে শুরু হয়ে বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসের মধ্যে দিয়ে বয়ে গেছে। ৯২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদী অবশেষে জার্মানির রাইনের সংগে মিশেছে। এর ডাচ নাম মাস। এই নদীর জলের বেশীরভাগটাই বৃষ্টির জল। পুরো দিনান্ত শহরকে দুপাশে রেখে মাঝে বয়ে চলেছে এই মিউজ। নদীর দু'পাশে বড়ো বড়ো বাড়ি, হোটেল, বিশাল পাহাড়, জঙ্গল, চার্চ, দুর্গ সব দেখতে দেখতে একসময় জাহাজযাত্রা শেষ হলো এক অনবদ্য অনুভূতির মধ্যে।



             ছোট্ট শহর দিনান্ত। কিন্তু পাহাড়, নদী, বিস্তীর্ণ উপত্যকা ও সবুজ বনাঞ্চল তাকে ছবির মতো সুন্দর করে তুলেছে। ইতিহাস ও প্রকৃতি এখানে একে অপরের পরিপূরক। দুজনেই এভাবে হাত ধরাধরি করে চলেছে বলেই দিনান্ত আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। সৌভাগ্যক্রমে সারাজীবনে দেশ বিদেশের অনেক জায়গাই দেখেছি, কিন্তু দিনান্ত যেন সবার থেকে আলাদা; তাই ফিরে দেখতে গিয়ে তার কথাই সবার প্রথমে মনে পড়ে যায়।a


0 comments

Redirect to Address page

Updating Subscription details

Redirecting...Please Wait